• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শুরু হোক অভিভাবকের দায়-ভাবনা


মোহাম্মদ আবু নোমান জানুয়ারি ২৪, ২০২১, ০১:২৪ পিএম
শুরু হোক অভিভাবকের দায়-ভাবনা

ঢাকা : কেউ বাঘের খাঁচায় ঢুকে বলবে মামা আমাকে খেও না! এটা যেমন অবাস্তব, অগ্রহণযোগ্য তেমনি ক্ষুধার্তকে রোস্ট, পোলাও, রেজালা, কলিজা, দুধ, মিষ্টি ও মুখরোচক খাবার পরিবেশিত টেবিলের সামনে বসিয়ে বলা হবে, সাবধান, খাওয়া যাবে না! এগুলো বোকামি নয় তো কী? প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে আর মেয়ে একান্তে, আড়ালে, আবডালে, নির্জনে কাছে আসবে আর তাদের মধ্যে কোনো আদিম রিপু জেগে উঠবে না, কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটা আছে কি? কখনো খোঁজ নিয়েছেন আপনার ছেলে-মেয়ে কী দেখে? কী করে? কোথায় যায়? কার সাথে ওঠাবসা করে? কার সাথে ফোনে কথা বলে? বাবা-মা হিসেবে এসবের খবর রাখা আমাদের দায় নয় কি? এসব খোঁজ না নিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে সব দোষ ধর্ষকের। কেন সে ধর্ষণ করল! আবার কখনো ধর্ষিতার। কেন সে এখানে এলো, ওখানে গেল? সম্প্রতি রাজধানীর ধানমন্ডির মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ছাত্রী আনুশকা নূর আমিনের ধর্ষণ ও হত্যা ঘটনায় আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে, শিখতে হবে।

সরগরম সামাজিক মাধ্যম : ভাবা যায়, ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত ‘প্রেমিক’ ফারদিন ইফতেখার দিহানের পিতা-মাতা প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলন করছেন! যখন পিতা-মাতা শতভাগ নিশ্চিত, সন্তানটি অপরাধ করেছে এবং সে প্রাপ্তবয়স্ক, তাদের কি কর্তব্য যাবতীয় মিথ্যা তথ্য ও প্রমাণপত্র সংগ্রহ করে সন্তানকে অপ্রাপ্তবয়স্ক দেখানোর চেষ্টা করা? অথবা রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি এবং আর্থিক সামর্থ্য থাকায় আইন বা বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করা? কিংবা সন্তানের নৈতিক স্খলনের পক্ষে দাঁড়ানো? দিহানের বয়স কমিয়ে দেখানো, তার মায়ের অনুশোচনাহীনতা, সন্তানের পক্ষ নিয়ে নিত্যনতুন মন্তব্য সামাজিক মাধ্যমকে নানা রকম প্রশ্ন-উত্তরে সরগরম রেখেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিভাবকত্বের ব্যর্থতার জন্য দায়ী করা হচ্ছে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের শিকার কলাবাগানের স্কুলছাত্রীর পিতা-মাতাকেও। এখন প্রশ্ন ওঠা দরকার, অভিভাবকত্বের নাগরিক দায় ও দায়িত্বের বিষয়! কারণ, তারা সমাজের কাছে দায়বদ্ধ। আমরা আশা করি কলাবাগানের স্কুলছাত্রী হত্যাকে কেন্দ্র করে অভিভাবকের দায়-ভাবনা শুরু হবে।

এছাড়া মেয়ে হত্যার জন্য মামলা করেছেন আনুশকার পরিবার। কিন্তু মেয়েকে বয়ফ্রেন্ডের সাথে অবাধে মেলামেশার সুযোগ দিলেন কেন? এখন কান্নাকাটি করে আদরের সন্তানকে আর ফিরে পাওয়া যাবে কী? ছেলেমেয়েরা একসাথে খেলাধুলা করবে, গল্প করবে, গ্রুপ স্টাডি করবে, ক্লাস পার্টি/ বনভোজনের নামে ধুমধাম নেচে-গেয়ে নিজেকে উপস্থাপন করবে, প্রেম করবে, ভালোবাসবে, ডোন্ট মাইন্ড পরিভাষা প্রমোট করে সুযোগ বুঝে নির্জন স্থানে নির্লজ্জ শারীরিক খেলায় মেতে উঠবে...। গলাপানিতে খাল পার হতে বলে, বলা হবে ভিজতে পারবে না, আশ্চর্য নয় কী? এজন্য প্রয়োজন সঠিক শিক্ষা, কঠোর আইন এবং সহজ বাস্তবায়ন।

