• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডাকঘর : আধুনিকায়ন জরুরি


তামান্না আক্তার জুন ১৬, ২০২১, ০৩:৪০ পিএম
ডাকঘর : আধুনিকায়ন জরুরি

ঢাকা : প্রাচীনকালে যোগাযোগের একমাত্র সুপ্রচলিত মাধ্যম ছিল ডাক যোগাযোগ। প্রিয়জনের জন্য নিজ হাতে চিঠি লিখে আবেগ আদান-প্রদান করতো সবাই। সেকালে মানুষ কবুতরের পায়ে চিঠি বেঁধে তাদের মনের সব অস্পষ্ট ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশ করতো প্রিয়জনের কাছে। ১৭৭৪ সালে উপমহাদেশে ডাক সার্ভিস চালু হওয়ায়, কবুতরের পায়ে বেঁধে চিঠি দেওয়ার পরিবর্তে হলুদ, নীল খামে প্রিয়জনদের চিঠি দেয়ার প্রচলন দেখা যায়। সেই চিঠি ছিল প্রিয়জনের হাতের ছোঁয়া, আবেগ, ভালোবাসার মূর্ত প্রতীক। দীর্ঘদিন অপেক্ষা করার পর, যেন আনন্দের ও সুখবরের বার্তা নিয়ে উপস্থিত হত ডাকপিয়ন। পালকি ডাক, মহাজনি ডাক— বিভিন্ন ডাক ব্যবস্থা ছিল তখন। চিঠি, পণ্য, পার্সেল, টাকা পরিবহনের একমাত্র ভরসা ছিল ডাক বিভাগ। প্রতিদিন খামে ভরে প্রিয়জনদের জন্য ডাকঘরের ‘ডাকবাক্সে’ চিঠি রাখতেন সাধারণ মানুষ। সেগুলো খুলে ডাকপিয়নরা বিভিন্ন ঠিকানায় পাঠাতেন। রানার, ডাকপিয়ন, পোস্ট মাস্টারসহ অন্য কর্মচারীরা ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করতেন। কিন্তু সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে হাতে লেখা চিঠি তার আবেদন হারিয়েছে। হারিয়ে যাচ্ছে প্রিয়জনকে কাগজে লেখা সেই আবেগ। ফুরিয়ে গেছে ডাকঘরের মাধ্যমে চিঠি পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা। এখন আর আগের মতো লোকজনের আনাগোনা চোখে পড়ে না ডাকঘরে। দিনে দিনে কমে যাচ্ছে ডাক বা চিঠির আদান-প্রদান। ডাকপিয়নও এখন তেমন চোখে ধরা পড়ে না। সময়ের সাথে নানা ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। যার ফলে হাতে লেখা চিঠির কদর অনেকাংশে কমে গেছে। এখন চাইলে পৃথিবীর এক প্রান্তে বসে অন্য প্রান্তের লোকের সাথে যোগাযোগ করা যায়। তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ই-মেইল কিংবা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল প্রকার যোগাযোগ করা যায় সহজে। এখন প্রবাসীদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। প্রবাসী প্রিয়জনদের সাথে ইচ্ছে হলে কয়েক সেকেন্ডে অত্যাধুনিক মোবাইলে ভিডিও কল করে কথা বলা যায়। চিঠি লেখার কোনো প্রয়োজনই পড়ে না। তাই এখন আর ডাকবাক্সগুলো ব্যবহার হয় না। পথের পাশের ডাকবাক্স এখন ভাঙা ও মরিচা পড়ে নষ্ট হওয়ার পথে। আধুনিক যুগের মানুষের কাছে ‘ডাকঘর’ যেন মোবাইল ফোন, মেসেঞ্জার, ই-মেইল, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ আরো কত কি! সেই পুরনো ঐতিহ্যবাহী ডাকঘরের ডাকবক্স অতীত স্মৃতিতে পরিণত হচ্ছে।

বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৫০ বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে এগিয়ে চলা ডাক বিভাগ আজ নানা সমস্যায় জর্জরিত। দেশে প্রায় ১০ হাজারের মতো পোস্ট অফিস রয়েছে। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে মোট ৯ হাজার ৮৮৬টি ডাকঘর রয়েছে। এর মধ্যে জিপিও ৪টি, এ গ্রেড প্রধান ডাকঘর ২১টি,  বি গ্রেড প্রধান ৪৬টি, উপজেলা পোস্ট অফিস ৪০০টি, সাবপোস্ট অফিস ১ হাজার ২৬৭টি ও ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিস ৮ হাজার ১৪৮টি। ডাক সেবার মানও উন্নত হচ্ছে দিন দিন। এখন ডাকঘর শুধু চিঠি আদান-প্রদানই করে না। বর্তমানে নতুন নতুন সেবা চালু করেছে ডাক বিভাগ। মানি অর্ডার, ই-মানি অর্ডার, ইএমও ইস্যু, ক্যাশ কার্ড, এসবি, এফডি, সঞ্চয়পত্র, মুনাফা সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রসহ নানা ধরনের কার্যক্রম চালু হয়েছে। কিন্তু তাও মানুষ ডাক সেবা নিতে আগ্রহী নয়। এর মূল কারণ মোবাইল ফোন, ই-মেইল, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা। পাশাপাশি ডাক সেবা সম্পর্কে মানুষের ধারণার অভাব। ডাকঘরে বিকল্প হিসেবে নানা ধরনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বিকাশ, রকেট, ডাচ বাংলা নামক সহজলভ্য সেবা চালু হওয়ায় মানি অর্ডারের পরিমাণ রীতিমতো কমে গেছে। দেশের অধিকাংশ পোস্ট অফিসের অবস্থা এখন অত্যন্ত নাজুক। জনবলের অভাব, গ্রামপর্যায়ে ডাকগুলোতে প্রযুক্তির অপ্রতুলতা, দক্ষ ডাক পিয়নের অভাবে ডাকসেবা মানুষের কাছে পৌঁছানোর প্রধান অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। এ ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে ডাকঘরের শেষ পরিণতি হবে জাদুঘর।

ডাক সেবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি কল্পে ও ডাকসেবা সকলের কাছে পৌছে দিতে সরকার নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারেন। সর্বপ্রথম অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে হবে। ডাকঘরগুলোতে দক্ষ জনবল নিয়োগ করতে হবে। ডাক সেবা প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি ডাকঘরে ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় আনতে হবে। এতে ডাকঘরের সকল কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভবপর হবে। ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, যার দরুন ডাকঘরের উপকারিতা সম্পর্কে ব্যাপক সম্প্রচার ঘটবে। এছাড়া সাইবার ক্যাফে স্থাপন ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। সাইবার ক্যাফে বিনামূল্যে বা স্বল্প মূল্যে ইন্টারনেট ব্রাউজার ব্যবস্থা এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের ঋণ প্রদান করে স্বকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে ডাক ও ইন্টারনেট সেবা সহজেই মানুষের কাছে পৌছবে এবং কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা হবে।

এভাবেই ডাকঘর ঐতিহ্য হারানোর হাত থেকে রক্ষা পাবে। ডাকঘরের আভিধানিক অর্থ পাল্টে যাবে। ডাকঘর তখন খালি ডাকবক্স কিংবা ধুলো পড়া পুরনো চিঠিপত্রের সমাহার হিসাবে চিহ্নিত হবে না। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া নিয়ে ডাকঘর ফিরে আসবে তার স্বরূপে। আবারো ডাকবক্স তার পুরনো আমেজ ফিরে পাবে, চিঠিতে ভরে যাবে ডাকবক্স, এটাই প্রত্যাশা। ‘রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম বাজছে রাত/রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে’— সুকান্তের সেই রানারা ঘণ্টার আওয়াজে চিঠিপত্র বিলি করতে বের হবে আবারও।

লেখক : শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!