• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

পার্থেনিয়াম নিধনের বিকল্প নেই


আলম শাই মে ৫, ২০২১, ০৩:২১ পিএম
পার্থেনিয়াম নিধনের বিকল্প নেই

ঢাকা : পার্থেনিয়াম একটি উদ্ভিদ, একটি আগাছার নাম। যে-কোনো প্রতিকূল পরিবেশে বাঁচতে সক্ষম এই আগাছা। বিশেষ করে ফসলের ক্ষেত কিংবা রাস্তার দুধারে এ আগাছটি বেশি জন্মে থাকে। আগাছাটিকে বেঁচে থাকতে হলে কোনো ধরনের যত্ন-আত্তির প্রয়োজন পড়ে না। খুব সহজেই প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এটি উপমহাদেশীয় অঞ্চলের নিজস্ব উদ্ভিদ নয়, এসেছে মেক্সিকো থেকে। ছড়িয়ে পড়েছে গোটা উপমহাদেশে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, চীন, পাকিস্তান, নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সে সুবাদে আমাদের দেশেও এসেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বেশি নজরে পড়ে সীমান্তবর্তী জেলার রাস্তার দুধারে। এ ছাড়া দেশের অন্যান্য জেলায় কমবেশি দেখা যায়। তবে বাংলাদেশে এখনো ফসলের খেতে দেখা যায়নি। এটি ছড়িয়েছে কয়েকভাবেই। গরুর গোবর, গাড়ির চাকার সঙ্গে লেপটে, সেচের মাধ্যমে এবং জুতার তলার কাদার সঙ্গে লেপটে ছড়িয়ে পড়েছে। ছড়িয়েছে বাতাসের মাধ্যমেও। অনেকের ধারণা এর বীজ গমের মাধ্যমে আমাদের দেশে এসেছে।

এ গাছ সাধারণত এক থেকে দেড় মিটার উচ্চতার হয়। অসংখ্য শাখা; ত্রিভুজের মতো ছড়িয়ে থাকে। ছোট ছোট সাদা ফুল হয়। ঠিক যেন ধনেগাছের ফুল। হঠাৎ করে দেখলে যে কেউ ভুল করবেন ধনেগাছ ভেবে। গাছটির আয়ুষ্কাল মাত্র তিন-চার মাস। আয়ুস্কালের মধ্যে তিনবার ফুল ও বীজ দেয় গাছটি। ফুল সাধারণত গোলাকার, সাদা, পিচ্ছিল হয়। এ গাছ তিন-চার মাসের মধ্যে ৪ থেকে ২৫ হাজার বীজ জন্ম দিতে সক্ষম।

আগাছাটি অত্যন্ত ভয়ংকর। গবাদি পশু চরানোর সময় গায়ে লাগলে পশুর শরীর ফুলে যায়। এ ছাড়াও তীব্র জ্বর, বদহজমসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। আর পশুর পেটে গেলে কেমন বিষক্রিয়া হতে পারে তা অনুমেয়। বিশেষ করে গাভি পার্থেনিয়াম খেলে দুধ তিতা হয়। ওই দুধ অনবরত কেউ খেলে সেই মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে।

শুধু পশুই নয়, আগাছাটি মানুষের হাতে পায়ে লাগলে চুলকে লাল হয়ে ফুলে যায়। পাশাপাশি ত্বক ক্যানসার সৃষ্টি করে। আক্রান্ত মানুষটির ঘনঘন জ্বর, অসহ্য মাথাব্যথা ও উচ্চরক্তচাপে ভুগতে থাকে। এমনকি মারাও যেতে পারেন মানুষটি। গণমাধ্যম মারফত জানা যায়, ভারতের পুনেতে পার্থেনিয়ামজনিত বিষক্রিয়ায় ১২ জন মানুষ মারা গিয়েছিলেন কয়েক বছর আগে। এতসব ভয়ংকর বিষয়াদি জানতে পেরে পরিবেশবিদরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। আতঙ্কিত হয়েছেন উপমহাদেশের কৃষিবিদরাও।

