• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫, ৩ পৌষ ১৪৩২
SonaliNews

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত নিউজ পোর্টাল

সবুজের গাঁয়ে হলুদ


নিজস্ব প্রতিবেদক ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৯, ০২:৩০ পিএম
সবুজের গাঁয়ে হলুদ

ঢাকা : রবিশস্য খ্যাত রঙিন ফসল সরিষা। এখন ভর মৌসুম। গ্রামে গেলেই চোখে পড়বে সবুজ মাঠ জুড়ে হূদয়কাড়া হলুদের অপরূপ শোভা। সরিষা সবচেয়ে রঙিন ফসল। এই মৌসুমে গ্রামবাংলায় মনপ্রাণ ভরে ওঠে। সরিষার রঙিন হলুদ ফুল প্রকৃতির সবুজ মাঠকে রাঙিয়ে দেয় গায়ে হলুদের রঙে।

শীতপ্রধান বাংলাদেশে সরিষার ব্যাপক ফলন হয়। তাই দেশের বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায় মাঠের  পর মাঠ সরিষা ক্ষেতে সবুজ-হলুদ রঙের খেলা। ক্ষেতের আঁকা-বাঁকা পথ ধরে এই হলুদ-সবুজের অবারিত প্রান্ত যেন শহরের নাগরিকদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। গ্রামপ্রেমী মানুষ শীতকালে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলে সরিষা ক্ষেতে গিয়ে ছবি তোলেন।

যেদিকেই চোখ যাবে দেখা যাবে সবুজ মাঠে শুধুই হলুদ আর হলুদ। প্রকৃতির নির্মল বাতাসে ভেসে আসে সরিষা ফুলের মাতাল করা ঘ্রাণ। এই সুবাদে কেমন যেন একটা মাদকতা আছে, যা দুর্নিবার কাছে টানে মৌমাছি ও প্রজাপতিদের।

দেশে তেলবীজ হিসেবে সরিষা ব্যবহারের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। এই ফসলটির আরো বিশেষত্ব হলো- সরিষা ক্ষেতে হলুদ রঙিন ফুলে ফুলে ছুটে আসে রঙিন প্রজাপাতি। এরা যেন প্রকৃতির এই সৌন্দর্যকে আরো ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে তোলে। সেই সঙ্গে এই মৌসুমে সরিষার জমির পাশে মৌমাছি চাষিরা সারি করে মৌ-বক্স রাখে। তাদের উদ্দেশ্য মৌমাছির মাধ্যমে মধু আহরণ। পুরো শীত মৌসুমজুড়ে মৌচাষিরা যেসব এলাকায় সরিষা চাষ হয় সেখানে অবস্থান করেন। মৌচাষিদের বক্স থেকে বেরিয়ে মৌমাছিরা ফুলে ফুলে মধু আহরণে ব্যস্ত সময় কাটায়। দলে দলে ঝাঁকে ঝাঁকে বের হয় হাজার হাজার মৌমাছি। প্রজাপতি, মৌমাছি, নানা প্রজাতির পোকামাকড় ছাড়াও সরিষা ক্ষেতের রঙিন ফুলের আকর্ষণে ছুটে আসে হলুদিয়া নীলরঙা পাখি। সবমিলিয়ে প্রকৃতির এক অপরূপ খেলা চলে এই রঙিন ফসল সরিষা উৎপাদনকে কেন্দ্র করে।

