ফাইল ছবি
নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচার কৌশলেও স্পষ্ট হচ্ছে ভিন্নতার রেখা। বিএনপি যেখানে সড়কে শোডাউন, মিছিল-সমাবেশে ব্যস্ত, সেখানে জামায়াতে ইসলামী চলছে সম্পূর্ণ নীরব কিন্তু অত্যন্ত সংগঠিত প্রচারণায়। তাদের মূল লক্ষ্য নারী ভোটার। আর এই কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু জামায়াতের মহিলা বিভাগ।
বরিশাল, পিরোজপুর ও পটুয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় অনুসন্ধানে দেখা গেছে-জামায়াত প্রকাশ্যে কোনো ব্যানার-পোস্টার না টানলেও পাড়া–মহল্লায় ছোট ছোট ইসলামি সভা তথা তালিমের মাধ্যমে নারী ভোটারদের মধ্যে তৈরি করছে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব। এটিই এখন দলটির প্রধান ভোটের প্রস্তুতি।
বরিশাল নগরীর ব্রাউন কম্পাউন্ড, কলেজ অ্যাভিনিউ থেকে কাউনিয়া-অধিকাংশ এলাকাতেই নারীসমাবেশের সাধারণ নাম তালিম। এখানে ৮ থেকে ১০টি বাড়ির নারীরা অংশ নেন। কোনো পুরুষ উপস্থিত থাকে না। বাইরের লোকজন সাধারণত এই আয়োজনকে নির্দোষ ধর্মীয় আলোচনা মনে করেন।
তালিমে কুরআন-হাদিস আলোচনা হয়, তবে তার ভেতরে কৌশলে ঢোকানো হয় রাজনৈতিক বার্তা। ইসলামী আদর্শে চলার তাগিদের সঙ্গে যুক্ত করা হয় নির্বাচন। নারীদের বোঝানো হয়, ইসলামের পথে থাকতে হলে ইহকালের সিদ্ধান্তেও থাকতে হবে ইসলামের অনুগত। অনেকের মাঝেই এই আলোচনা ধর্মীয় দায়িত্ববোধের সঙ্গে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে মিলিয়ে দেয়।
নগরীর কলেজ অ্যাভিনিউয়ের এক বাসিন্দার অভিজ্ঞতা, তাঁর স্ত্রী হঠাৎ জানালেন তিনি জামায়াতে ভোট দেবেন। অনুসন্ধানে জানা গেল, তিনি নিয়মিত মহিলা জামায়াতের তালিমে যান। সেখানে শুনেছেন জামায়াতে ভোট দিলে সওয়াব পাওয়া যায়।
কাউনিয়া এলাকার বাসিন্দারা জানান-এই তালিম কোনো সাম্প্রতিক আয়োজন নয়, অন্তত ১২–১৩ বছর ধরে বিভিন্ন বাড়িতে চলছে। মাঝারি আয়ের বহু পরিবারও অজান্তে এতে জড়িয়ে গেছে।
পটুয়াখালী–২ (বাউফল) এলাকায় পাওয়া গেছে আরও চমকপ্রদ তথ্য। জামায়াতের এই তালিম চলছে বিএনপি নেতাদের বাড়িতেও। এক পৌর বিএনপি নেতা বলেন, কিছুদিন আগে জেনেছেন তাঁর বাড়িতে নিয়মিত তালিম বসে। তারপর তিনি তা বন্ধ করেছেন। তাঁর ভাষ্য, না দেখলে বিশ্বাস হতো না, জামায়াত কতটা তৃণমূলে ঢুকে গেছে।
বরিশাল নগরীতেও বিএনপির সমর্থকদের অন্তত ১৭টি বাড়িতে জামায়াতের এই তালিম হয় বলে তথ্য মিলেছে। পিরোজপুর–১ আসনে মরহুম দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে মাসুম সাঈদীর সমর্থনে চলছে খুব সূক্ষ্ম পরিকল্পনা।
প্রতিটি কর্মীকে দিনে অন্তত একজন ভোটার নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সপ্তাহ শেষে সেই নিশ্চিত ভোটারের তালিকা জমা দিতে হয়। শুক্রবার-শনিবার ৪০-৫০ জন কর্মী ছোট দলে ভাগ হয়ে বাড়ি বাড়ি প্রচারণা চালান। ওয়ার্ডভিত্তিক অন্তত চারটি মসজিদে আসরের নামাজের পর দেওয়া হয় ধর্মীয় আলোচনার দাওয়াত, যার ভেতরেই থাকে রাজনৈতিক বার্তা।