কৃষিবিদরা এ আগাছা নিয়ে বেশ শঙ্কিত। তারা এটিকে বিষাক্ত আগাছা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এটি শুধু বিষাক্তই নয়; যে-কোনো ধরনের ফসলের ব্যাপক ক্ষতিও করে। প্রায় ৪০ শতাংশ ফসল কম ফলে যদি কোনো ক্ষেতে পার্থেনিয়াম বিস্তার করে। এসব ক্ষতিকর দিকগুলো পর্যালোচনা করে কৃষিবিদরা গাছটিকে পুড়িয়ে ফেলতে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। সতর্ক না হলে যে-কোনো ব্যক্তি বিপদের সম্মুখীন হতে পারেন। যেমন, এটি কেউ কাটতে গেলে ওই ব্যক্তির হাতে-পায়ে লাগতে পারে। পোড়াতে গেলে ফুলের রেণু দূরে উড়ে বংশ বিস্তার ঘটাতে পারে। আবার ব্যক্তির নাকে, মুখেও লাগতে পারে। তাতে করে তিনি মারাত্মক বিষক্রিয়ায় পড়তে পারেন। এ ক্ষেত্রে খুব সতর্কতার সঙ্গে প্রথমে গাছটিকে কাটতে হবে। হাতে গ্লাভস, চোখে চশমা থাকলে ভালো হয়। অবশ্যই পা ভালোমতো ঢেকে রাখতে হবে। মোটা কাপড়ের প্যান্টের সঙ্গে বুটজুতা পরা যেতে পারে, সঙ্গে মোটা কাপড়ের জামাও পরতে হবে।

গাছকাটা হলে গভীর গর্তে পুঁতে ফেলতে হবে। এ ছাড়া রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় আগাছানাশক ব্যবহার করে এ গাছ দমন করা যায়। সে ক্ষেত্রে ডায়ইউরোন, টারবাসিল, ব্রোমাসিল অধাকেজি পাঁচশ লিটার জলে মিশিয়ে হেক্টর প্রতি প্রয়োগ করতে হবে। আবার প্রতি হেক্টরে দুই কেজি ২.৪ সোডিয়াম লবণ অথবা এমসিপি ৪০০ লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করেও এ আগাছা দমন করা যেতে পারে। যেমনটি নিধন করছেন পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার তরুণরা। আমরা দেখেছি বাঁকুড়া জেলার তরুণরা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে রাস্তার দুধারে সোডিয়াম মেশানো জল স্প্রে করে পার্থেনিয়াম নিধন করেছেন। তারা সরকারের সাহায্যের আশায় বসে থাকেননি, নিজেরাই উদ্যোগ নিয়েছেন পার্থেনিয়াম নিধন করতে। সাধুবাদ জানাতে হয় তাই এই যুবাদেরকে। এই শিক্ষাটি গ্রহণ করা উচিত বাংলাদেশের যুবকদেরও।

কৃষিবিদদের অভিমত পার্থেনিয়াম নিধনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হচ্ছে জৈবিক প্রক্রিয়ায় দমন করা। তাতে করে নাকি ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এই পদ্ধতিতে নানা ধরনের পাতাখেকো অথবা ঘাসখেকো পোকার মাধ্যমে পার্থেনিয়াম দমন করা সম্ভব। কিন্তু সে ক্ষেত্রে কিছু বিপত্তি আমরা লক্ষ করেছি। যেমন, পাতাখেকো পোকার বিস্তার ঘটানো যখন-তখন সম্ভব হয় না। বিশেষ করে স্বল্প সময়ের মধ্যে উদ্ভিদটি বিনাশ করতে না পারলে সমস্যাটি থেকেও যায়। কারণ এই উদ্ভিদের ফুল ও বীজ অল্প সময়ের মধ্যেই পরিপক্ব হয়। পাতাখেকো পোকা অল্প সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে সাবাড় করতে না পারলে বীজ হাওয়ায় উড়ে অনেক দূর চলে যাবে। সুতরাং সেই দূরদর্শী বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে আমাদের।

