মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের মূল ভেন্যুতে জলবায়ু অর্থ সংক্রান্ত প্যানেল আলোচনায় বক্তব্য রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: পিআইডি
ঢাকা : ‘অর্থহীন অস্ত্র প্রতিযোগিতা’ বন্ধ করতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি চান, অস্ত্রের পেছনে দেদার খরচ না করে সেই অর্থে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য তহবিল আরো বড় হোক।
শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) জার্মানিতে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন ২০২৪ এ ‘ফ্রম পকেট টু প্ল্যানেট: স্কেলিং আপ ক্লাইমেট ফাইন্যান্স’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় তিনি প্রসঙ্গটি তোলেন।
বাসস জানায়, বক্তব্যে শেখ হাসিনা মোট ছয়টি পরামর্শ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, অর্থহীন অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে এবং এর পরিবর্তে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহের জন্য সম্পদের সংস্থান করা দরকার।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মানবতার অস্তিত্ব যখন হুমকির মুখে পড়বে, তখন সংকীর্ণ স্বার্থ রক্ষার পথ অনুসরণ করলে তা কোনো সুফল বয়ে আনবে না।
জলবায়ু তহবিল নিয়ে ছয় প্রস্তাব : প্রথম প্রস্তাবে জলবায়ু অর্থায়নের বরাদ্দ ছাড় করার সমাধান খুঁজে বের করার তাগিদ দেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোকে পরিকল্পনার ভিত্তিতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত দুই বছরে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি মেনে চলতে হবে।
২০২৫ সালের পরে নতুন ‘জলবায়ু অর্থায়ন লক্ষ্যমাত্রা’ নিয়ে একমত হওয়ার ওপরও জোর দেন প্রধানমন্ত্রী।
দ্বিতীয় প্রস্তাবে তিনি বলেন, বিশ্বকে যুদ্ধ ও সংঘাত, অবৈধ দখলদারত্ব এবং নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের বিশেষ করে নারী ও শিশুদের নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে যা গাজা ও অন্যত্র বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করছে।
নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞারও বিরোধিতা করেন তিনি। বলেন, এর প্রভাব অনেক দূরেও অনুভূত হয়।
জলবায়ু প্রভাব প্রশমন ও অভিযোজনের জন্য অর্থায়নের ‘তীব্র ভারসাম্যহীনতা’ দূর করতে অভিযোজন অর্থায়নের আকার অন্তত দ্বিগুণ করা শেখ হাসিনার তৃতীয় প্রস্তাব।
এ লক্ষ্যে বাংলাদেশকে ১ বিলিয়ন ইউরো প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে ধন্যবাদও জানান তিনি।
চতুর্থ পরামর্শে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থ প্রাপ্তি সুগম করার ওপর জোর দেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড থেকে অর্থায়ন পাওয়ার জন্য আমাদের কেবল দুটি যোগ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং আরও দুটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
পঞ্চম পরামর্শে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ঋণের বোঝা দূর করতে তাদের জন্য অনুদান ও সুবিধাজনক ঋণ লাভের সুযোগ বাড়ানোর কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
ষষ্ঠ পরামর্শে তিনি বলেন, জলবায়ু কর্মসূচি জন্য বেসরকারি পুঁজি প্রবাহে সরকারগুলোকে সঠিক পরিকল্পনা, নীতি ও ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেসরকারি পুঁজি আকৃষ্ট করার জন্য উদ্ভাবনী, মিশ্র অর্থায়নের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ ছাড়া জলবায়ু অর্থায়নের বিপুল পরিমাণ ঘাটতির কার্যকর সমাধান করা যাবে না বলেও মত দেন তিনি।
প্রতিশ্রুত জলবায়ু অর্থায়ন ‘গুরুতরভাবে অপর্যাপ্ত’ : এমন মত প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, 'জলবায়ু অর্থায়ন' এবং এর হিসাবে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞার অনুপস্থিতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
২০০৯ সালে কোপেনহেগেনে কপ-১৫ চলাকালে শেষ মুহূর্তে নেতাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে অংশ নেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করা যে বেশ কঠিন হবে, সেটি তখনই বুঝতে পেরেছিলেন।
দেশে ফিরে স্থানীয়ভাবে অভিযোজন প্রকল্প গ্রহণে ‘বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠনের উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, বাংলাদেশকে এখন স্থানীয়ভাবে পরিচালিত জলবায়ু অভিযোজনের একটি পরীক্ষাগার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশ নিজস্ব সম্পদ থেকে ৪৮ কোটি ডলার ব্যয়ে প্রায় ৮০০ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে বলেও উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, তবে আমাদের জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রতি বছর যে ৭-৮ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন তার তুলনায় এটি এখনও অপর্যাপ্ত।
জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি) অনুসারে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমনে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থায়ন প্রয়োজন বলে প্রাক্কলন করার কথাও তুলে ধরেন তিনি। বলেন, অভিযোজনের জন্য ২০৩০ সাল পর্যন্ত বার্ষিক ২১৫-৩৮৭ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। এটা সুস্পষ্ট যে, অর্থায়নের বিপুল ব্যবধান বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’ চালু করার মাধ্যমে দুবাইতে কপ-২৮ একটি ইতিবাচক যাত্রা শুরুর কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা সন্তুষ্ট যে, তহবিলের জন্য ৭৯২ মিলিয়ন ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। আমরা আশা করি যে, তহবিলে অতিরিক্ত প্রতিশ্রুত অর্থ দেওয়া হবে।”
যাদের বেশি প্রয়োজন : প্যারিস চুক্তির নীতিমালা অনুযায়ী এই তহবিল পরিচালিত হওয়ার উপরও জোর দেন শেখ হাসিনা। বলেন, তহবিল তাদের কাছে পৌঁছানো উচিত যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
অর্থ ছাড় প্রক্রিয়া আরো সহজ ও নমনীয় করার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, “আমরা আশা করি যে, তহবিলের পরিচালনা পর্ষদ এলডিসি এবং সিডস প্রতিনিধিদের মতামতের বিষয়ে যথাযথ মনোযোগ দেবে।
আমি অবশ্যই বাংলাদেশকে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডের সহায়তার প্রথম প্রাপক হিসেবে দেখতে চাই।
বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণে অবদান নগণ্য (বৈশ্বিক নির্গমনের ০.৪৭%-এর কম) হলেও জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের সপ্তম স্থানে থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “২০৫০ সাল পর্যন্ত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের বার্ষিক জিডিপি ক্ষতি হবে ২ শতাংশ। এই হারে ২১০০ সালের মধ্যে, ক্ষতি ৯ শতাংশ পর্যন্ত হবে।
আরো অনুমান করা হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের প্রায় ১৩.৩ মিলিয়ন মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হতে পারে।
জলবায়ু অভিযোজন এবং সহিষ্ণুতার জন্য জাতীয় বাজেটের প্রায় ৪.৬ শতাংশ এবং জিডিপির ০.৭৪ শতাংশ ব্যয় করার কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, এর ৭৫ শতাংশ আসে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে।
এমটিআই







































