ফাইল ছবি
সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে রবিবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ তার বিদায়ী অভিভাষণে মন্তব্য করেন, বিচার বিভাগ বিভিন্ন সময়ে অসাংবিধানিক ক্ষমতা, অপশাসন ও রাষ্ট্রীয় কপট-কৌশলের অঘোষিত সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। তিনি বলেন, অনেক বিচারক দুঃশাসনের বলয়কে আবরণ করেছেন এবং অন্যায় ও অবিচারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিচারকদের এই নৈতিক বিচ্যুতি জনসাধারণকে জুলাই-আগস্টের রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধে বাধ্য করার অন্যতম অনুঘটক।
প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, সুসজ্জিত আদালতের পরিবেশ কেবল বিচারকদের ব্যক্তিগত বিষয় নয়, এটি বিচারপ্রার্থী জনগণের মনে আস্থা সঞ্চার করে। তিনি বিচারকগণের আবাসন সংকট নিরসনের স্থায়ী পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা ও সুস্বাস্থ্যকর পরিবেশের গুরুত্বের ওপর জোর দেন। বিচারক যদি নিজেকে মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ রাখে না, তবে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও ন্যায়বোধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
বিচারব্যবস্থার প্রশিক্ষণ সংস্কৃতি নিয়ে প্রধান বিচারপতি স্বীকার করেন, চাকরিকালীন প্রশিক্ষণ কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছায়নি। আধুনিক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়তে এখনও যথাযথ উদ্যোগ নেই। তিনি অধস্তন আদালতের বিচারকদের জ্ঞান অর্জন ও পাঠাভ্যাসকে জীবনের পরম দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণের পরামর্শ দেন। বিচারকদের আধুনিক প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার নিরাপত্তা, পরিবেশ-বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন শাখায় জ্ঞান থাকা জরুরি। কারণ, জীবনের কোন স্তর থেকে কোনো বিরোধ আদালতের দ্বারস্থ হবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।
প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচারকদের জ্ঞান ও সমাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি তাদের রায় ও সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে। ধ্রুপদী সাহিত্য, দার্শনিক তত্ত্ব ও আইনের ইতিহাসে গভীর অবগাহন প্রয়োজন। লর্ড ডেনিং যেমন গণিতের ছাত্র হলেও সাহিত্য পাঠ তাকে অসাধারণ আইনি প্রজ্ঞা অর্জনে সাহায্য করেছে। তিনি বিচারকদের উদার চিন্তা, সমৃদ্ধ বোধ ও সুদূরপ্রসারী দৃষ্টির তাগিদ দেন।
তিনি সতর্ক করেন, ক্ষমতাকেন্দ্রিক বা প্রভু-ভৃত্য মানসিকতায় বিচার সেবা চললে ভবিষ্যতে বিচার বিভাগ প্রান্তিক ও অপ্রাসঙ্গিক হতে পারে। তাই বিচার বিভাগের স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও স্বাধীনতা রক্ষা করতে অসৎ ও অসাধু বিচারকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রধান বিচারপতি পৃথক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়কে কার্যকর, জবাবদিহিমূলক ও ফলপ্রসূ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিচার বিভাগের নেতৃত্ব ও প্রশাসনিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা পরবর্তী প্রধান বিচারপতির গুরুদায়। বিচারকদের প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম আয়োজন, ই-কজলিস্ট ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, ভার্চুয়াল শুনানি ও কেস ম্যানেজমেন্ট প্রকল্প গ্রহণে জোর দেন।
ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠা এবং বিদ্যমান প্রশিক্ষণ মডিউল আধুনিকায়ন করা প্রধান বিচারপতির অভিভাষণের অপরিহার্য বিষয়। তিনি বিচারক নিয়োগ পরীক্ষার সিলেবাসের কাঠামোগত দুর্বলতা চিহ্নিত করার পরামর্শ দেন। মৌখিক পরীক্ষায় সততা, বিশ্লেষণ-ক্ষমতা, বিচক্ষণতা ও ব্যক্তিত্ব যাচাইয়ের জন্য স্পষ্ট মানদণ্ড প্রণয়নের তাগিদ দেন।
প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও ধর্ম, লিঙ্গ বা নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের ভিত্তিতে বিদ্বেষমুক্ত নিয়োগ নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, বিচারকরা রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করবেন, ক্ষমতাবান শাসকশ্রেণির পক্ষে পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্ব নেওয়া যথেষ্ট নয়।
বিদায়ী অভিভাষণে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিরা, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, বার কাউন্সিল ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন এবং সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির কর্মকর্তারা।
এসএইচ







































