• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণের পথচিত্র ‘রূপকল্প-২০৪১’


অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমগীর কবীর জানুয়ারি ২৪, ২০২১, ০১:২০ পিএম
উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণের পথচিত্র ‘রূপকল্প-২০৪১’

ঢাকা : বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সঠিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়নে বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ ছিল ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি পরিকল্পনা কমিশন গঠন। গঠিত কমিশনের মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন, পরিকল্পিত উপায়ে দেশ পরিচালনা এবং দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯৭৩-১৯৭৮ সালে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দেশি-বিদেশি, স্বাধীনতাবিরোধী চক্র, সামরিক-বেসামরিক, মধ্যবর্তী, তত্ত্বাবধায়ক ও তথাকথিত গণতান্ত্রিক নানা ব্যবস্থায় দেশ পরিচালনার কারণে বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যায়নি। ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর জাতির পিতার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে এবং তাঁর নেতৃত্বে দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের চিন্তা শুরু করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য সেই পরাজিত শক্তি তার সরকারকে সুন্দর ও পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে দেয়নি। উপরন্তু তার জীবন বারবার হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।

১৯৯৮-৯৯ সালে যখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুদূরপ্রসারী রূপকল্প নিয়ে এগোচ্ছিলেন ঠিক তখনই বিএনপি-জামায়াত জোট ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা সুকৌশলে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করে। সেদিন আওয়ামী লীগের এ পরাজয়ে মূলত বঞ্চিত হয়েছেন এদেশের মানুষ সুশাসন ও মহাপরিকল্পনা থেকে। এখানে উল্লেখ্য, বিভিন্ন উন্নত দেশের ইতিহাস থেকে জানা যায়, মহাপরিকল্পনার জন্য একটি স্থিতিশীল ও দীর্ঘমেয়াদি গণতান্ত্রিক সরকার দরকার।

আওয়ামী লীগের ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারসমূহের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে পায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এদেশের মানুষকে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখান প্রথম ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমে এবং তাঁরই পরিকল্পনায় বাংলাদেশের অর্জন ও সাফল্য অবিস্মরণীয়। মানুষ ডিজিটাল বাংলাদেশের পাশাপাশি দিনবদলের সনদ, এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ, সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ, রূপকল্প-২০২১ এবং রূপকল্প-২০৪১ ইত্যাদি সম্পর্কে একটি পরিপূর্ণ ধারণা পায়। আর এই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাসমূহ করা সম্ভব হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার টানা কয়েক টার্মে ক্ষমতায় থাকায় এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত আগ্রহের কারণে। ‘ভিশন’ শব্দের অনেকগুলো অর্থের মধ্যে একটি হচ্ছে— কাল্পনিক বিষয় বা বস্তু অর্থাৎ রূপকল্প, আর ‘মিশন’ হচ্ছে বিশেষ কার্য। সহজে বোঝার সুবিধার্থে ‘ভিশন’ হলো লক্ষ্য আর ‘মিশন’ হল সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য পদক্ষেপ বা কাজ। আর্থিক দিক বিবেচনায়, ভিশন বা রূপকল্প হলো : দক্ষ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শক্তিশালী আর্থিক বাজার ও সেবা ব্যবস্থা এবং মিশন বা অভিলক্ষ্য হলো : নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী করার মাধ্যমে আর্থিক বাজার ও সেবা ব্যবস্থার মানোন্নয়ন।

২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে জাতির সামনে রূপকল্প-২০২১ বা ভিশন-২০২১-এর ধারণাটি প্রথম উপস্থাপিত হয়। দলটির পরিকল্পনায় ২০২১ সালটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর বছর এবং এই সময়ের মধ্যে বাংলদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করাও এই রূপকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য। দলটির পরিকল্পনায় উক্ত সময়ের মধ্যে দরিদ্রতা দূর করা, গণতন্ত্র ও কার্যকর সংসদ, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও জনগণের অংশগ্রহণ, সুশাসন ও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব এড়ানো, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ, নারীর ক্ষমতায়ন ও সমান অধিকার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিভিন্ন উদ্যোগ এবং বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের অবস্থান ও সুদূরপ্রসারী পররাষ্ট্রনীতি উল্লেখযোগ্য। রূপকল্প-২০২১-এ সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ যা বলতে বোঝায় কম্পিউটারের ব্যাপক ব্যবহার এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি এবং দারিদ্র্য বিমোচনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে প্রযুক্তির ব্যবহারিক আধুনিক দর্শন। ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর সাফল্যের জন্য দলটি একটি পরিবর্তিত মনোভাব, ইতিবাচক চিন্তাভাবনা এবং উদ্ভাবনী ধারণা তুলে ধরে। ডিজিটাল বাংলাদেশের দর্শনের মধ্যে রয়েছে জনগণের গণতন্ত্র নিশ্চিত করা এবং মানবাধিকার, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সর্বোপরি প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশের নাগরিকদের সরকারি সেবা প্রদান নিশ্চিত করা, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সামগ্রিক উন্নতির সাথে কোনো শ্রেণির মানুষকে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি না করা।

ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশনের চারটি উপাদানের ওপর সরকার আরো জোর দিয়েছে যা মানবসম্পদ উন্নয়ন, জনগণের অংশগ্রহণ, সিভিল সার্ভিস এবং ব্যবসায়ের তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে ব্যবহার করে। রূপকল্প-২০২১-এর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০১৫ সালের এমডিজি’র অধিকাংশ লক্ষ্যমাত্রা বিশেষ করে শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাসে ব্যাপক সফলতা পেয়েছে। এছাড়া খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, শিক্ষা ও স্যানিটেশনে দ্রুত সফলতা এসেছে। বেড়েছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও মাথাপিছু আয়। যার কারণে বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়নে বাংলাদেশ এখন নিম্ন মাধ্যম আয়ের দেশ, যেখানে মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৪৫ ডলারের ওপরে কিন্তু ৪ হাজার ১২৫ ডলারের নিচে। এদিকে দশকব্যাপী ৭ শতাংশ হারে গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনও সম্ভব হয়েছে। প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় বাংলাদেশকে রূপান্তরের জন্য ১৪টি অভীষ্ট ছিল। দশ বছর পর সেগুলোর অধিকাংশ অর্জিত হয়েছে বা ২০২০ সালের করোনা মহামারীর মধ্যেও লক্ষ্য অর্জনের পথে রয়েছে। এদিকে ২০১২ সালে দেশকে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ করার মধ্য দিয়ে দেশের অতি দারিদ্র্যের হার দ্রুত কমে আসছে। জানা গেছে, ২০২১ সাল নাগাদ দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা ২০ হাজার মেগাওয়াট ধরে উৎপাদন বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া আগামী বছরের মধ্যে নিরক্ষরতামুক্ত বাংলাদেশ গড়া, সব মানুষের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা, বেকারত্বের হার বর্তমান ৪০ থেকে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা, কৃষি খাতে শ্রমশক্তি ৪৮ থেকে ৩০ শতাংশে নিয়ে আসা, দারিদ্র্যের হার ৪৫ থেকে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে।

ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১১-২০১৫) ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৫/১৬-২০১৯/২০) বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়োজনীয় সব মানদণ্ড পূরণ করতে পেরেছে। ২০১৫ সালের এমডিজির অধিকাংশ লক্ষ্য অর্জনসহ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের শ্রেণিভুক্ত হয়েছে এবং দশকব্যাপী ৭ শতাংশ হারে গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনও সম্ভব হয়েছে। রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে মোট চারটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা থাকছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২০-২০২৫) হচ্ছে এর প্রথম এবং এই পরিকল্পনায় ডেল্টা ২১০০ প্ল্যানেরও কার্যক্রম শুরু হবে। এই পরিকল্পনায় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ এবং আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার অনুসরণ করা হয়। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে নিম্ন মধ্যম আয়ের মর্যাদা অর্জন করেছে এবং স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে প্রাথমিক উত্তরণের ভিত্তি স্থাপন করেছে।

এখন মূল্যায়ন/স্বীকৃতি সরকারের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে এবং আশা করা হচ্ছে, ২০২১ সালের মধ্যেই চূড়ান্তভাবে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন— বাংলাদেশ একদিন ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সেই স্বপ্ন পূরণ ও ‘রূপকল্প ২০২১’-এর সাফল্যের ধারাবাহিকতায় জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ‘রূপকল্প ২০৪১’ গ্রহণ করা হয়। ২০ বছর মেয়াদি সুদূরপ্রসারী এই স্বপ্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদত্ত এবং জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল কর্তৃক প্রণীত বাংলাদেশ সরকারের একটি জাতীয় কৌশলগত পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনায় বাংলাদেশের লক্ষ্য শিল্পায়নের মাধ্যমে উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি বৃদ্ধি, মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগের প্রসারকে উৎসাহ দেওয়া রূপকল্প ২০৪১-এর মূল উদ্দেশ্য।