পিরোজপুর–২ (স্বরূপকাঠি) এলাকায় দেখা গেছে সরকারি দলের কয়েকজন স্থানীয় নেতা প্রকাশ্যে জামায়াতের প্রচারে অংশ নিচ্ছেন। কারও বক্তব্য, বিএনপির চাপ ও নির্যাতন থেকে বাঁচতে তারা জামায়াতকে সমর্থন দিচ্ছেন। আবার কেউ বলছেন, ওমরাহ করে এসে ইসলামি রাজনীতির পথে থাকতে চান।
স্থানীয়দের মতে, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংঘাত এবং দখল–চাঁদাবাজির অভিজ্ঞতার কারণে বিএনপি প্রার্থীর সম্ভাবনা এলাকায় উদ্বেগ তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতি জামায়াত কৌশলে কাজে লাগাচ্ছে।
জামায়াত শুধু প্রচারণায় নয়, নির্বাচনী প্রস্তুতিতেও প্রতিযোগীদের তুলনায় অনেক এগিয়ে। ৭–৮ মাস আগে থেকেই ভোটকেন্দ্রভিত্তিক কমিটি করেছে তারা। প্রতিটি কমিটিতে ১৫০ সদস্যের মধ্যে ৯ জন নারী। প্রচার, ভোটকেন্দ্র পরিচালনা, ঝুঁকি মোকাবিলা-প্রতিটি দায়িত্বের আলাদা কমিটি রয়েছে। এক কমিটির সদস্যকে অন্য কমিটিতে রাখা হয় না-এটাই দলের নীতি। দরিদ্র পরিবারকে দেওয়া হয় নিয়মিত মাসিক সহায়তা। জুলাই যুদ্ধাহত পরিবারও আছে এ তালিকায়। এসব করা হয় গোপনে, স্থানীয় নেতাকর্মীদের জানানো ছাড়াই।
জামায়াতে ইসলামীর বরিশাল মহানগর আমির জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর বলেন, মহিলা বিভাগের তালিম ১৭ বছর ধরে চলছে এবং তা ধর্মীয় আলোচনারই অংশ। তিনি বলেন, তারা যেহেতু রাজনৈতিক দল, তাই ধর্মীয় আলোচনা পাশাপাশি ভোটের কথাও আসে। তবে মসজিদ ব্যবহার করে প্রচারণা চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, জামায়াত বহু আগে থেকেই নারী ভোটের ওপর দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করেছে। বিএনপি এখনো প্রধানত মিছিল-সমাবেশে নির্ভর করছে। ফলে ঘরে ঘরে প্রভাব বিস্তারে তারা পিছিয়ে রয়েছে। জামায়াতের কৌশল ডোর টু ডোর রিলিজিয়াস ইনফ্লুয়েন্স-যা সরাসরি সংঘর্ষহীন, কিন্তু কার্যকর।
নারী ভোটার যেহেতু সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করার উল্লেখযোগ্য শক্তি, সেখানে বিএনপির অনুপস্থিতি তাদের জন্য বড় দুর্বলতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জামায়াত প্রকাশ্যে প্রচারণায় নেই, কিন্তু নীরবে পরিচালিত সংগঠিত কর্মকৌশলে তারা অনেক এগিয়ে। বিএনপি যেখানে সড়কে শক্তি প্রদর্শনে ব্যস্ত, জামায়াত সেখানে ঘরে ঘরে ঢুকে ধর্মীয় আবহে নারী ভোটারদের নিজেদের দিকে টেনে নিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই কৌশল অব্যাহত থাকলে ভোটের দিন মাঠে নয়, বরং ভোটের আগের দিনগুলোতেই সিদ্ধান্ত বদলে দিতে পারে জামায়াত।
এসএইচ







































