• ঢাকা
  • রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বাংলা গানের অস্তিত্ব জুড়ে আইয়ুব বাচ্চু


সাইফুদ্দিন ইমন অক্টোবর ১৮, ২০২১, ১২:৫০ এএম
বাংলা গানের অস্তিত্ব জুড়ে আইয়ুব বাচ্চু

ঢাকা : আইয়ুব বাচ্চু একজন কিংবদন্তী, বাংলা গানের রাজপুত্র। এদেশের ব্যান্ড সংগীতের জনপ্রিয়তা ও সমৃদ্ধির কারিগর, অসংখ্য বাংলা ভাষাভাষী শ্রোতার স্বপ্নের মানুষ। যার গানের মোহে আজও আমরা উজ্জীবিত হই মানসিক প্রশান্তির জন্য। ১৯৬২ সালের ১৬ই আগষ্ট চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার খরনা ইউনিয়নে জন্ম এই কন্ঠ জাদুকরের। মা-বাবার আদর আর ধর্মীয় আবহের পরিবেশে বেড়ে উঠা এই শিল্পী বড় হয়ে পেশায় সংগীত শিল্পী হবে এটা পরিবারের কেউ মেনে নিতে পারেনি। তারা ছিলেন তিন ভাই বোন, দুই ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলো সবার বড়। মায়ের খুব আদরের সন্তান।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্বের  পর তার বাবা চট্টগ্রাম শহরের জুবলি রোড়ে একটি বাড়ি ক্রয় করলে আইয়ুব বাচ্চু তার পরিবারসহ শহরে বসবাস শুরু করেন। যেখানে তার জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে। আইয়ুব বাচ্চু তার শৈশব শেষে কৈশোর জীবনে পা রাখতেই বিভিন্ন বিট্রিশ ও আমেরিকার রক ব্যান্ডের গানের চর্চা করতেন। সেই গানগুলো নিজের ভিতর ধারণ করে নিজের মতো করে গাইতেন।

বিশেষ করে তৎকালীন সময়ের বিশ্বের আলোচিত রক ব্যান্ড লেড জেপলিন, ডিপ পার্পল, কুইন, দ্যা জিমি হেনড্রিক্স এক্সপেরয়িন্স এদের গান গুলো নিজের মতো করে গাইতেন সুর আর গিটারের জাদুতে। তার জীবনে জিমি হেনড্রিক্স এর গিটার বাজানো তাকে এতো মুগ্ধ করেছিলো, যার জন্য তাকে অনুসরণ করে আইয়ুব বাচ্চু গিটার বাজানো এবং গিটারের সাথেই তার জীবনের সর্ম্পক আর সখ্যতা গড়ে উঠে। পরবর্তীতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে গিটারের জাদুকর হিসাবে পরিচিতি পান। আইয়ুব বাচ্চুর গিটার শিখার হাতেখড়ি মূলত তৎকালীন বামির্জি এক গিটার বাদকের কাছে, যার নাম ছিলো জেকব ডায়াজ।

১৯৭৬ সালের দিকে গিটারের প্রতি এতো মোহ জন্মে, যার কারণে তিনি একোষ্টিক গিটার বাজানোর পাশাপাশি বন্ধুর কাছে থেকে ইলেকট্রিক গিটার ধার নেন বাজানোর জন্য। গিটারের প্রতি তার প্রবল আগ্রহ আর বাজানোর প্রতিভা দেখে তার বন্ধু তাকে গিটারটি উপহার হিসাবে দিয়ে দেন।

১৯৭৯  সালে এস এস সি পরিক্ষায় পাশ করার পর চট্টগ্রামের কয়েকজন মিউজিশিয়ান আর বন্ধুদের নিয়ে একটি ব্যান্ড দল গড়ে তোলেন আইয়ুব বাচ্চু। দলটির নাম ছিলো ‘‘গোল্ডেন বয়েজ” পরে নাম বদলে বদল করে রাখা হয় ‘‘আগলি বয়েজ”। সেই ব্যান্ডের ভোকাল ছিলেন কুমার বিশ্বজিৎ আর আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন গিটারিষ্ট। সেই সময় তারা এই ব্যান্ড নিয়ে বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানের গায়ে হলুদ, ক্লাব আর সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাইতেন।

১৯৮০ সালে আইয়ুব বাচ্চু ও কুমার বিশ্বজিৎ যখন সোলসে যোগ দেন তখন ব্যান্ডটি ভেঙ্গে যায়। সোলসের সাথে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত পারফর্ম করেছেন। সোলসে  থাকাকালে সুপার সোলস, কলেজের করিডোর, মানুষ মাটির কাছাকাছি, ইষ্ট এন্ড ওয়েষ্ট এই চারটি এ্যালবামে নিজের প্রতিভা এবং যোগ্যতার ছাপ রেখেছেন।

