• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাজাখস্তানে জমে থাকা গণঅসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ


আন্তর্জাতিক ডেস্ক জানুয়ারি ১৪, ২০২২, ০৩:৩২ পিএম
কাজাখস্তানে জমে থাকা গণঅসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ

ঢাকা : কাজাখস্তানে তরলায়িত জ্বালানি গ্যাসের (এলপিজি) মূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ সারাদেশে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভের এ আগুনে শুধু বহু মানুষের রক্তই ঝরেনি, এতে পুড়ে ছাই হয়েছে আলমাতি শহরের বহু স্থাপনা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি কার্যত সরকারি ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতি, অনিয়মের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন ধরে জনগণের মনে জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। সেনাবাহিনী নামিয়ে, রুশ সেনাদের ডেকে এনে আপাত এ বিক্ষোভ দমন করা হলেও, তা জনগণের মন থেকে যে মুছে যাচ্ছে না, তা বলাই বাহুল্য।

এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগস্থলে অবস্থিত কাজাখস্তান। সেখানে গাড়িতে এলপিজি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। দেশটিতে চলতি বছরের প্রথম দিন এলপিজির দাম দ্বিগুণের বেশি বাড়ানো হয়। এর প্রতিবাদে পরদিন ২ জানুয়ারি দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের তেলসমৃদ্ধ প্রদেশ মানজিস্তাউয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। পরে এই বিক্ষোভ আলমাতিসহ দেশটির অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পরে। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটছে। সরকারি হিসাবে, এ পর্যন্ত ২৬ বিক্ষোভকারী ও নিরাপত্তা বাহিনীর ১৮ সদস্য নিহত হয়েছেন।

এলপিজি গ্যাসের দাম বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে যেভাবে এই বিক্ষোভ ছড়িয়েছে তাতে অনেকেই অবাক হয়েছেন। বিভিন্ন ইঙ্গিত থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, এই বিক্ষোভ নিছক জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে নয়।

এ বিক্ষোভ সহিংস রূপ ধারণ করে ৪ জানুয়ারি, যখন কাজাখস্তানের সবচেয়ে বড় শহর ও সাবেক রাজধানী আলমাতিতে হাজারখানেক লোকের সমাবেশে পুলিশ টিয়ার গ্যাস এবং স্টান গ্রেনেড ছোড়ে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। এতে বিক্ষোভকারী ও পুলিশসহ আহতের সংখ্যা কয়েকশ’ ছাড়িয়ে যায়। এরপর হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভে নেমে এলে কাজাখস্তানের বহু জায়গায় জরুরি আইন জারি করা হয়। অনেক জায়গায় ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন বা সীমিত করা হয়।

প্রেসিডেন্ট কাসিম-জোমার্ট তোকায়েভ এই বিক্ষোভের জন্য তার নিজের সরকারকেই দায়ী করে বরখাস্ত করেন। তিনি সবাইকে এলপিজির দাম কমানোর আশ্বাসও দেন; কিন্তু জনগণ তাতে শান্ত হয়নি। তারা আলমাতির মেয়রের দপ্তরে ঢুকে ভাঙচুর চালায় এবং সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয়। এখন সেই সাদা ভবনটি রং বদলে কালো হয়েছে; উড়ছে ছাই। এ ছাড়াও শহরটির বহু সরকারি দপ্তর ও সংবাদমাধ্যমে হামলা চালানো হয়।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির স্থানীয় প্রতিনিধি আবু জলিল আব্দুরাসুলফ আলমাতির বর্ণনা দিয়ে জানান, কাজাখস্তানের সবচেয়ে বড় শহর আলমাতিকে দেখলে মনে হবে, এটি যেন কেয়ামতের কোনো দৃশ্য। শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো ছিল গণবিক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে এখন সেনা ও পুলিশের রোড বেরিকেড। স্বাভাবিক অবস্থায় এই বিশাল শহরটি থাকে কর্মচঞ্চল।

সবুজে ঘেরা এ শহরে রয়েছে খানা-পিনার অঢেল ব্যবস্থা; কিন্তু এখন বহু দোকান-পাট, ব্যাংক বন্ধ। সেগুলোতে লুটপাট হয়েছে। আলমাতি শহরে ইন্টারনেট ও ফোন সংযোগ সীমিত থাকাতে বিভিন্ন গুজব বাতাসে উড়ছে। শহর স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত আসতে বেশ কিছু সময় লাগবে।

আলমাতির স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যেও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ সরকার ও সেনাবাহিনীকেই এ সহিংসতার জন্য দোষারোপ করছেন। সহিংসতা নিয়ে রাগ থাকলেও প্রতিবাদকারীদের প্রতিও রয়েছে কিছু মানুষের সহানুভূতি। এসব বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন এমন অনেক মানুষ এসেছিলেন গ্রামাঞ্চল থেকে। তাদের আয় কম এবং সংসার চালাতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন।

