পানি সংকটে নাকাল নগরবাসী

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০২২, ০২:৩৪ পিএম

ঢাকা : গ্রীষ্মের শুরুতেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। অতিষ্ঠ নগরবাসী রাস্তায় অবরোধ করে বিক্ষোভও করেছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন নানাভাবে চেষ্টা করেও সমাধান মিলছে না।

আর ওয়াসা কর্মকর্তা বলছেন, পানির চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় কোথাও কোথাও সমস্যা হচ্ছে।

এদিকে গত ১৩ বছরের ১৪ বার পানির দাম বৃদ্ধির পর আবারো শুরু হয়েছে মূল্যবৃদ্ধির তোড়জোড়। এই দাম বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ানো হয়েছে সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের বেতনও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিস্টেম লসের নামে ‘চুরি’ রোধ করা গেলে পানির দাম বৃদ্ধির প্রয়োজন হবে না।

চলমান পানি সংকটের ঘটনায় কর্তৃপক্ষের কাছে বার বার ধর্ণা দিয়েও ব্যর্থ হওয়ায় বিক্ষোভে নেমেছেন এলাকাবাসী। মিরপুর এলাকাবাসী ওয়াসা অফিস এবং উত্তরার আশকোনা এলাকাবাসী রাস্তা অবরোধ করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ওয়াসা অফিসে লিখিতভাবে পানি সংকটের কথা জানিয়েছেন তারা।

ওয়াসার কর্মকর্তারাও পানি সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে জানিয়েছেন, গরমে পানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়া ও পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারণে পানি সংকট তৈরি হয়েছে।

এলাকাবাসী জানান, দুই এক বালতি পানি ভরার পর পানি চলে যাচ্ছে। আর যে পানি পাওয়া যায় সে পানিও নোংরা। যা রান্নাবান্নার কাজে একেবারেই ব্যবহার করা যায় না। পশ্চিম কাজীপাড়া, মিরপুর ১৪ ও ১, কল্যাণপুর, গুদারাঘাট, বাড্ডা, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ি, হাতিরঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়েছে এই পানির সংকট।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিরপুর-১ এর পূর্ব আহমেদ নগর, জোনাকি রোড, ব্যাংক কলোনি, বায়তুল ইকরাম মসজিদ এলাকা, মনিপুরের কিছু অংশ এবং পীরের বাগের কিছু এলাকার বাসিন্দারা গত দুই সপ্তাহ ধরে তীব্র খাবার পানির সংকটে ভুগছেন।

স্থানীয় এলাকাবাসী লুৎফর রহমান খান জুয়েল বলেন, আমরা গত দুই সপ্তাহ ধরে ভয়াবহ পানি সংকটে ভুগছি।

ওয়াসার পানি না থাকায় শুধু খাবার পানির সংকট নয়, গোসল, রান্নাসহ নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে আমাদের। বায়তুল ইকরাম মসজিদে ১৫ দিনের বেশি ধরে পানি না থাকায় অজু করতে মুসল্লিদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

ওয়াসার বাংলা কলেজের পাশের জোন অফিসে গিয়ে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। তারপরও তারা কোনো সুরাহা করছে না।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মুরাদ হোসেন বলেন, বেশকিছু দিন ধরেই এলাকার মানুষ ওয়াসার পানি সংকটে ভুগছে। খুবই খারাপ অবস্থা। আগে সংকট হলে কাউন্সিলর হিসেবে আমাকে বিনামূল্যে পানি দিতো। কিন্তু এখন আমাকেও পানি দিচ্ছে না। আমাকেও ওয়াসার গাড়ির পানি কিনে খেতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, এলাকার পানি সংকটের বিষয়টি জানিয়ে আমি ওয়াসা অফিসে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। তারপরও এখনো পানি সংকট দূর হয়নি। ওয়াসার কর্মকর্তাদের ফোন দিলেও তারা ধরছে না। একই ধরনের মন্তব্য করেন ডিএনসিসির ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাসেম মোল্লা।

