• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার থাবায় সংকটে পোশাকশ্রমিকরা


মো. তাহসীনুল হক মে ৭, ২০২১, ০৪:১৫ পিএম
করোনার থাবায় সংকটে পোশাকশ্রমিকরা

ঢাকা : সম্প্রতি ‘দি উইকেস্ট লিঙ্ক ইন গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন :  হাউ দ্য প্যান্ডেমিক ইজ অ্যাফেক্টিং বাংলাদেশ গার্মেন্ট’ বা ‘বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতম অংশীদার বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশ্রমিকরা মহামারীতে কীভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত এক বছরে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ফলে দেশের ৩৫ শতাংশ পোশাকশ্রমিকের বেতন কমেছে। অথচ করোনার সংক্রমণ যখন ঊর্ধ্বমুখী, তখন দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে স্বাস্থ্যঝুঁকি উপেক্ষা করে কাজ করে যাচ্ছে পোশাক খাতের শ্রমিকরা, বিনিময়ে পাচ্ছে না যথাযথ পারিশ্রমিক। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দেশে আঘাত হানার পর চলমান লকডাউনেও পোশাক খাতের শ্রমিকরা কার্যত ফ্রন্ট লাইনারের ভূমিকাতে অবতীর্ণ হয়েছে। তা ছাড়া করোনার প্রকোপ বাড়ার পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাওয়া পোশাক খাতসহ বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের প্রচেষ্টার ফলে পণ্য রপ্তানিতে নতুন মাইলফলকে পৌঁছাল বাংলাদেশ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবির) হালনাগাদ হিসাব অনুযায়ী গত এপ্রিল মাসে ৩১৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে যা গেল বছরের এপ্রিলের চেয়ে ৫০২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি।

চলমান করোনা মহামারীর মধ্যে পোশাক খাতের শ্রমিকদের বেতনাদি পরিশোধের লক্ষ্যে গত বছর সরকারের কাছ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ পায় কারখানার মালিকরা। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের এক যৌথ জরিপে দেখা যায়, সরকার প্রদত্ত মোট প্রণোদনার ৫৮ শতাংশ পেয়েছে তৈরি পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। তবুও করোনাভাইরাস দেশে আঘাত হানার পর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৩ লক্ষাধিক শ্রমিক ছাঁটাই বা কর্মচ্যুতির শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটি (বিসিডাব্লিউএস)। উল্লেখ্য, যারা ছাঁটাই হয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকেই বকেয়া বেতন বা কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। এদিকে গত বছরের সরকার প্রাপ্ত প্রণোদনার টাকা পাবার পর, এ বছরও ঈদের আগে এপ্রিল-জুন মাসের বেতন বোনাস পরিশোধের দাবিতে প্রণোদনা প্যাকেজের আবেদন করেছেন কারখানার মালিকরা।