রূপকল্প ২০৪১-এ আগামী ২০ বছরের জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এমন সব সংস্কার কর্মসূচি নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে যার ফলে সার্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন সূচিত হবে। ফলে ওই সময়ে বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ যা ২০২০ সালে ৮ দশমিক ২ শতাংশ এবং ২০৩১ সাল অবধি ৯ শতাংশ বজায় রাখা এবং জিডিপির আকার হবে ২ হাজার ৫৮০ বিলিয়ন ডলার। মানুষের গড় মাথাপিছু আয় গিয়ে ঠেকবে সাড়ে ১২ হাজার ডলারে (২০৪১ সালের মূল্যমানে ১৬ হাজার ডলারের বেশি) যা বর্তমানে ২ হাজার ৬৫ ডলার। চরম দারিদ্র্য বলতে কিছু থাকবে না অর্থাৎ তা শূন্যে নেমে আসবে। মাঝারি দারিদ্র্যও কমে আসবে ৫ শতাংশের নিচে (২০২০ সালে চরম দারিদ্র্য ও মাঝারি দারিদ্র্য যথাক্রমে ৮ দশমিক ৪৮ ও ১৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ)। সুশাসন, গণতন্ত্রায়ন, বিকেন্দ্রীকরণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি— এ চারটি প্রধান প্রাতিষ্ঠানিক স্তম্ভের কথা বলা হয়েছে রূপকল্পে, যেগুলোর মেলবন্ধন হলো উন্নত দেশের ভিত্তি। রূপকল্প সারসংক্ষেপে বলা হয় উচ্চ প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান এবং দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ে ওঠে টেকসই সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর। এ জন্য প্রয়োজন ফলপ্রসূ করব্যবস্থা ও ব্যয় সংকোচন নীতিমালা। তার সঙ্গে যোগ হয় সঞ্চয়, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা, পরিবহন, বাণিজ্য, জ্বালানি ও গুণগত বিনিয়োগ। বলা হয়, বর্তমানের কর-জিডিপি অনুপাত ৯ শতাংশ থেকে পৌঁছে যাবে ১৭ শতাংশে। ফলে বাড়বে করের পরিধি এবং পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে প্রত্যক্ষ কর বিশেষ করে আয়কর ও ভ্যাট আদায় বাড়ানো হবে। মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষকে বেশি আক্রান্ত করে তাই ২০৪১ সালে মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে রাখা হবে। বাণিজ্য কাঠামোতেও ব্যাপকভাবে পরিবর্তন আনা হবে। পোশাক খাতের মতো অন্য খাতেও প্রণোদনা দিয়ে রপ্তানি বহুমুখীকরণ শক্তিশালী করা হবে এবং রপ্তানি আয় ৩০০ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি করা হবে। উৎপাদন, বণ্টন থেকে শুরু করে জাহাজীকরণ পর্যন্ত সর্বস্তরে একটি সহজ, সুন্দর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা হবে।

বর্তমানে যেভাবে একটি শক্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তোলা হয়েছে, এ ধারা আরো শক্তিশালী করা হবে। বিনিয়োগকে রূপকল্প-৪১-এ বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে এবং বিনিয়োগ/জিডিপি অনুপাত ৪৬ দশমিক ৯ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হবে। বর্তমান ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ৯ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ১৫৩ বিলিয়ন ডলার করা হবে। এদিকে ইনফ্রাস্ট্রাকচার বিনিয়োগ ১৯০ বিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ১১৫০ বিলিয়ন ডলার করা হবে। অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়, উচ্চ রেমিট্যান্স প্রবাহ ও প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে এটা করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ২০৪১ সাল নাগাদ ৯২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সুদূরপ্রসারী ব্যবস্থা নেওয়া হবে যাতে বছরে গড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় ৪ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। নগরায়ণে ব্যাপক কর্মসূচি ও পরিকল্পনা করা হয়েছে এবং এ খাতে বিনিয়োগ কর্মসূচি জিডিপির ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ২০৩১ সালে ৫ শতাংশ এবং ২০৪১ সালে তা ৭ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হবে।