পার্থেনিয়াম নিয়ে বাংলাদেশের জন্য সামান্য সুখবর আছে। সুখবরটি হচ্ছে বাংলাদেশে এখনো পার্থেনিয়ামের বিষক্রিয়ায় কেউ আক্রান্ত হননি। পশ্চিমবঙ্গেও তদ্রূপ হয়তোবা। আবার গবাদি পশুর ব্যাপারেও সে ধরনের উদ্বেগজনক খবর আমাদের কানে এসে পৌঁছায়নি। কাজেই আমাদের উচিত এখুনি সতর্ক হওয়া। যেসব স্থানে অথবা জেলায় পার্থেনিয়ামের সন্ধান পাওয়া গেছে সেখানে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে কৃষকদের অবহিত করা এবং আগাছাটি নিধনের জন্য পরামর্শ দেওয়া। তাতে করে এই বিষাক্ত আগাছা থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে।

পার্থেনিয়াম সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য রয়েছে, যা না জানালেই নয়। আগাছাটি মানুষ এবং গবাদি পশুর যেমন ক্ষতি করে, তেমনি আবার উপকারও করে। এর রয়েছে কিছু ঔষধি গুণ। এই আগাছা থেকে মানুষের প্রচণ্ড জ্বর, বদহজম, টিউমার, আমাশয়সহ নানা ধরনের জটিল রোগের প্রতিষেধক তৈরি হচ্ছে। এমনকি গবেষকরা মরণব্যাধি ক্যানসারেরও প্রতিষেধক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে আমরা ধরে নিতে পারি, উপকার এবং অপকার—দুটিতেই সক্ষম পার্থেনিয়াম। তাই বলে যত্রতত্র এ আগাছার বংশ বিস্তার কারো কাম্য নয়। ওষুধের প্রয়োজনে সংরক্ষিত এলাকায় এটি চাষাবাদ হতে পারে কিন্তু সেটি এতদঞ্চলের জন্য মোটেই নিরাপদ নয়। সুতরাং আমরা এটিকে নিধন করাই শ্রেয় মনে করি। আমাদের কৃষকদেরও সেই পরামর্শ দেব আমরা আশা করি। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে কাউন্সেলিং করতে হবে ব্যাপকভাবে। তবেই পার্থেনিয়াম থেকে রেহাই পাওয়া যাবে; অন্যথায় এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে উপমহাদেশীয় অঞ্চলে। যেমন, ছড়িয়েছে ব্রাজিল থেকে আগত কচুরিপানা। এটি এখন উপমহাদেশের অধিকাংশ জলাশয় গ্রাস করে নিয়েছে। সুতরাং আমরা পার্থেনিয়াম নিয়ে ভাবি, না হলে এডিস মশার মতো এর বিস্তার দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। তখন সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়তে পারে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, পার্থেনিয়াম উদ্ভিদ অনেকেই চেনেন না, ফলে আগাছাটি সম্পর্কে কৃষিবিদদের কড়াকড়ি বা সতর্কতা জারি করা সত্ত্বেও এই উদ্ভিদের ফুল বাংলাদেশের বিভিন্ন দোকানে বিক্রি হচ্ছে। সেই খবরও আমরা গণমাধ্যম মারফত জানতে পেরেছি। মূলত মারাত্মক এই ফুলগুলো সম্পর্কে দোকানি না জেনেই দোকানে বিক্রির জন্য সাজিয়ে রেখেছেন। আর ক্রেতাও না জেনে সেই ফুল কিনে মৃত্যুর সঙ্গে আলিঙ্গন করছেন। তাই এখুনি সতর্ক হতে হবে আমাদের। ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে পার্থেনিয়াম চেনাতে হবে আমজনতাকে। নচেৎ এক সময় আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে মহামারীর দিকে মোড় নিবে। কাজেই সময় থাকতে আমরা সাবধান হই। অতিমারী (কোভিড-১৯) থেকে শিক্ষা নিয়ে বিষয়টির মোকাবিলা করি দ্রুত। তাতে আমরা নিজেরাও যেমন নিরাপদ থাকতে পারব, তেমনি ফসলাদিও নিরাপদে রাখতে পারব, পরিবেশের ভারসাম্যও বজায় থাকবে। সুতরাং দেরি না করে দ্রুত পার্থেনিয়াম নিধন করি।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীবিষয়ক লেখক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!