• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
ডিজিটাল অর্থনীতি

তৈরি হচ্ছে নতুন বাংলাদেশ


এস এম মুকুল মে ৫, ২০২১, ১১:৪০ পিএম
তৈরি হচ্ছে নতুন বাংলাদেশ

ঢাকা : দেড় দশক আগে ডিজিটাল শব্দটির সাথে আমাদের খুব একটা পরিচয় ছিল না। বাংলাদেশ তখনো প্রযুক্তির কানাগলিতে ঘুরছে। কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মোবাইল, অনলাইন, ইকমার্স, নেট-টু-ফোন, ফেসবুক, গুগল, ইয়াহু প্রযুক্তি জগতের এসব মাধ্যমে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল। ২০০০ সাল থেকে প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ঝোঁক বেড়ে যায়। বিশেষত তরুণ প্রজন্ম সিরিয়াস হয়ে উঠে প্রযুক্তির ব্যবহারের প্রতি। প্রযুক্তি শিক্ষার জোয়ার বইছিল সে সময়টায়। তখন ওয়েবসাইট, ইপেপার, ব্যাংকগুলোর বুথ সার্ভিস বিকশিত হতে থাকে। তরুণ প্রজন্ম ইকমার্স, আউটসোর্সিয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। প্রযুক্তির সাথে পথ চলতে শুরু করে অন্য এক বাংলাদেশ। ২০০৮ সালে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ধারণাকে সামনে নিয়ে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের ঘোষণা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার একটি দূরদর্শী চিন্তার ফসল, যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদের দিকনির্দেশনায় সফলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে যখন জননেত্রী শেখ হাসিনা দিনবদলের সনদ রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। এ রূপকল্পের মূল বিষয়ই ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ। এর মূল লক্ষ্য তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ও ডিজিটাল অর্থনীতি গড়ে তোলা। তখনো দেশের মানুষ ডিজিটাল বিষয়টির সাথে তেমন পরিচিত ছিল না। এই ঘোষণার পর থেকেই থেকেই তরুণ প্রজন্মের মাঝে ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে ভাবনা শুরু হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ থিওরির প্রবক্তা প্রযুক্তিবিদ সজীব ওয়াজেদ জয় তরুণ প্রজন্মের মাঝে প্রযুক্তি বিকাশের স্বপ্নবীজ বুনে দেন। তারপর থেকেই থ্রিজি, ফোরজির মাধ্যমে ডিজিটাল অর্থনীতির দিকে ধাবিত হয় বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের তরুণদের প্রযুক্তিবিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ে আরো উদ্বুদ্ধ করতে পারলে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রযাগ্রা আরো সহজ হবে। একই সঙ্গে, এ জনসম্পদকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ডিজিটাল অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে বাংলাদেশ।

ডিজিটাল অর্থনীতি কী : একসময় আমাদের এই পৃথিবীর সব দেশই ছিল কৃষিভিত্তিক। তারপর কৃষিভিত্তিক সমাজ ভেঙে হলো শিল্পভিত্তিক সমাজ। শিল্পভিত্তিক সমাজ থেকে সেবা ও তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক অর্থনীতির বিকাশ হলো। সমাজ বিকাশের ধারায় উৎপাদনশীলতা হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। উৎপাদনশীলতার কারণে সমাজ ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন এসেছে। প্রথমে যন্ত্র, তার পরে বিদ্যুৎ এবং তারও পরে ইন্টারনেট উৎপাদন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করেছে। এরপর উৎপাদন ব্যবস্থায় আসছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। ডিজিটাল অর্থনীতি হচ্ছে মেধাভিত্তিক উৎপাদনশীল একটি অর্থনীতি যার ভিত্তি হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। কৃষি, শিল্প-বাণিজ্য, সেবা খাতকে বাদ দিয়ে কাগজে-কলমে তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক সমাজের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নাম ডিজিটাল অর্থনীতি নয়। ডিজিটাল অর্থনীতি হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে গড়ে তোলা মেধাভিত্তিক উৎপাদনশীল অর্থনীতি। কেউ কেউ একে সৃজনশীল অর্থনীতিও বলেন।