রঙ-বেরঙের প্রজাপতি আর মৌমাছি হলুদবরণ সরিষার জমিতে ভন ভন গুনগুন আওয়াজে প্রকৃতিকে মাতিয়ে তোলে। সরিষা ক্ষেতের কাছে গেলেই কানে ভেসে আসবে এমন মাতালকরা মধুর সুর। প্রকৃতির রঙ-রূপ, প্রজাপতি আর মৌমাছির ভন ভন সব মিলিয়ে সরিষার ক্ষেতগুলো যেন হলুদের সাম্রাজ্য। নিচু জমিতে সরিষার আবাদ তুলনামূলক ভালো হয়। তবে মাঝারি উঁচু জমিতেও সরিষা চাষ করা যায়। অনেক কৃষক জমি ফেলে রাখার চেয়ে উঁচু জমিতেও সরিষা চাষ করেন। সরিষা বীজ থেকে উৎপাদিত তেল রান্নার কাজে ব্যবহার করা যায়। এ তেল চাটনিতেও ব্যবহূত হয়। শিশুসহ সব বয়সী মানুষের শরীরে সরিষা তেল ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়া এর কচি পাতা ও ডগা শাক হিসেবে অনেকেই খেয়ে থাকেন। আর সরিষাবাটা ইলিশ মাছের সঙ্গে রান্না দেশের কৃষ্টির অংশ।

সরিষা উৎপাদনে ১১তম বাংলাদেশ : বিশ্ব সরিষা উৎপাদন ইনডেক্স অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান একাদশতম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে মোট ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৪৫২ টন সরিষাবীজ উৎপাদন হয়। ২০১৬-১৭ সালে ৩ লাখ ৬২ হাজার ৮৬০ টনে বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে টরি, শ্বেত ও রাই তিন ধরনের সরিষা আবাদ হয়। এসব সরিষার বিশেষভাবে প্রচলিত জাতগুলো হচ্ছে টরি-৭, সোনালি, কল্যাণিয়া, দৌলত, বারি সরিষা-৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, রাই-৫ ইত্যাদি।

মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বিশ্বব্যাপী মোট ৭ কোটি ২১ লাখ টন সরিষা উৎপাদনের কথা বলা হলেও গত মাসের সংশোধিত পূর্বাভাসে তা ৭ কোটি ৯ লাখ ২০ হাজার টনে নামিয়ে এনেছে ইউএসডিএ। ইনডেক্স মুন্ডির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বৈশ্বিক সরিষা বীজ উৎপাদনে শীর্ষস্থানে রয়েছে কানাডা। সম্মিলিতভাবে পরের অবস্থানটি দখল করে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ-২৭) দেশগুলো। তৃতীয় স্থানে রয়েছে চীন। এ ছাড়া চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ভারত ও ইউক্রেন।

সরিষার ভেষজ ও পুষ্টিগুণ : রোগের জীবাণু ধ্বংসকারী হিসেবে সরিষা তেলের এ গুণের বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এখন একমত। জার্মানিভিত্তিক এক গবেষণায়ও উঠে আসে, অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে সরিষার তেল অত্যন্ত কার্যকর। ঔষধি গুণাগুণের জন্য সুপ্রাচীনকাল থেকে আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় বহুলভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে এ তেল। সরিষায় আছে ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন-ই ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।  

অ্যান্টিবায়োটিকের অতিব্যবহারজনিত কারণে সুপারবাগের সংক্রমণ যখন বিশ্বব্যাপী চিকিৎসকদের দুশ্চিন্তার সবচেয়ে বড় কারণগুলো অন্যতম হয়ে উঠেছে, সেখানে অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প ভেষজ ওষুধ হিসেবে এর কার্যকারিতার বিষয়টি নিঃসন্দেহে স্বস্তিদায়ক। সরিষার তেলের উপাদান দেহে ফুসফুস ও অন্ত্রের জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়ার (গাট ব্যাকটেরিয়া) কোনো ধরনের ক্ষতি না করেই কিডনির মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে নিষ্কাশিত হয়। এ কারণে এ তেল বৃহদান্ত্রের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি ও হজমে সহায়ক হিসেবে বিবেচিত। রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি ও হজমশক্তি বাড়ানোতেও এটি বেশ কার্যকর। কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করার মাধ্যমে হূদরোগের ঝুঁকি কমায় সরিষার তেল। এ ছাড়া শ্বাসকষ্টের প্রদাহ কমানো, খুসখুসে কাশি, ঠান্ডা লাগা, সর্দি ইত্যাদির চিকিৎসায় সরিষার তেলের ব্যবহার সুপ্রাচীন।

