• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৪ মে, ২০২৪, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
পাঠ পর্যালোচনা

মৃত্যুর শিথানে ধুধু বালিচর


বঙ্গ রাখাল আগস্ট ২১, ২০২১, ০১:১০ পিএম
মৃত্যুর শিথানে ধুধু বালিচর

ছবি : প্রচ্ছদ ‘ধুধু’

ঢাকা : কবি চঞ্চল নাঈম। কবির সাথে পরিচয় ঘটে কনকর্ডে- কোন একদিন তুমুল আড্ডাতে। তিনি কবিতা চর্চা করেন- যারা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ঢেকুর তোলেন তাদের পত্রিকায়। আস্তে আস্তে কবির সাথে সম্পর্কের জায়গাটা প্রবল হয়। যেখানেই নাঈম ভাইয়ের কবিতা দেখি একটু মনোযোগ দিয়েই পড়ার চেষ্টা করি। অসিত বিশ্বাসের সাথে ‘কামালশালা’ নামে একটি পত্রিকা করার সূত্রেই চঞ্চল নাঈমের সাথে সম্পর্কটা আরো দৃঢ়তায় রুপ নেয়। ‘রাতপত্র’ নামে ২০১৯ সাথে নাঈম-এর একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। দীর্ঘদিন ধরে তিনি লেখালেখির সাথে ঘরবসতি গড়লেও প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নিতান্তই কম। এই গ্রন্থের কবিতা পড়ে-একটা কথায় চঞ্চল নাঈমের কবিতা সম্পর্কে বলা যেতে পারে-তিনি কবিতাকে হৃদয়াঙ্গম করতে পারেন এবং ইচ্ছামত শব্দকে নাড়াতে বা খেলাতে পারেন। সম্প্রতি তার প্রকাশিত হয়েছে ‘ধুধু’ নামে অন্য একটি কাব্য গ্রন্থ। এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার সাথে নিজে কিছুটা জড়িত বললেও অত্যুক্তি হবে না। থাক সে সব কথা। এই ‘ধুধু’ গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে নিজের নাম দেখে রীতিমত ভোরকে গিয়েছি বটে। তবু ভাল লাগা। এই গ্রন্থের কবিতাকে কবি তিনটি ভাগে বিন্যাস্ত করেছেন- সম্পর্কের নৈঃশব্দ্য, বুদবুদ সম্পর্ক ও মৃত্যু। কবির পুরাকাব্যগ্রন্থই যেন সম্পর্কের কঠিন বাধনে বাধা। হোক সেটা বেদনা কিংবা সুখের, মৃত্যু চেতনা কিংবা স্মৃতিকাতরতা নিজের অজান্তেই ডানাঝাপটিয়ে ওটে এবং উড়ে যাই দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে পিতার কবরের কাছে-
       বাবা তোমার সরল স্মৃতি মনে আসলে শরীরের রক্তগুলো
       মুহূর্তেই মাথা থেকে পা পর্যন্ত
       চোখের সকল পাপড়ি বেয়ে অশ্রু হয়ে ঝরে...
      কবরের পাশে প্রথম একাকী গেলাম যেদিন
      সেদিন কেন যে মনে হয়েছিল তোমার আমার সহসা সহস্র কথা হবে
     আমি কবরের পাশ থেকে অনেক ডেকেছি আর হুহু করে কেঁদেছি শুধুই...

পিতাহারা সন্তানের আহাজারি একজন সন্তান ব্যতিত কে বোঝেন তার বেদনা...বুকের মধ্যে তোলপাড় তোলে যে পিতা একদিন কোলে পিঠে করে মানুষ করে তুলেছে-সে আজ একাকিত্বে ভাসিয়ে নিজেই পাড়ি জমালেন অথৈই সাগরসমুদ্রে। 

আজ কবির সাথে পাশাপাশি বসবাস করি- রাতজাগা অসংখ্য কলহ, অন্ধ আর অন্ধকারের কাছাকাছি -তবু নিজের জীবনের একান্ত কাছাকাছি তাঁবুগাড়ে -বিচ্ছিন্নতার নিসর্গসন্তান। মা আজ নিথর- কোন ভাষা জানা নাই -তার। তাঁর বিষাদে কবির চোখেও জমে বিষাদের জল। কবি এই বিমর্ষমুহূর্তে কিছু লিখবেন না বলেও ঘোষণা দেন-তিনি যে চিন্তার থালা পেতেছেন সম্মুখে তা আজ কবি চিবিয়ে চিবিয়ে খাবেন।