উন্নয়নশীল অর্থনীতি ও ডিজিটাল ইকোনমি : ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে যুগান্তকারী ডিজিটাল বিপ্লবের ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর আইসিটিবিষয়ক উপদেষ্টা, বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রচেষ্টায়, সরকারের সফল ডিজিটালাইজেশনের ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মোবাইল ইন্টারনেটের পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়ছে ব্রডব্যান্ড সেবাও। এতে বিভিন্ন বৈশ্বিক প্ল্যাটফরমে যুক্ত হয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে আয়ের পথ সহজ হয় দেশের তরুণ-তরুণীদের। ডিজিটাল ইকোনমির অন্যতম মূল সক্ষমতা মোবাইল ইন্টারনেট। অসংখ্য মানুষের হাতে স্মার্টফোন এবং ক্রমবর্ধমান হারে এর সংখ্যা বাড়ছে। দেশে বর্তমানে ১৫.৭০ কোটি মোবাইল সংযোগ আছে এবং অন্তত ১০ কোটি লোক মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। এখন প্রায় ১০ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে, যা ডিজিটাল অর্থনীতির সবেচেয়ে সম্ভাবনাময় দিক। নগদহীন সমাজ গঠনে সরকারের নিরলস প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিটি দেশে ডিজিটাল পেমেন্ট গ্রহণযোগ্যতার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধির সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। মোবাইল ব্যাংকিং থেকে ডিজিটাল ওয়ালেটে রূপান্তরের কাজও বর্তমানে চলছে। এতে করে ঘরে বসেই কেনাকাটা, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ, টিকিট কেনা, হোটেল বুকিং ইত্যাদি সব আর্থিক কার্যক্রম সহজে করা যাবে। আলিবাবার নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট মিং জং স্মার্ট ‘বিজনেস : হোয়াট আলিবাবা’স সাকসেস রিভিলস অ্যাবাউট দ্য ফিউচার অব স্ট্র্যাটেজি’ বইয়ে ব্যাখ্যা করেছেন, ই-কমার্স ও পেমেন্ট প্লাটফরম, বিশেষ করে চীনে একক প্ল্যাটফরম থেকে ব্যাপকভাবে প্রবেশযোগ্য ডিজিটালি সক্রিয় ইকোসিস্টেমকে বিকশিত করেছে। এর মাধ্যমে প্রবেশের বাধাগুলো প্রশমন হয়েছে, বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসার ক্ষেত্রেও ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে। এ ধরনের বাজারের পরিসর প্রথাগত বাজারের চেয়ে অনেক বেশি এবং যা কোনোভাবেই ভূগোল দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। এ ছাড়া নতুন ব্যবসায়িক মডেলের জন্য সম্পূরক সুবিধাগুলো সহজলভ্য হওয়ায় অপেক্ষাকৃত সহজেই প্ল্যাটফরমের উন্মুক্ত অবকাঠামোর সঙ্গে এর সমন্বয় করা সম্ভব হয়।

গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ডিজিটাল পদ্ধতি : ডিজিটাল অর্থনীতি বুঝতে হলে আমাদের অর্থনীতির রূপান্তর সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। একসময় আমাদের এই পৃথিবীর সব দেশেই ছিল কৃষিভিত্তিক। তারপর কৃষিভিত্তিক সমাজ ভেঙে হলো শিল্পভিত্তিক সমাজ। শিল্পভিত্তিক সমাজ থেকে সেবা ও তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক অর্থনীতির বিকাশ হলো। সমাজ বিকাশের ধারায় উৎপাদনশীলতা হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। উৎপাদনশীলতার কারণে সমাজ ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন এসেছে। ডিজিটাল অর্থনীতি হচ্ছে মেধাভিত্তিক উৎপাদনশীল একটি অর্থনীতি। দেশের উন্নয়নে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ‘ডিজিটাল অর্থনীতি’। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, আউটসোর্সিংয়ের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক খাতে নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি রচিত হচ্ছে। শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি, নারীদের কর্মসংস্থানেও অনন্য অবদান রাখছে এই ইন্টারনেটভিত্তিক অর্থনীতি। প্রযুক্তির কল্যাণে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আসছে বিপুল জনগোষ্ঠী ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের সম্প্রসারণে দেশের অর্থনৈতিক গতি সম্প্রসারিত হচ্ছে। করোনা মহামারী এ প্রযুক্তিকে আরো গতিশীল করেছে। ছয় মাস ধরে গ্রাহকরা নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্যাংকিং সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। লকডাউনেও গ্রাহকরা ব্যাংকে না গিয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে সেবা নিতে পেরেছে। ব্যাংকগুলো করোনায় মহামারীতেও তাদের অনেক শাখা খোলা রেখেছে। সেবা দিতে গিয়ে অনেক ব্যাংকার করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, নিহতও হয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির কারণে ব্যাংকবহির্ভূত বিপুল জনগোষ্ঠী ব্যাংকিং সেবার আওতায় এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, জুলাইয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে ৬২ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা। করোনা মহামারিতে রপ্তানিমুখী শিল্পের ২৬ লাখ শ্রমিককে চার মাসের বেতন ভাতা দেওয়া হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিয়ের মাধ্যমে। প্রণোদনার অর্থ বিতরণেও মোবাইল ব্যাংকিং বড় ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা যায়, বর্তমানে দেশে তফসিলি ব্যাংকের সংখ্যা ৬০। এসব ব্যাংকের শাখা রয়েছে ১০ হাজার ৫৮৩টি। ২০০৯ সালে ব্যাংকের শাখা ছিল ৭ হাজার ৩২৭। গত এক দশকের ব্যাংকের শাখা বেড়েছে ৩ হাজার ২৫৬টি। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় শুধু শাখা বৃদ্ধি নয়, বরং ব্যাংকগুলোর আমানতও বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক গুণ। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে ভূমিকা পালন করছে এজেন্ট ব্যাংকিং। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে এ সেবা চালু হয়েছে ২০১৩ সালে। গ্রামের বিশাল জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনার অন্যতম মাধ্যম হলো এজেন্ট ব্যাংকিং। ব্যাংকগুলো এখন তাদের শাখা না বাড়িয়ে এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট আর বুথের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হিসাব খোলা, টাকা জমা ও উত্তোলন, রেমিট্যান্স গ্রহণসহ ছোট ছোট বিনিয়োগের অর্থ দেওয়া হচ্ছে। ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ সহজেই ব্যাংকিং সেবার সাথে যুক্ত হচ্ছে। আশার খবর হচ্ছে. ভবিষ্যতে প্রযুক্তির উৎকর্ষতার মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবাকে আরো উন্নততর করায় সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এটা অর্থনীতির চাকাকে আরো গতিশীল ও মজবুত করতে সাহায্য করবে।