বিয়ের আগে বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড কালচার, গ্রুপ স্টাডির নামে ফ্রি মিক্সিংকে প্রমোট করা এবং অশ্লীলতা করা যদি সমাজের চোখে অবৈধ না হয়, তবে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনও তো অবৈধ হওয়ার কথা নয়! মেয়েটা যদি মারা না যেত, তাহলে এতো হুলস্থুল হতো কি? নাকি দুজনের পারিবারিক মৌন সম্মতিতে এরকম অবৈধ মেলামেশা ঘটেই চলত! ফ্রি মিক্সিং কিশোর-কিশোরীদের কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। আনবে শুধু লাশ এবং তৈরি করবে ধর্ষণের রাজ্য! সমাজে ‘মুক্তমনা চিন্তা’ নামক লাগামহীন ঘোড়া ছুটিয়ে সমাজ নামক সুন্দর ফসলি জমির ক্ষতি ছাড়া কিছুই হবে না।

অভিভাবকের দায় : আদর, ভালোবাসা দিয়ে সবসময় সন্তানকে সঠিক পথে রাখা যায় না। প্রবাদ আছে, ‘কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস।’ ‘ছোটবেলায় মানুষ কত কী করে, ম্যাচিউরড হয়নি, না বুঝে করেছে, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে’- এরকম পরিভাষা অনেক গার্জিয়ানের মুখে শোনা যায়। ছোটখাটো অপরাধের পরেও শাসনহীন পরিবেশে যে বাচ্চারা বেড়ে ওঠে, তারাই বড় হয়ে বড় অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে। কোমলমতি শিশুদের মাঝেই স্ব-স্ব ধর্মীয় মূল্যবোধ শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের এত ভালোবাসা দেয়া হয় যে, তাদের সব অন্যায় কাজকে নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়া হয়। কখনো কখনো তাদের নামে অভিযোগ আসলে সন্তানের অন্যায়ের পক্ষে ওকালতি করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হয় না। এমনও দেখা যাচ্ছে, মা তার সন্তানের অন্যায়গুলো জানা সত্ত্বেও সংসারের অশান্তির কথা ভেবে পিতার নজরে আনছেন না। ফলে তারা আশকারা পেতে পেতে মাথায় উঠে যাচ্ছে। আমাদের অক্ষমতা, অবহেলা, পক্ষপাতিত্বের কারণে এরা প্রশ্রয় পেয়ে কখন যে একটা অমানুষে পরিণত হয়েছে, তা আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। যখন বুঝেছি তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। অভিভাবকের দায় নিয়ে ভাবার সাথে রাজনৈতিক নীতিমালা, শিক্ষা নীতিমালা, সাংস্কৃতিক নীতিমালা, ইন্টারনেট নীতিমালা, বিজ্ঞাপন নীতিমালা ইত্যাদি সব নীতিমালার দায় ঠিক করতে হবে।

আইনের সংস্পর্শে আসা কিশোরদের নিয়ে কথা বলতে গিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ গত ১১ জানুয়ারি বলেন, কলাবাগানে ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রীর ক্ষেত্রে যেটি ঘটেছে, সেই ঘটনাটি ‘পূর্ণাঙ্গ ক্রাইম’। এখানে হত্যা ও ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটেছে। ওই সময় পরিবারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন বেনজীর আহমেদ। তিনি বলেন, ‘ছেলে বা মেয়ে কোথায় যায়, কী করে সেই খোঁজ অভিভাবকদের রাখতে হবে। প্যারেন্টাল কন্ট্রোল জরুরি। সন্তান জন্ম দিয়েছেন, দায়দায়িত্ব নিতে হবে। এটা পরিবারের সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব। সন্তানদের মধ্যে নৈতিকতা, মূল্যবোধ সঞ্চার করার দায়িত্ব পরিবারের, সমাজের।’ র‍্যাব সদর দপ্তরে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে কিশোরদের মধ্যে গ্যাং কালচারের বিস্তার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলেছে বলেও মন্তব্য করেন খোদ পুলিশ বাহিনীর প্রধান বেনজীর আহমেদ। আজকাল আধুনিকতা ও স্বাধীনতার নামে স্কুল-কলেজগামী ছেলেমেয়েরা যে ধরনের চলাফেরা করে তা সমাজের জন্য যে কল্যাণকর নয় তার প্রমাণ কিশোর গ্যাং, সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহার কিংবা জনপ্রিয়তার লোভের টিকটক কর্মকাণ্ড। প্রযুক্তির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে মানুষকে এগিয়ে যেতে হবে এটা যেমন সত্যি, তেমনিভাবে প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে নৈতিকতার সমন্বয় করে নিয়মনীতি মেনে পরিশীলিতভাবে জীবন পরিচালনা করাটাই হলো আধুনিকতা। এ বোধটা সন্তানকে দিতে হবে পরিবার থেকে।

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!