আবার কেউ কেউ বলছেন, রাশিয়া ও অন্যান্য দেশ থেকে সৈন্য আসাতে তারা খুশি হয়েছেন। তারা আশা করছেন, এতে হয়তো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।

ভূরাজনৈতিক সমীকরণ : কাজাখস্তানে আগে যেসব বিক্ষোভ হয়েছে তার সবাই মূলত ছিল স্থানীয় পর্যায়ে। এর কোনোটিতেই বিমানবন্দরের ওপর হামলা হয়নি। তবে এবার বিক্ষোভকারীরা বিমানবন্দর পর্যন্ত দখলে নিয়ে নেয়। রুশ সেনাবাহিনীকে হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানান প্রেসিডেন্ট কাসিম জোমার্ট তোকায়েভ।

রাশিয়ার প্রায় আড়াই হাজার সেনা কাজাখস্তানে পৌঁছায় এবং বিক্ষোভকারীদের কাছ থেকে আলমাতি বিমানবন্দরের পুনর্দখল নিতে কাজাখ সেনাদের সহযোগিতাও করে।

রুশ কর্তৃপক্ষ বলছে, সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রভুক্ত পাঁচ দেশ ও রাশিয়ার মধ্যকার সামরিক জোটের (কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন-সিএসটিও) আওতায় সাময়িকভাবে সেনা মোতায়েন করেছে তারা।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, সিএসটিও মূলত সামরিক জোট হলেও সাবেক সোভিয়েত আমলের ওয়ারশ চুক্তির সঙ্গে এর সুনির্দিষ্ট একটি মিল রয়েছে। আর তা হলো- কোনো দেশে সামরিক হস্তক্ষেপে করা না করার সিদ্ধান্তটি মূলত মস্কো নেয়।

মস্কোভিত্তিক এমজিআইএমও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের পরিচালক মাক্সিম সাচকভ কাজাখস্তানে রুশ হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন।

কাজাখস্তানে সেনা পাঠানোর ঘটনাকে ওয়ারশ চুক্তির আওতাধীন অভিযানের সঙ্গে তুলনা করতে রাজি নন তিনি। তার মতে, স্বল্পমেয়াদি এ মিশনের মধ্য দিয়ে অঞ্চলটিতে নিজেদের অবস্থান জোরালো করতে পারবে রাশিয়া।

টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট জানান, তার অনুরোধে রাশিয়া ও প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে শান্তিরক্ষী বাহিনীকে পাঠানো হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তারা অস্থায়ীভাবে কাজাখস্তানে অবস্থান করবে। রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সিএসটিওর এই বাহিনীতে প্রায় আড়াই হাজার সেনা রয়েছে। সেনা পাঠানোর জন্য রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ‘বিশেষ ধন্যবাদ’ জানিয়েছেন কাসিম তোকায়েভ।

বছরের পর বছর ধরে বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে আসছে কাজাখস্তান। রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আবার পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক বজায় রাখে কাজাখস্তান। পশ্চিমাদের সঙ্গে কাজাখস্তানের ভালো সম্পর্কে খুশি নয় মস্কো। তবে কাজাখস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট নুরসুলতান নজরবায়েভের মূল অর্জন ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ কাজাখদের সঙ্গে রুশ সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর বড় ধরনের সংঘাত না হতে দেওয়া।

অসন্তোষের দাবানল : কাজাখস্তান বিশ্বের নবম বৃহৎ দেশ; কিন্তু সেই বিবেচনায় দেশের জনসংখ্যা খুবই কম- এক কোটি ৮৮ লাখ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দেশটি ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

দেশটি যখন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অংশ, তখন ১৯৮৪ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী হন নুর-সুলতান নজরবায়েভ। তখন থেকে দীর্ঘ দিন ধরে তিনি কাজাখস্তানের শাসনক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখেন।

এরপর এক নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট হন, যে নির্বাচনে কেউ তাকে কার্যত চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। তার শাসনামলে নজরবায়েভ কাজাখস্তানে ব্যক্তিপূজা চালু করেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় তার ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। এমনকি তিনি একটি নতুন রাজধানী স্থাপন করেন এবং নিজের নামে ওই রাজধানীর নাম রাখেন নূর-সুলতান।

বহু বছর শাসনের পর নজরবায়েভ ২০১৯ সালে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। সে সময় তার বিরুদ্ধে বিরল এক গণবিক্ষোভ হয়েছিল।

ধারণা করা হয়, এই পদত্যাগের মাধ্যমে তিনি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে নিরাপত্তা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন ছিলেন। একই বছর হঠাৎ করে ডাকা এক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন নজরবায়েভের পছন্দের প্রার্থী কাসিম- জোমার্ট তোকায়েভ। ক্ষমতায় না থেকেও নজরবায়েভ ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন যে বিক্ষোভ চলছে তা মূলত নূর-সুলতান নজরবায়েভের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে বহু বছর ধরে জমে থাকা অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ। সূত্র : সাম্প্রতিক দেশকাল

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!