ডিজিটাল ও তথ্যপ্রযুক্তি সুবিধার ব্যাপক প্রসার ঘটানো হবে ফলে ওই সময়ে বেসরকারি খাত ও বাজারব্যবস্থা অধিকতর উৎপাদনশীল ও প্রতিযোগিতামূলক হবে। কৃষি, ম্যানুফ্যাকচারিং, স্বাস্থ্য পরিচর্যা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকস ও থ্রি ডি মেটাল প্রিন্টিং প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক বাড়ানো হবে, ফলে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান বাড়বে। ওই সময় চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে সম্ভাব্য ক্ষতির চেয়ে বরং উপকার বাড়বে ৫০ শতাংশ। একই ভাবে উৎপাদন উপকরণ থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অবদান শূন্য  দশমিক ৩ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করা হবে। কৃষিখাতের প্রবৃদ্ধির ধারা বিশেষ করে চালের উচ্চ উৎপাদন প্রবৃদ্ধিকে আরো বেগবান করা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের উন্নয়নেও বহুমুখী কার্যক্রমের কথা বলা হয়েছে রূপকল্পে। দেশ যত উন্নত হবে, ক্রমেই কমে আসবে বাণিজ্যসুবিধা এবং সে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কার্যকর পরিকল্পনা নেওয়া হবে। উচ্চ জিডিপি অর্জনে তখন নারীদের আরো কাজের সুযোগ করে দেওয়া হবে। পোশাক, পাদুকা, ইলেকট্রনিকস শিল্পে তাদের আরো বেশি কর্মসংস্থান করা হবে। একই সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ১ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা হবে এবং গড় আয়ু বাড়িয়ে ৮০ বছর করা হবে। পাশাপাশি জনসংখ্যার গুণগত মানোন্নয়ন করা হবে যাতে তা অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। তখন সাক্ষরতা হবে শতভাগ, ১২ বছর বয়সিদের জন্য সর্বজনীন অবৈতনিক শিক্ষা, সর্বজনীন সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যবীমা এবং সবার জন্য পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যাপক কার্যক্রমও নেওয়া হবে।

সরকার রূপকল্প-২০৪১-এর পথচিত্র তৈরি করেছেন দেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য। আগামী ২০ বছরের জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এমন সব সংস্কার কর্মসূচি নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে যার ফলে সার্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন সূচিত হবে। এদিকে ২০২০ সালটি মানবজাতির জন্য অনেক বেদনাদায়ক। কোভিড-১৯-এর তাণ্ডব যেমন বিশ্বব্যাপী মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে, ঠিক তেমনি অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও সীমাহীন। কোভিড-১৯-এর প্রভাব অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিরাজমান এবং এর ফলে বর্তমানে আমাদের সার্বিক অর্থনৈতিক যে সূচকগুলো আছে তা খুব একটা ঊর্ধ্বমুখী নয়। যেমন— বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, রাজস্ব আদায়, রপ্তানি বাণিজ্য, ব্যাংকিং খাত— সব মিলিয়ে অর্থনীতি চাপের মুখে রয়েছে। ফলে এর মধ্য দিয়ে রূপকল্প ২০২১ থেকে ২০৪১ কীভাবে অর্জিত হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। আমাদের রাজস্ব ব্যবস্থায় দেখা যায়, কর এখনো জিডিপির ১০ শতাংশের নিচে, ব্যাংকিং খাতও খুব একটা ভালো নেই, খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় অবকাঠামো উন্নয়ন, জ্বালানি সক্ষমতাসহ অন্যান্য খাতে ভবিষ্যতে বড় বিনিয়োগ পাওয়া নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবে আশার কথা হলো, এই বিরূপ পরিস্থিতি সত্ত্বেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ স্থিতিশীল এবং রূপকল্প-২০২১ যেমন অর্জনের পথে ঠিক তেমনি রূপকল্প-২০৪১-এর পরিকল্পনাও সম্ভব বলে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মনে করে। তবে সুদূরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে একটি স্থিতিশীল, দীর্ঘমেয়াদি সরকার এবং নেতৃত্ব দরকার।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!