তিনি বলেন, দীর্ঘদিন থকেই গরমকালে অত্র এলাকায় পানির সংকট দেখা দেয়। চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় এলাকাবাসীদের। ওয়াসার কাছে বার বার ধর্ণা দিয়েও প্রতিকার পাওয়া যায় না।

এ বিষয়ে ওয়াসার স্থানীয় মডস জোনের-৪ নির্বাহী প্রকৌশলী ইকবাল আহমেদ মজুমদার বলেন, গরম বেড়ে যাওয়ায় পানির চাহিদা বেড়েছে।
এছাড়া মিরপুর এলাকায় পাম্পের পানি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু গরমের সময় পানির স্তরও ২/৩ মিটার নিচে নেমে যাওয়ায় পানির উৎপাদন কমে গেছে। এ কারণে কয়েকটি এলাকায় পানি সংকট দেখা দিয়েছে। তবে আমরা বিষয়টি সমাধান করার চেষ্টা করছি।

উত্তরা এলাকার ৪৯নং ওয়ার্ডের গাওয়াইর আশকোনা এলাকায় বেশকিছু দিন ধরেই পানি সংকট দেখা দিয়েছে। তীব্র পানির সংকট হওয়ায় গত ১৯ মার্চ স্থানীয় এলাকাবাসী রাস্তা অবরোধ করে প্রতিবাদ জানান এবং পানি সরবরাহ বাড়ানোর দাবি জানান।

স্থানীয় সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাকিয়া সুলতানা বলেন, আশকোনা এলাকায় বেশকিছু দিন ধরেই পানির সংকট চলছে। এমনকি আমার বাসাতেও পানি পাচ্ছি না। এলাকায় পানির নতুন লাইন স্থাপন করা হচ্ছে।

এ কারণে সংকট দেখা দিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এলাকাবাসী রাস্তা অবরোধ করলে পরে ওয়াসার লোকজন এসে লাইনের চাবি ঘুরিয়ে দিয়েছে। আগামী দুই-তিনদিনের মধ্যে সমস্যা কমে যাবে বলে তারা জানিয়েছেন।

এ দুটি এলাকা ছাড়াও সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার থেকে যেসব এলাকায় পানি সরবরাহ করা হয় সেসব এলাকায় পানি সংকটের পাশাপাশি দুর্গন্ধও বেড়ে গেছে। এতে ওইসব এলাকার বাসিন্দারা বেশ সংকটে পড়েছেন। যাত্রাবাড়ি, মুগদা, মানিকনগর, বাসাবো এলাকার বাসিন্দারা গত কয়েকদিন ধরেই পানি সংকট ও দুর্গন্ধজনিত সমস্যায় ভুগছেন।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পানি সংকটের বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার পরিচালক (কারিগরি) একেএম সহিদ উদ্দিন বলেন, গরমের সময় পানির স্তর দুই-তিন মিটার করে নিচে নেমে যায়। এ কারণে যে পাম্পে দৈনিক আড়াই হাজার লিটার পানি উৎপাদন হতো সেখানে এখন ১৮শ লিটার পানি উৎপাদন হচ্ছে।

এছাড়া গত কয়েকদিন ধরে গরম বেড়েছে। এতে মানুষ বেশি পানি ব্যবহার করছে। অনেকে দিনে দুই তিনবারও গোসল করছেন। এ কারণে লাইনের শুরুর দিকের বাড়িগুলোতে পানি থাকলেও একটু দূরে যারা আছেন তাদের কাছে পানি ঠিকমতো পৌঁছাচ্ছে না।  এতে ওইসব বাড়িগুলোতে পানি সংকট হচ্ছে। তবে সংকটের খবর পেলে ওয়াসার পক্ষ থেকে দ্রুত বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।

