রাজশাহী: রাজশাহীর নিরাপদ ও পরিচ্ছন্ন শহরের তকমা ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্রই। শান্তির জন্য বসবাস করতে রাজশাহী নগরীতে বাসা বাড়ানোর হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। জমির দামও বেড়ে যায় শত শত গুন।
হত্যা, খুন, ছুরি, ছিনতাই কম হওয়ায় এই শহরেই যেন দেশের মানুষের শান্তির ঠিকনায় পরিণত হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি রাজশাহী শহরের শান্তির তকমা হারিয়ে যাচ্ছে। বেড়েছে হত্যা, খুন, জখম ও চুরি, ছিনতাই। বর্তমানে রাজশাহী শহর যেন চুরি, ছিনতাই, খুন জখমের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।
প্রশস্ত সড়ক আর ক্লিন সিটি হিসেবে রাজশাহী মহানগরীর সুখ্যাতি থাকলেও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে রাজশাহী শহর। নগরি প্রশস্ত রাস্তার ফুটপাতগুলো চুরি হয়ে যাচ্ছে। গত চার মাসে রাজশাহী শহরে চুরি হয়েছে সাড়ে চার শতাধিক রাস্তার স্ল্যাব। নগরীর আলো ঝলমল সড়কবাতি থাকা সত্বেও রাস্তার দর্শনীয় লোহার কারুকাজ ও স্লাব নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় চুরির ঘটনা বাড়ছে বলে অভিযোগ সচেতন নগরবাসীর।
রাজশাহী নগরীর তেরখাদিয়া থেকে সিটিহাট মোড় পর্যন্ত প্রশস্ত রাস্তার ৫৭৫টি স্ল্যাবের সাড়ে চারশোই চুরি হয়ে গেছে। মাদকসেবীরা রাতের অন্ধকারে এগুলো তুলে নিয়ে যাচ্ছে। পরে বিক্রি করে দিচ্ছে ভাঙারির দোকানে। সেখান থেকে টাকা সংগ্রহ করে হত্যা, খুন জখম ও বিভিন্ন অপরাধ কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে। স্থানীয়রা বলছেন, চুরি বাড়তে থাকায় অনিরাপদ হয়ে উঠেছে রাস্তার ফুটপাথে চলাচল। যেকোনো সময় দুর্ঘটনার শঙ্কা তাদের।
এছাড়া প্রতিবাদ করলে ছিনতাই কারীরা হামলা করছে প্রতিবাদকারীর উপর। এছাড়া চুরি হচ্ছে রাজশাহী নগরীর আলো ঝলমল সড়কবাতিও। সম্প্রতি রাজশাহী নগরীর চারটি সড়কের মাটির নীচ থেকে প্রায় ৯২০ মিটার বিদ্যুতের তার নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা।
চুরির বিষয়ে এরইমধ্যে সাধারণ ডায়েরি করেছে রাজশাহী সিটি করপোরেশন। নতুন স্ল্যাব বসানোর উদ্যোগের পাশাপাশি ওয়ার্ড সচিব ও কর্মচারীদের দিয়ে নজরদারিরও চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা। এছাড়া চুরি ঠেকাতে অভিযান চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী নগরীতে অপরাধ দমনের জন্য স্থাপিত সিসি ক্যামেরা অকেজো হয়ে গেছে। ফলে অপরাধীরা সহজেই অপরাধ কর্ম সংঘঠিত করে পালিয়ে যাচ্ছে। অপরাধ দমন ও অপরাধী শনাক্তে ২০২১ সালে রাজশাহী মহানগরীতে সাড়ে চার শতাধিক সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজশাহী নগরীতে বিভিন্ন থানায় হামলা হয়। মহানগর ও জেলা পুলিশের বিভিন্ন থানায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে নগরবাসীর নিরাপত্তায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে স্থাপিত ৪০০ সিসি ক্যামেরা অকেজো হয়ে পড়েছে। এতে প্রতিনিয়ত অবনতি হচ্ছে শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। অপরাধের পর আসামি শনাক্ত করতে না পারায় মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। দ্রুত সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো মেরামতের দাবি জানিয়েছেন নগরবাসী।
তারা বলছেন, সম্প্রতি বিনোদপুর বাজারের একজন ব্যবসায়ীকে বাজার থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। তার নিথর দেহ পড়ে ছিল নগরীর পদ্মার চরে। সেই ঘটনারও এখন পর্যন্ত কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ প্রশাসন। এ ক্ষেত্রে সিসি ক্যামেরাগুলো ঠিক না থাকাকে দায়ী করছে পরিবারের লোকজন। পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, রাজশাহী মহানগরে গত ছয় মাসে ১৬ জনকে হত্যা এবং ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৪টি। এসব ঘটনার অধিকাংশ অপরাধীদের সনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। ঘটনা ঘটার পর দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও গ্রেফতার হচ্ছে না অপরাধীরা।
রাজশাহীর সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি সুব্রত কুমাল পাল বলেন, রাজশাহী নগরী শান্তির জন্য বিবেচিত হওয়ায় এখান বহু জেলার মানুষের বসবাস। এছাড়া নিরাপদ নগরী হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু সম্প্রতি এখানে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে গেছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, নজরদারি কমায় বেড়েছে অপরাধ। অহরহ ঘটছে চুরি ছিনতাই। এভাবে চলতে থাকলে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা আরও বেশি হুমকির মুখে পড়বে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগরীর একজন বাসিন্দা বলেন, ‘নগরীর সিটিহাট এলাকায় রাস্তায় কোনো স্ল্যাব নেই। সব চুরি করে ভেঙে বেচে দিয়েছে ছিনতাইকারীরা। নেশার টাকার জন্য চুরি করে এগুলো ভাঙারির দোকানে বিক্রি করছে। সিটি হাট পর্যন্ত ফুটপাতে একটাও স্লাব নাই। এতে দুর্ঘটনা ঘটছেই। এগুলো দিয়ে চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।’ নিরাপদ শহর হয়ে গেছে অনিরাপদ। প্রশাসন এগুলো কঠোর হাতে দমন না করলে নগরীতে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন তিনি।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) আহমদ আল মঈন বলেন, ‘এ বিষয়ে জিডি করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের কাজ করছে। আমাদের স্থাপনাগুলো মনে হচ্ছে চোরদের জন্য স্বর্গ রাজ্য।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) নাজমুল হাসান বলেন, রাজশাহীর নগরীর সিসি ক্যামেরাগুলো অকেজো হয়ে গেছে। সেগুলো মেরামতের জন্য রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনকে চাহিদাপত্র দেওয়া হয়েছে। তারা প্রজেক্টের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করতে কাজ শুরু করেছে।
এছাড়া রাস্তার যেখানে সড়কবাতি নষ্ট হইছে বা নেই সেখানে আলোকায়নের ব্যবস্থা করতে কাজ চলছে। যাতে অপরাধীদের সনাক্ত করা যায়। ‘সড়কবাতির তার ও ফুটপাথের স্লাব চুরির দুটি অভিযোগ আমরা পেয়েছি। বোয়ালিয়া থানায় অভিযোগ করা হয়েছে। যারা এই কাজগুলো করছে, আমরা তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো বলে জানান তিনি।’
এআর







