আউটসোর্সিং বাজারে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ : বিশ্বে ডিজিটাল আউটসোর্সিংয়ের জন্য এক জনপ্রিয় নামে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ‘ডিজিটাল অর্থনীতি’ কীভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে রূপান্তরিত করছে তা তুলে ধরেছে। ফ্রিল্যান্সিংয়ের মধ্যে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং থেকে শুরু করে ওয়েব ডিজাইন, ট্যাক্স প্রস্তুতি এবং সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশানের মতো প্রায় সব কাজই অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং পেশা দিনকে দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিগত কয়েক বছরে দেশের অর্থনীতিতে ফ্রিল্যান্সারদের অবদান লক্ষণীয়। দেশের বার্ষিক আয়ের এক উল্লেখযোগ্য অংশ আসে তাদের কাজের মাধ্যমে। বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর ফ্রিল্যান্সররা ১০ কোটি ডলার আয় করে থাকেন। শ্রমব্যয় কম থাকায় বিশ্বের আউটসোর্সিং বাজারে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে বাংলাদেশ।  স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখতে এখান থেকে ভালো আয় করার সুযোগ রয়েছে। দ্রুতগতিতে বাংলাদেশে ডিজিটাল রূপ লাভ করায় শহরে ইন্টারনেট সুবিধা, সরকারি-বেসরকারি প্রচারণায় এই খাত ধীরে ধীরে সবার কাছে পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, অনলাইন কর্মী সরবরাহে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। এখানে নিয়মিত কাজ করছে ৫ লাখ ফ্রিল্যান্সার। আর মোট নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা ৬ লাখ ৫০ হাজার। একেক দেশ একেক বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে এই পেশা নিয়ে কাজ করছে। যেমন ভারতীয় ফ্রিল্যান্সারদের দক্ষতা প্রযুক্তি ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট। আর বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা মূলত সেলস ও মার্কেটিং সেবায় পারদর্শী। ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৪ কোটি ৪০ লাখ তরুণদের প্রতি ১০ জনের একজন বেকার। প্রতি বছরই বিশ্ববিদ্যালয় পেরোনো হাজার হাজার শিক্ষার্থী মনের মতো চাকরি না পেয়ে বেকার হয়ে বসে আছেন। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে। তবে খুব সহজেই আইটি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করার সুযোগ রয়েছে তাদের সামনে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওই নিবন্ধে আশা প্রকাশ করা হয়েছে, এতে করে তারা শুধু নিজের জীবিকাই নিশ্চিত করবে না, বরং দেশে অনেক বৈদেশিক মুদ্রাও অনবে সমর্থ হবে যা ‘নতুন বাংলাদেশ’র অর্থনৈতিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। তথ্যপ্রযুক্তি সেবা নিশ্চিতে সরকার প্রতি জেলায় আইসিটি পার্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। এখানে শ্রমব্যয় কম থাকায় বিশ্বের আউটসোর্সিং বাজারে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে বাংলাদেশ। তবে এখনো বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে বাংলাদেশের। সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট। ফ্রিল্যান্সিংয়ে এমন সফটওয়্যারে কাজ করতে যেখানে মনোযোগ খুবই জরুরি। সেখানে বিদ্যুৎ চলে গেলে কাজের ক্ষতি হয়।  এ ছাড়া ইন্টারনেট সেবার মান নিয়েও অভিযোগ রয়েছে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের মূল্যও অনেক বেশি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা ফ্রিল্যান্সারদের জন্য এটা অনেক বড় সমস্যা। ব্র্রডব্যান্ড সুবিধা থাকলেও অনেক সময় তা ধীরগতির হয়। আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে টাকার সহজ লেনদেনের ব্যবস্থা। বিশেষ করে বিদেশ থেকে টাকা নেওয়ার ক্ষেত্রে সহজ কোনো উপায় নেই। আর নারী ফ্রিল্যান্সারদের সংখ্যা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেলেও এখনো তা যথেষ্ট নয়। বিভিন্ন বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যাদের বিশাল একটি তরুণ জনগোষ্ঠী আছে। ১৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশেরই বয়স ২৫ বছরের নিচে। এই বিশাল তরুণ ও শক্তিশালী জনসম্পদ এখনো এই ফ্রিল্যান্স বাজারের সম্ভাবনা নিয়ে পুরোপুরি অবগত নয়। বিগত বছরগুলো ফ্রিল্যান্সিং জনপ্রিয় হলেও  এখনো বাংলাদেশের হাজার হাজার তরুণদের এটা নিয়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। এই সুযোগ যেন তারা ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারে সেজন্য প্রয়োজন সরকারি সহযোগিতা। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের তরুণরা ফ্রিল্যান্সিংয়ে ভালো কাজ করছে। তাই আশা করা যায়, এতে তারা নিজেদের জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থান আরো মজবুত করবে। এখানে কাজের মাধ্যমে তারা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে ‘নতুন বাংলাদেশে’র ডিজিটাল অর্থনৈতিক ভিত্তিকে আরো মজবুত করবে।