এদিকে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১৩ বছরে ১৪ বার ঢাকা ওয়াসা পানির দাম বাড়িয়েছে। করোনা মহামারির মধ্যেও ঢাকা ওয়াসা গত দুই বছরে পানির দাম ৩১ শতাংশ বাড়িয়েছে। এখন আরেক দফা পানির দাম বাড়াতে নানা যুক্তি তুলে ধরছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি ওয়াসা ভবনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, ওয়াসার পানির উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রয়মূল্যের মধ্যে ব্যবধান অনেক। প্রতি এক হাজার লিটার পানিতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ১০ টাকা। সরকারের কাছ থেকে ভিক্ষা নিয়ে কোনো সংস্থা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। পানির দাম বাড়িয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে ওয়াসাকে।

ঢাকা ওয়াসার ২০২০-২১ অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, শুধু পানি ও সুয়ারেজ বিল বাবদ ঢাকা ওয়াসার রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ হাজার ৫৯২ কোটি টাকার। এর মধ্যে পানির বিল বাবদ আয় ১ হাজার ২০১ কোটি টাকা। বাকিটা সুয়ারেজ বিল বাবদ আয়। ট্যাক্সসহ অন্যান্য সব খরচ বাদ দিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে ঢাকা ওয়াসার লাভ হয়েছে ৪৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। বছর শেষে ঢাকা ওয়াসার সঞ্চিত মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৯২ কোটি টাকা।

সরকারের একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান লাভে থাকার পরও পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাবকে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন নগরবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আকতার মাহমুদ।

তিনি বলেন, এমডির ভিক্ষা করে চলা বক্তব্যের সঙ্গে আর্থিক প্রতিবেদনের মিল নেই। তারা নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে পানির দাম বাড়িয়ে জনগণকে দুর্ভোগে ফেলছেন।

বর্তমানে ঢাকায় পানির দৈনিক চাহিদা কমবেশি ২৫০ কোটি লিটার। এর বিপরীতে ঢাকা ওয়াসা দৈনিক ২৬০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করার দাবি করে।

ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, সিস্টেম লস ২০ শতাংশ বাদ দিলে প্রতিদিন ৫২ কোটি লিটার পানি গ্রাহক পর্যন্ত যায় না। গ্রাহক পান ২০৮ কোটি লিটার। ফলে পানির ঘাটতি থাকছে।

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা নাগরিক সংগঠন এবং নগরবিদরা বলছেন, কোনো প্রতিষ্ঠানে ৫ শতাংশের বেশি সিস্টেম লস অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার বড় প্রমাণ। ওয়াসা নিজেদের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের দায় জনগণের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে।

সংস্থাটি সিস্টেম লসের যে কথা বলছে, তার অধিকাংশ আসলে ‘চুরি’। ওয়াসার অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীরা পানির অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে টাকা নেয়। এসব বন্ধ করা দরকার।

এদিকে ঢাকা ওয়াসার পানিসংকট নিয়ে নগরবাসীর অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সংস্থার অন্যান্য সেবা নিয়েও আছে বিস্তর অভিযোগ। তারপরও গত ১৩ বছরে ১৪ বার পানির দাম বাড়িয়েছে ঢাকা ওয়াসা। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ানো হয়েছে সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের বেতনও।

সর্বশেষ করোনা মহামারির মধ্যে এক লাফে ওয়াসার এমডির বেতন বাড়ানো হয়েছে পৌনে ২ লাখ টাকা। এই বৃদ্ধির পর ওয়াসার এমডি হিসেবে তার মাসিক বেতন এখন ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এ হিসাবে গত ১২ বছরে তাকসিম এ খানের মাসিক বেতন বেড়েছে ৪২১ শতাংশ।

এদিকে তাকসিমের পরে যারা ওয়াসার এমডি হবেন, তারা যেন এই পরিমাণ বেতন না পান, সেটিও নিশ্চিত করেছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।

সোনালীনিউজ/এমটিআই