জনপ্রিয় হচ্ছে সরিষা ক্ষেতে মধু চাষ : একসময় মৌচাষিরা মৌমাছির মাধ্যমে মধু আহরণে সরিষার জমিতে মৌবক্স নিয়ে গেলে কৃষকরা বিরক্ত হতেন। বাধা দিতেন। এলাকা থেকে তাড়িয়েও দিতেন। কিন্তু কৃষকের সেই ভুল ভেঙেছে। কারণ তারা দেখেছেন, সরিষার জমিতে মৌমাছির আগমন তাদের ফসলের জন্যই উপকারী। কৃষিবিজ্ঞানীদের পরামর্শ অনুযায়ী তারা এর সুফল পেয়েছেন। কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে, সরিষাসহ তৈলবীজ ও শস্যদানার যেসব ফসলে ফুল ধরে সেখানে মৌমাছির পরাগায়ণের মাধ্যমে উৎপাদন ২৫-৩০ শতাংশ বেড়ে যাবে।

কৃষি কমর্কর্তাদের মতে, সরিষার ক্ষেতে লাখ লাখ মৌমাছি ফুলে ফুলে বসে সুষ্ঠু পরাগায়ণে সাহায্য করছে। এতে সরিষার ফলন ২৫ থেকে ৩০ ভাগ বেড়ে যাচ্ছে। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রশিক্ষণ, বাজারজাতকরণের অসুবিধা দূর এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করলে উৎপাদন দ্বিগুণ করা সম্ভব। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফসলের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরাগায়ণের জন্য মৌচাষিদের অর্থ দিয়ে জমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের দেশে উল্টো জমির মালিককে টাকা দিয়ে জমি থেকে মধু আহরণ করতে হচ্ছে। এজন্য কৃষকদের সচেতন করতে জাতীয় উদ্যোগ দরকার বলে অভিজ্ঞরা মনে করেন। গত দশ বছরে কৃষি বিভাগের পরামর্শ ও প্রচারণার ফলে সরিষাসহ অন্যান্য ফসল যেমন তিল, তিষি, ধনিয়ার জমিতে মৌচাষের ব্যাপারে কৃষকদের আগ্রহ বেড়েছে।

দেখা গেছে, আগে যেসব কৃষক মৌচাষিদের বাধা দিতেন বা তাড়িয়ে দিতেন এখন তারাই মৌচাষিদের ডেকে নিয়ে তাদের অবস্থানের জন্য সবরকম ব্যবস্থাই আগ্রহের সাথে করছেন।

এ প্রসঙ্গে কৃষকবন্ধু খ্যাত কৃষিবিদ নিতাই চন্দ্র রায় বলেন, সরিষাসহ ফুল প্রধান রবিশস্য ফসলে মৌচাষের ফলে কৃষক এবং মৌচাষি উভয়েই লাভবান হচ্ছেন। আগে কৃষকদের মাঝে যে ভুল ধারণা ছিল তার অনেকটাই কেটে গেছে। তবে একই সঙ্গে মধু আহরণ ও ফসলের উৎপাদন বাড়াতে আরো প্রচারণা প্রয়োজন আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরিষা ক্ষেতে মৌমাছি চাষ করে মধু আহরণ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এর ফলে মানসম্মত মধু উৎপাদনের পাশাপাশি পরাগায়ণের মাধ্যমে বাড়ছে সরিষার ফলন।

সরিষার রাজ্য : ঢাকার কাছে সরিষা ফুলের নান্দনিক সৌন্দর্য দেখা মিলবে কেরানীগঞ্জের রোহিতপুর, মানিকনগর, সাভার, মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার সিরাজদিখান, সাতগাঁও, টঙ্গীবাড়ীর সোনারং, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার বৈদ্যেরবাজার কিংবা বারদী এলাকায়। ঢাকা থেকে দূরে সরিষার রাজ্যের দেখা মিলবে চলনবিল কিংবা যশোরের অভয়নগর। চলনবিলের সালঙ্গা, তাড়াশ, হরিণচড়া, দবিলা, কাছকাটা প্রভৃতি এলাকায় সরিষার চাষাবাদ বেশি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!