ছবি প্রতিনিধি
মৌসুমের শুরুতে লাভের আশায় হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করেছিলেন লালমনিরহাটের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এখন সেই আলু বিক্রি করতে গিয়ে পড়েছেন বড় ধরনের লোকসানে।
গত সপ্তাহে হিমাগার পর্যায়ে জাতভেদে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ১২ থেকে ১৪ টাকায়। অথচ উৎপাদন থেকে শুরু করে হিমাগারে রাখা পর্যন্ত প্রতি কেজিতে খরচ পড়েছে ২৫ থেকে ২৬ টাকা। ফলে কেজিপ্রতি প্রায় ১৩ থেকে ১৫ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের। বস্তাপ্রতি (৬০ কেজি) লোকসান দাঁড়াচ্ছে ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকা। এই কারণে অনেকেই লোকসানের ভয়ে এখনো হিমাগার থেকে আলু উত্তোলন করছেন না।
বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএসএ) তথ্য অনুযায়ী, লালমনিরহাটের নয়টি হিমাগারে এবার সংরক্ষণ করা হয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার মেট্রিক টন আলু। এ ছাড়া জেলার কৃষক ও ব্যবসায়ীরা পার্শ্ববর্তী রংপুর ও কুড়িগ্রামের বিভিন্ন হিমাগারেও আলু রেখেছেন। প্রতি কেজিতে গড়ে ১৩ থেকে ১৫ টাকা লোকসান হিসাব করলে শুধু লালমনিরহাট জেলাতেই ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১০১ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
হিমাগার ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে আলু প্রকারভেদে গড়ে প্রতি টন বিক্রি হচ্ছে ১১ হাজার ৩০০ টাকায়। ওই হিসাবে লালমনিরহাট জেলায় হিমাগারে অবিক্রিত আলুর বাজারমূল্য দাঁড়াবে প্রায় ২২৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা। অথচ আর মাত্র দুই মাস পরেই শুরু হবে নতুন আলু রোপণের মৌসুম। তখন হিমাগারে থাকা বিপুল পরিমাণ আলু অবিক্রিত থেকে গেলে তা নষ্ট হয়ে যাবে।
কৃষক ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরকার হিমাগার গেটপ্রতি আলুর দাম কেজিপ্রতি ২২ টাকা নির্ধারণ করলেও বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে ১২ থেকে ১৩ টাকায়। বাজারদর কম থাকায় হিমাগার থেকেও আলু তুলছেন না অনেকে। এতে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। এক বস্তা (৬০ কেজি) আলুর উৎপাদন খরচ ও ভাড়া মিলে দাঁড়াচ্ছে প্রায় দেড় হাজার টাকা।
লালমনিরহাট জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মো. হারুনুর রশিদ বলেন, ‘কৃষকরা আলুর ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, সরকার দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।’
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে জেলার ৭ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে প্রায় দুই লাখ চার হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে নয়টি হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৭৮ হাজার মেট্রিক টন আলু। উৎপাদন বেশি হওয়ায় মৌসুমের শুরু থেকেই আশানুরূপ দাম পাননি কৃষকেরা।
আদিতমারী উপজেলার কৃষক আব্দুর রহিম বলেন, ‘লাভের আশায় হিমাগারে ১০০ বস্তা আলু রেখেছিলাম। দুই মাস পর বিক্রি করে হাতে এসেছে মাত্র ২৮ হাজার টাকা। অথচ মৌসুমে বিক্রি করলে পেতাম প্রায় ৬০ হাজার টাকা। এখন তুললে ২০ হাজার টাকার মতো লোকসান হবে।’
কালীগঞ্জের চাপারহাট বাজারের ব্যবসায়ী মাসুদুর রহমান অভিযোগ করেন, ‘আলুর দাম বাড়লেই সরকারি সংস্থা নিয়ন্ত্রণে নামে। কিন্তু দাম পড়ে গেলে কেউ খোঁজ নেয় না। এতে কৃষক ও ব্যবসায়ী উভয়েই সর্বনাশে পড়েছে।’
আদিতমারী উপজেলার আবুল কাশেম হিমাগারের মালিক আব্দুল হাকিম বলেন, ‘এবার কৃষকরা হিমাগার থেকে আলু তুলতে আসছেন না। গত বছর আগস্টের মধ্যে যেখানে ৫০-৬০ হাজার বস্তা আলু বের হয়েছিল, এবার গেছে মাত্র ১০-১৫ হাজার বস্তা।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সাইখুল আরেফিন বলেন, ‘চলতি মৌসুমে জেলায় প্রায় দুই লাখ চার হাজার মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৭৮ হাজার মেট্রিক টন হিমাগারে মজুদ রয়েছে। উৎপাদন ভালো হওয়ায় বাজারদর অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কম।’
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, উৎপাদন ও সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ ভোক্তারা সাশ্রয়ী দামে আলু কিনতে পারছেন। তবে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা লোকসানের বোঝা বইতে গিয়ে মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়েছেন।
এসএইচ







