অবারিত সম্ভাবনার হাতছানি : বাংলাদেশের উন্নয়নে বড় ধরনের অবদান রাখতে শুরু করেছে ‘ডিজিটাল অর্থনীতি’। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এই ইঙ্গিত করা হয়েছে। আবার বাণিজ্যবিষয়ক পত্রিকা ফোর্বস-এর তথ্যমতে, ফ্রিল্যান্সিং থেকে আয়ে এগিয়ে থাকা শীর্ষ ১০ দেশের  মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। ফ্রিল্যান্সিং আয়ে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম এবং বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২৭ শতাংশ। বিশ্বে বছরে এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার রয়েছে আউটসোর্সিংয়ে। বাংলাদেশে এই খাতে আয় ১ বিলিয়ন হলেও, সম্ভাবনা আছে ৫ বিলিয়ন ডলারের। কিন্তু এই ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্য পূরণ করতে ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা ৫ গুণ বৃদ্ধি করতে হবে। সেই ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়কে এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আজাজ জামানের লেখা ওই নিবন্ধে আভাস দেওয়া হয়েছে, আউটসোর্সিং-এর মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক খাতে নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি রচিত হচ্ছে। শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি নারীদের কর্মসংস্থানেও অনন্য অবদান রাখছে এই ইন্টারনেটভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং। এ ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোও বাংলাদেশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে শুরু করেছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের লেখা ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে, ডিজিটাল অর্থনীতিতে দুর্দান্ত অবদান রাখতে শুরু করেছে উন্নয়নশীল দেশগুলো; যেখানে প্রশ্নাতীতভাবে এশিয়া এগিয়ে রয়েছে। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, অনলাইন শ্রমশক্তির সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী হচ্ছে ভারত; যাদের প্রায় ২৪ শতাংশ গ্লোবাল ফ্রিল্যান্সার ওয়ার্কার আছে। এর পরের অবস্থানটিই বাংলাদেশের, অনলাইন শ্রমশক্তিতে যাদের অবদান হচ্ছে ১৬ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যাদের ফ্রিল্যান্সার হচ্ছে ১২ শতাংশ।

উদীয়মান অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ : মাস্টারকার্ড টাফটস ইউনিভার্সিটির দ্য ফ্লেচার স্কুলের সঙ্গে অংশীদারির মাধ্যমে ডিজিটাল ইনটেলিজেন্স ইনডেক্স (ডিআইআই) বা ডিজিটাল বুদ্ধিমত্তা সূচক প্রকাশ করেছে। বিশ্বের ৯০ দেশের ডিজিটাল ইভলিউশন বা প্রযুক্তির বিকাশের ক্ষেত্রে ১৬০টি নির্দেশক মূল্যায়ন করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এর মধ্যে চারটি প্রধান স্তম্ভ হলো : প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ, চাহিদার অবস্থা, সরবরাহ ব্যবস্থা এবং উদ্ভাবন ও পরিবর্তনের সক্ষমতা। এতে ডিজিটাল অগ্রগতি বিবেচনায় এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে চার ভাগে ভাগ করা হয়। স্ট্যান্ড আউট, স্ট্যাল আউট, ব্রেক আউট এবং ওয়াচ আউট। এতে ব্রেক আউট বা উদীয়মান অর্থনীতির অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম উঠে আসে। এই তালিকায় আরো রয়েছে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বাংলাদেশ, কেনিয়া, ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনাসহ আরো কিছু দেশের ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার অনেক দেশের জন্য রোল মডেল হয়ে উঠেছে। ওই দেশগুলো দেখছে কীভাবে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো জোরালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। ’

এগিয়ে যাও বাংলাদেশ : বাংলাদেশের উন্নয়নে বড় ধরনের অবদান রাখতে শুরু করেছে ইন্টারনেটভিক্তিক আয় করা এই ‘ডিজিটাল অর্থনীতি’। বিশ্বে আধুনিক অর্থনীতির জয়ের শোভাযাত্রায় পিছিয়ে নেই দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশও। ডিজিটাল অর্থনীতি বিকাশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ২০১০ সালে সারা দেশে একযোগে সাড়ে চার হাজার ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার চালু করা হয়। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, কোনো দেশে যদি ১০ শতাংশ ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারকারী তৈরি হয়, তবে সেই দেশের জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি এক দশমিক তিন শতাংশ বাড়ে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আভাস দেওয়া হয়েছে, আউটসোর্সিং-এর মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক খাতে ধীরে ধীরে নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি রচিত হচ্ছে। শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি নারীদের কর্মসংস্থানেও অনন্য অবদান রাখছে এই ইন্টারনেটভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং। এ ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোও বাংলাদেশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে শুরু করেছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বেকার তরুণদের প্রযুক্তিবিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ে উদ্বুদ্ধ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তারা বলছে, এতে করে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন আরো বাস্তব হতে শুরু করবে। জনসম্পদকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ডিজিটাল অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে বাংলাদেশ।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!