১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল সোলস ছেড়ে তার নিজের ব্র্যান্ড লিটল রিভার ব্যান্ড গঠন করেন। পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে লাভ রান্স ব্লাইন্ড সংক্ষেপে এল, আর, বি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই ব্যান্ডের সাথে দীর্ঘ ২৭ বছর এক সাথে পথ চলেছেন। একজন একক শিল্পী হিসাবে তার সাফল্য আকাশচুম্বী। তার প্রথম একক এ্যালবাম রক্ত গোলাপ (১৯৮৫), দ্বিতীয় একক ময়না (১৯৮৮), তৃতীয় একক কষ্ট (১৯৯৯) সালে প্রকাশিত হয়। কষ্ট এ্যালবাম সেই সময় এত জনপ্রিয় ছিলো কোম্পানী এ্যালবাম বার বার প্রকাশ করার পরও শ্রোতাদের কাছে এ্যালবামরে ঘাটতি দেখা যেতো। ঐ এ্যালবামে  আমি কষ্ট পেতে ভালবাসি আজও শ্রোতাদের মুখে মুখে শুনা যায়। ২০০৭ সালে তার প্রথম বাদ্যযন্ত্রের এ্যালবাম সাউন্ড অফ সাইলেন্স আজও সংগীত জগতের একটি মাইলফলক।

১৯৯১ সালে এল আর বি গঠন করার পর প্রথম এ্যালবাম প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে । এই এ্যালবামের শেষে চিঠি, ঘুম ভাঙ্গা শহরে, হকার গানগুলো এখনো শ্রোতাপ্রিয়। আইয়ুব বাচ্চু তার জীবনকে গানের মাঝে গড়ে তোলার জন্য যে সংগ্রাম, আত্বত্যাগ, যে ধৈর্যের পরিচয়  দিয়েছেন তা আজও একজন সংগীত শিল্পীর জীবনীতে বিরল। একজন আইয়ুব বাচ্চু একদিনে তৈরি হয়নি, হাজার ঘাত প্রতিঘাত. ব্যর্থতা, সফলতা পিছিয়ে পড়া সবকিছুর মধ্য দিয়ে জীবন যুদ্ধে এগিয়ে গেছেন। এদেশের শ্রোতাদের ঋণী করে গেছেন।

তার অনবদ্য সৃষ্টি অসংখ্য কালজয়ী গান দিয়ে বিশেষ করে কষ্ট, সেই তুমি, নীল নয়না, ঘুমন্ত শহরে, ঘুম ভাঙ্গা শহরে, রুপালী গিটার, মেয়ে, হকার, হাসতে দেখো গাইতে দেখো, চলো বদলে যাই, মৃত্যুকাব্য, এখন অনেক রাত এই সব গানের মোহে প্রেমে পড়েনি এমন শ্রোতা খুব কমই পাওয়া যায়। সব সময়ের সব প্রজন্মের কাছে এই গান গুলোর দরদ গানের গায়কী মনকে এতো বেশি স্পর্শ করে, যেন ফিরে পাওয়া অতীতের স্মৃতিকে নাড়া দেয়।

বাচ্চু ভাই, আমার জীবনের একজন বন্ধু, বড় ভাইয়ের মতো । দুজনের সাথে দুজনের বোঝাপড়া, সর্ম্পক এতো বেশি ঘনিষ্ট ছিলো যে, প্রতিদিন কথা না বললে মনে হতো কেউ যেন পাশে নেই।

২০১৯ সালের ১৬ অক্টোবর রংপুরে ছিলো আইয়ুব বাচ্চুর শেষ কনসার্ট। জীবনের শেষ কয়েকটা দিন রোগে-শোকে ভোগায় তাকে, ছিলো গিটার জাদুকরের নতুন গিটার কেনার গল্পও। শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না বাচ্চু ভাইয়ের। তারপরও সে পাত্তা দিতো না। হাসপাতাল ডাক্তারদের কাছে থেকে দূরে থাকাই ছিলো তার একটা অনিহা। রংপুরের জীবনের শেষ কনর্সাটে আইয়ুব বাচ্চুর শেষ গান ছিল ‘‘এক আকাশ তারা তুই” মঞ্চে আরো গেয়েছিলেন ‘‘আর বেশি কাদাঁলে উড়াল দেব আকাশে” গানের কথাই যেন জীবনের সাথে মিলে গেলো, মাত্র এক দিনের ব্যবধানে তিনি যেন আকাশে উড়াল দিলেন ।

১৯৮৩ সালের এক বিকালে ৬০০ টাকা নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসা সংগীতের বরপুত্র ২০১৯ সালের ১৮ অক্টোবর অগনিত মানুষের  ভালোবাসা নিয়ে আবার ফিরে গেলেন চট্টগ্রামে নিথর নিরব দেহে। রেখে গেলেন দীর্ঘ ৩৫ বছরের অগনিত স্মৃতি। সুখে আনন্দে-গৌরবে সাফল্যে কাটানো ৩৫ বছরের মধ্যে যেমন রয়েছে, তার সংগ্রাম, তেমনি রয়েছে বেদনা, মান-অভিমান আর দুঃখ ভারাক্রান্ত না বলা অনকে অজানা কথা। মৃত্যু বার্ষিকীর এই দিনে বাচ্চু ভাইকে বিনম্র শ্রদ্ধা। হাজার হাজার  বছর বেঁচে থাকবেন আমাদের গানের ভূবনে আর আপনার সৃষ্টির  অন্যবদ্য গান দিয়ে। ওপারে ভালো থাকবেন বাংলা গানের কালজয়ী জাদুকর, ব্যান্ড সংগীতের সোনালী অর্জন আইয়ুব বাচ্চু।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!