করোনা ভাইরাসের প্রকোপ অনেকাংশেই নাজুক করে ফেলেছে পোশাকশ্রমিকদের জীবনধারা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্ট্যারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের চলমান সংকটকালে প্রায় ৭৭ ভাগ শ্রমিক তাদের পরিবারের খাদ্য চাহিদাও পূরণ করতে পারছে না। দৈনন্দিন তৈজসপত্র-খাদ্যসামগ্রীর দাম করোনাভাইরাস চলাকালীন সময়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় নিজেরসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের খাদ্য ঘাটতি পূরণ সম্ভব হচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই খাদ্য চাহিদার ঘাটতি থাকার ফলে তারা বিভিন্নরকম দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন। ইউনাইটেড ন্যাশন ডেভলপম্যান্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির চৌধুরী সেন্টার ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ এবং ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড বিজনেস পরিচালিত গবেষণায় করোনাকালীন সময়ে গার্মেন্টকর্মী, বিশেষ করে নারীকর্মীদের বিভিন্ন ঝুঁকির চিত্র উঠে এসেছে। করোনা সৃষ্ট সংকটে বাজারে চাহিদা কমা, শিপমেন্ট বন্ধ, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় লাগা, সময়মতো মূল্য না পাওয়া ইত্যাদির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে পোশাক খাতের শ্রমিকদের ওপর। তা ছাড়া চাকরি থেকে ছাঁটাই, মজুরি কর্তনের ফলে আর্থিকভাবে দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন কেউ কেউ। ফলস্বরূপ একই সাথে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, করোনাকালীন সময়ে যেসব শ্রমিককে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে, পরে তাদেরকেই আবার কম বেতনে চুক্তিবদ্ধ করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে কাজ হারিয়ে বেকার হওয়া শ্রমিকরা কম পারিশ্রমিকেই পুনরায় যোগদান করছে। অন্যদিকে পোশাক খাতের মালিকপক্ষ থেকে কৃত্রিম ছাঁটাই আতঙ্ক সৃষ্টি করে অনেক শ্রমিকদের বেতন কমিয়ে দেওয়ার তথ্যও উঠে এসেছে টিআইবির গবেষণায়। ফলে গ্রাম থেকে আশার আলো খুঁজতে শহরে আসা পোশাক খাতের এই শ্রমিকরা অনেকটা বাধ্য হয়ে জীবিকার তাগিদে কম পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। যারা কম বেতনের চাকরিতে পুনরায় যোগদান করতে পারেননি তাদের অনেকে জীবন নির্বাহের জন্য দিনমজুরের কাজ বেছে নিয়েছেন।

উল্লেখ্য, শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার পথে আইনি এবং আইনবহির্ভূত অসংখ্য বাধা রয়েছে। সে কারণে দুই লাখের মতো ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান থাকলেও ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা ৮ হাজারের কম। দেশের প্রধান রপ্তানি খাত গার্মেন্টে ৪ হাজারের বেশি কারখানা থাকলেও ট্রেড ইউনিয়ন আছে এমন কারখানা কাগজে-কলমে ৬৬১টি। বাস্তবে সক্রিয় ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা আরো কম। দেশের ৮টি ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নেই। গত ২৪ এপ্রিল ছিলো রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৮ম বর্ষপূর্তি। মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকরা এখনো জীবিকার সন্ধানে লড়াই করে যাচ্ছেন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান একশন এইডের তথ্যানুযায়ী, রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ৫৭ শতাংশ বর্তমানে বেকার। একেকটি দুর্যোগ শ্রমিকদের নাজেহাল অবস্থা স্পষ্ট করে দেয়, রানা প্লাজা ধস যার অন্যতম উদাহরণ।

চলমান করোনা মহামারীর উদ্বেগজনক পরিস্থিতি এই সত্যকে নতুন করে সামনে এনেছে যে, শ্রমিকরাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের উৎপাদন, রপ্তানি তথা দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি অব্যাহত রাখে। অথচ সেই পোশাকশ্রমিকের কপালে জোটে ছাঁটাই, বেতন কমানো,  বিনা চিকিৎসা, অপুষ্টি আর হয়রানি। করোনা সংক্রমণের  মারাত্মক ঝুঁকি এবং চলমান লকডাউনের মধ্যেও বকেয়া বেতনের দাবিতে প্রায়ই সাভার এবং গাজীপুরে শ্রমিকদের রাস্তায় নামতে দেখা যায়। দেশের অর্থনীতির গতি সচল রাখার লক্ষ্যে পোশাক শ্রমিকদের ভূমিকা অনন্য, কিন্তু করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের ফলে চলমান লকডাউনকে পুঁজি করে ঈদের আগে শ্রমিক ছাঁটাই ও বেতন-বোনাস না পাওয়ার আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে পোশাকশ্রমিকদের। ঈদের আগে সময়মতো বেতন-বোনাস না পেলে যে-কোনো মুহূর্তে শ্রমিক অসন্তোষ তৈরি হতে পারে যা সামগ্রিকভাবে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণকে প্রশমিত করবে, আর যার দায় বর্তাবে সংশ্লিষ্টদের ওপরই।

লেখক : শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!