ছানোয়ার হোসেন বাদশা
সরিষাবাড়ী (জামালপুর): সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছানোয়ার হোসেন বাদশার বিরুদ্ধে ক্ষমতার দাপটে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগ উঠেছে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একটি মামলার তদন্ত চলছে। মামলার বিষয়টি স্বীকার করেছেন তিনি।
জানা গেছে, ছানোয়ার হোসেন বাদশা দীর্ঘদিন জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালে সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। এ পদে থেকে গত সাত বছরে তিনি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
স্থানীয়রা জানান, বাদশা নেতা কোটি কোটি টাকা ও সম্পদের মালিক। তার বৈধ কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। তার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ রয়েছে। তার অঢেল অর্থ-সম্পদের উৎস জানতে তদন্তে নেমেছে দুদক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছানোয়ার হোসেন বাদশা মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। অতীতে অভাব-অনটন তার পিছু ছাড়ত না। এক সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন, পান সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ। ধীরে ধীরে তার অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটতে শুরু করে। ২০১৪ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পান তিনি। কয়েক মাসের মাথায় ৮৩ লাখ টাকার বিলাসবহুল গাড়ি কিনে আলোচনায় আসেন। এ নিয়ে তখন জাতীয় একটি দৈনিকে খবরও বের হয়।
যমুনা সার কারখানা চত্বরে কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেন আন্ডারগ্রাউন্ডসহ (মাটির নিচে এক তলা) পাঁচতলা ভবনের বিপণিবিতান। এর পাশে প্রায় অর্ধকোটি টাকায় আরও আট শতাংশ জমি কেনেন বাদশা। তার বিরুদ্ধে উপজেলা সদরে আলতা সিনেমা হলের দক্ষিণে সড়কের পাশে রেলওয়ের ১২ শতাংশ জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। তবে এ জমি নিজের বলে দাবি বাদশার। এই জমির আট শতাংশের মধ্যে তিন হাজার ২০০ বর্গ ফুটের আন্ডারগ্রাউন্ডসহ ছয়তলা ভবন নির্মাণকাজ শেষের দিকে।
অভিযোগ রয়েছে, ছানোয়ার হোসেন বাদশা ক্ষমতার অপব্যবহার করে যমুনা সার কারখানায় বোতলজাত অ্যামোনিয়া গ্যাস সরবরাহ করে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। রাজনীতিকে পুঁজি করে ২০১৭ সালে সরিষাবাড়ীর ৪০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিয়ন কাম দপ্তরি নিয়োগ বাণিজ্য করে কোটি টাকার ওপর অর্থ লোপাট করেন। তারাকান্দিতে তার বাসভবনের পাশে ছামি নামে একটি রাইস মিল রয়েছে। এই মিল দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। তবুও এ মিলের নামে সরকারি চাল ক্রয় দেখিয়ে খাদ্যগুদাম থেকে প্রতি বছর অনৈতিকভাবে হাতিয়ে নিচ্ছেন অর্থ।
ছানোয়ার হোসেন বাদশা ক্ষমতাবলে ২০১৯ সালের ২০ মে সরিষাবাড়ী মাহমুদা সালাম মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতি হন। তিনি সভাপতি হওয়ার পর শিক্ষা বোর্ডের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তৎকালীন অধ্যক্ষ এমদাদুল হককে সরিয়ে দেন। তার পছন্দের শিক্ষক রমেশ চন্দ্র সূত্রধরকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেন। এরপর বিশ্বব্যাংক কলেজ শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্পে (সিইডিপি) বরাদ্দ দেয় আড়াই কোটি টাকা। কোনো কাজ না করেই সেখান থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ২২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে কলেজে নিয়োগ বাণিজ্যের জোরালো অভিযোগ ওঠে। পরে ২০২০ সালে ১০ নভেম্বর কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতি পদ থেকে পদচ্যুত হন ছানোয়ার হোসেন বাদশা। একই অভিযোগে চাকরিচ্যুত হন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রমেশ চন্দ্র, শিক্ষক হারুন অর রশিদ ও ইয়াসমিন সুলতানা।
শিক্ষক হারুন অর রশিদ বলেন, 'বিশ্বব্যাংক কলেজ শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্পে (সিইডিপি) অর্থ বরাদ্দ দেয় আড়াই কোটি টাকা। এ টাকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই। অধ্যক্ষ রমেশ চন্দ্র, কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছানোয়ার হোসেন বাদশার অপরাধের সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে কলেজ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।'
বাদশার বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে জানতে দুর্নীতি দমন কমিশনে যোগাযোগ করা হয়। টাঙ্গাইল দুদকের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা মুঠোফোনে বলেন, সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছানোয়ার হোসেন বাদশার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগের ভিত্তিতে তার সম্পদের উৎস তদন্তের কাজ চলমান রয়েছে। তদন্তের স্বার্থে নাম প্রকাশে রাজি হননি এই দুদক কর্মকর্তা।
জামালপুর রেলওয়ের আইডব্লিউ রেজাউল ইসলাম মুঠোফোনে জানান, সরিষাবাড়ী আলতা সিনেমা হলের পাশে নির্মাণাধীন ভবনের জায়গা রেলওয়ের। বড় বড় পাকা ভবন নির্মাণ করে রেলওয়ের জায়গা দখলের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।
পোগলদিঘা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা আবু রায়হান বলেন, ছানোয়ার হোসেন বাদশা ২০১৪ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। এর আগে তার এত অর্থসম্পদ ছিল না। সভাপতি হয়েই কালো রঙের দামি গাড়ি কেনেন। এ গাড়ি কেনার পর জাতীয় পত্রিকায় 'আওয়ামী লীগের সভাপতি ৯ মাসে কোটিপতি' শিরোনামে সংবাদ ছাপা হয়। এরপর বাড়ি, সার কারখানার প্রধান সড়কের জমিতে পাঁচতলা মার্কেট, উপজেলা সদরে ছয়তলা মার্কেটের কাজ চলমান। সভাপতি হয়ে অনেক সম্পদের মালিক হয়েছেন বাদশা নেতা।
সরিষাবাড়ী মাহমুদা সালাম মহিলা কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি লুৎফর রহমান বলেন, অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় কলেজে অডিট কমিটি গঠন করা হয়। এর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দুই দফা অডিট করা হয়। এ কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী কলেজের আগের পরিচালনা কমিটির সভাপতি, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও দুই শিক্ষক চাকরিচ্যুত হন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ছানোয়ার হোসেন বাদশা মুঠোফোনে বলেন, দুদকে একটি মামলা রয়েছে। মামলাটির তদন্ত চলছে। তিনি বলেন, 'আমার ব্যবসা-বাণিজ্য আছে। আমার আয়ের উৎস জানতে হলে আয়কর অফিস থেকে জেনে নিতে হবে।' সূত্র : সমকাল।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ







