কবি চঞ্চল নাঈমের কবিতা মানেই এক ধরনের বেদনা আত্মাংকার, অভিমান, বিদ্রুপাত্মকতা, দীর্ঘশ্বাস, গ্রামীণ জীবনের বিচেরীচিবানো হাসির অন্তরালে কথকথার সন্ধান যেন নাঈম ছাড়া আমাদের কেউ এই বার্তা বয়তে পারেন না। তবু হলুদপাতার হাড়গোড় ভেঙে গূঢ়মৃত্যুর আবছা অলোয় তিনি গুছিয়ে তোলেন সবুজাভ জীবন। কবির থাকে অন্তরদৃষ্টি- যে দৃষ্টি দিয়ে তিনি অবলোকন করেন সমাজকে পুঙ্খানুপুঙ্খু রুপে- এ রকম টেকনিশিয়ান হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ধীগতি সম্পন্ন কবিও দেখে নিতে পারেন সমাজের আদর্শিক বিষয়াত্মক মানুষের কৌশলীক জীবন-যাপন। তিনি গরুরুপেই- জীবনকে দেখতে চান বা সমাজকে চেনাতে চান-মানুষ এখানে উপেক্ষিত থেকে যাক। ভীষণভাবে শূন্যের মোড়কে দেখতে বা দেখাতে চান জীবনের সময় চিবিয়ে খেয়ে- আমরা হয়ে উঠি যে আস্ত এক একটা পাঠা। তারই যেন সারাৎসার চঞ্চলের কবিতা-
  বুড়ো গরুর জীবন। জাবর কাটার দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর
  কিছুই না, শূন্য
  অথচ হলদে আভা নিয়ে যে জীবন শুরু
 আজ তাও করুণ শূন্যতার মধ্যে শুয়ে জাবর কাটতে কাটতে নিশ্চুপ...

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাল্যকালেই জীবনের সাথে মৃত্যুকে গলাগলি ধরে চলতে দেখেছেন এবং নিজেও বুঝে গেছেন এদের মিলনাত্মকতার স্বরুপ। যে কারণে তিনি বলতেই পারেন-‘মরণরে তুঁহূ মম শ্যাম সমান’ । তিনি মৃত্যুর পথ হেঁটে চলতে চেয়েছেন সেই অসীমের কাছে-কবি চঞ্চল নাঈমও মৃত্যুর পাশাপাশি থাকেন। নিজের বুক পকেটে তাকে নিয়ে ঘুরে ফেলেন পথে ঘাটে কিংবা নাগরিকতার জটিল বাস্তবতার যান্ত্রিক শহরে। মৃত্যুকে কবি অস্বীকার করেন না বরং তিনি যেন নিভৃতিতে কাছাকাছি থাকার বাসনাব্যক্ত করেছেন-
   আমার নিথর দেহ থেকে মৃত্যু সুঘ্রাণ ছড়ায়
   তখন শুধুই বিছানার এক কোনে জড়োসড়ো
   মৃতের দেহের বেশে ছটাং পড়ে থাকি....

কবির নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া বাস্তবতাকেই কবিতার বাস্তবতায় বলার চেষ্টা করেছেন -
           বেদনার উল্টাপথে রক্তের ক্ষরণ...
          কিছু অনুভূতি কাঁধে নিয়ে ঘুরবো নীরবে...

কবির জীবন যেন নানাভাবে অনুসন্ধান করার প্রয়াস পেয়েছে- যেখানে এক আন্ধার জীবনের কষ্টই যেন প্রতীয়মান হয়। চাঁদের ভিতরে কবি চিত্রল বিরহ দেখেন। এই চাঁদকে যেমন সুকান্ত ভট্টাচার্য ঝলসানো রুটি দেখেছেন, যা বাস্তব হয় একজন ক্ষুধিত মানুষের জীবনে- যেখানে একজন মৃত্যুচেতনাধারী কবির জীবনেও চাঁদকে আজ বিরহের চিত্রল মনে হয়। এই কথা ভাবলে সত্যিই জীবনকে নিজের কাছে বেদনায় জর্জরিত, উৎপীড়িত-জীব মনে হয়। বুকের পিদিমে দাউদাউ করে জ্বলে বিভীষিকা-যা কবির চোখের শোলকে দাগ দিয়ে যায়। কবির কাছে আজ সবকিছু কেই যে মৃত্যুর প্রতিচ্ছবি মনে হয় যে কারণে বলেন-
  আদিম বিষণ্নে, জ্যোতিহরিণের চোখে ঝরে স্থির মৃত্যুবোধ...

কবি চঞ্চল নাঈমের এই মৃত্যুচেতনা বা মৃত্যুবোধ বাল্যজীবন থেকেই ভিতরে ভিতরে জীবনকুঠিরে বাসা বেঁধেছেন বলে তিনি জোরছে বলেন-
মৃত্যুর নৈঃশব্দ্য নিভৃতে শৈশব থেকে শুরু জমে
                  আমার শরীরে...
তার মৃত্যুর শিথানে আজ ‘ধুধু’ বালি চর- এক বিষণ্নবোধ কবির কবিতায় মাথা চারা দিয়ে উঠেছে। কবির হৃদয় ধুধু করে -সেখানে না আছে সম্পর্কের বেড়াজাল, না আছে সমাজব্যবস্থা বা জীবন উৎঘাটনের নিষ্ঠুরতার নিরঙ্কুশতার দায়বদ্ধতা। এই জীবন তো নুনহীন তিক্ত। একা ধীরে ধীরে ধাপিত করে অনিশ্চয়তার দিকে। নষ্টদের বাস কোনদিকে যাবে আমাদের গন্তব্য জানা নেই-তবু একই কথা যেতে হবে মধ্যরাত পেরিয়ে-তীব্র নির্মমতার হাজারো প্রশ্ন হৃদয়ে গুজে-চোখের কোনে জমিয়ে অশ্রু-মৃত্যু দাঁড়িয়ে সম্মুখে.

Wordbridge School
Link copied!