• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার থাবায় মৃত্যুহার বাড়ছে প্রবাসীদের


নিজস্ব প্রতিনিধি জুলাই ৫, ২০২১, ১১:২৩ এএম
করোনার থাবায় মৃত্যুহার বাড়ছে প্রবাসীদের

ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা : বর্তমানে বিশ্বের ১৬৪ দেশে কাজ করছেন প্রবাসী কর্মীরা। করোনার থাবায় কতজনের মৃত্যু হয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই কারও কাছে। করোনায় মৃত কর্মীর লাশও দেশে আসেনি, দাফন হয়েছে বিদেশের মাটিতেই। আর করোনা ছাড়া নানা কারণে গত দেড় বছরে ৪ হাজার ২৬২ কর্মীর মৃত্যু হয়েছে বিভিন্ন দেশে। এদের বেশিরভাগই স্ট্রোক কিংবা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। গত বছরের জানুয়ারি থেকে এই বছরের মে পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানা গেছে। তাদের বেশিরভাগের বয়স ২৮-৪১ বছরের মধ্যে।

এক সপ্তাহ আগে সৌদি আরবের রিয়াদে মোহাম্মদ নুরুল আমিন নামে একজন প্রবাসী কর্মী মারা যান। তার বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালিতে। তার সঙ্গে থাকা অন্যান্য প্রবাসীরা জানান, রাতে খাবারের পর ঘুমিয়ে পড়লে সকালে আর ওঠেননি। তাদের ধারণা স্ট্রোকে কিংবা হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয়েছে। শুধু স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুবরণ করে ওমান থেকে লাশ হয়ে ফিরেছেন ৪৮ বছর বয়সী আক্তার মিয়া, কুয়েত থেকে ৩৯ বছর বয়সী সুন্দর আলী, দুবাই থেকে ৩৯ বছর বয়সী রতন মিয়া, সৌদি আরব থেকে ৪৮ বছর বয়সী শাহ্ আলম, কাতার থেকে ২৯ বছর বয়সী বশির উদ্দিন, বাহরাইন থেকে ৩৫ বছর বয়সী জিয়াবুল হোসেন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে যেসব মধ্যবয়সী কর্মীদের লাশ আসছে তাদের বেশির ভাগের মৃত্যু স্ট্রোকের কারণে।

তথ্য যাচাই করে আরো জানা যায়, ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি লাশ এসেছে সৌদি আরব এবং মালয়েশিয়া থেকে। সৌদি আরব থেকে এসেছে ৭৬২টি এবং মালয়েশিয়া থেকে এসেছে ৬৯৬টি লাশ। লাশ বেশি আসার এই তালিকায় আরো আছে কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, বাহরাইন। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে লাশ আসার পরিমাণ অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে মোট লাশ এসেছে ২ হাজার ৮৮৪টি।
 
২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত লাশ এসেছে ১ হাজার ৫৫৪টি। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে এসেছে ৫২১টি, মালয়েশিয়া থেকে ৩২৯টি, কুয়েত থেকে ১০০টি, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১২৮টি , কাতার থেকে ১০০টি এবং ওমান থেকে ১২৭টি। অর্থাৎ বেশির ভাগ লাশ এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গত ২৮ বছরে ৫ মাসে ৪১ হাজার ৩২টি লাশ দেশে এসেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাশ এসেছে ২০১৭-১৯ সালে, প্রতিবছর ৩ হাজারের ওপরে। তাছাড়া অনেক স্বজনরা লাশ ফেরত নিতে চান না। তাই সেসব কর্মীর লাশ দেশেও আসে না এবং থাকে হিসাবের বাইরে। বিদেশে কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রবাসী কর্মীদের মৃত্যুর হার এত বেশি কেন তা কখনো খতিয়ে দেখা হয়নি। আবার এত বেশি কর্মী স্ট্রোক অথবা হার্ট অ্যাটাকে কেন মারা যাচ্ছে তার সঠিক কারণ জানতেও অনুসন্ধান করা হয়নি। তাদের মৃত্যুর কারণে যা লেখা হয় তাও পুনরায় খতিয়ে দেখারও কোনো নজির নেই। 

প্রবাসী কর্মীদের অভিযোগ, কর্মস্থলে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ এড়াতেও স্ট্রোকে কিংবা হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর কথা ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা হয়। প্রবাসী কর্মীদের এই ধরনের অকাল মৃত্যুতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার পুরো পরিবার। অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ) একটি জরিপ চালিয়ে দেখেছে, ৯৫ শতাংশ অভিবাসী কর্মীর মৃত্যুর পর আর্থিক সঙ্কটে পড়ে যায় তার পুরো পরিবার। তার মধ্যে ৫১ শতাংশ পরিবারের ৮০-শতভাগ আয় কমে যায়। পাশাপাশি ৮১ শতাংশ পরিবার স্বাস্থ্যসেবা পেতে সঙ্কটে পড়ে, ৬১ শতাংশ পরিবারের সন্তানেরা স্কুলে যাওয়ার সক্ষমতা হারায় আর ৯০ শতাংশ পরিবারই দৈনিক খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। প্রবাসী কর্মীর মৃত্যুর পর ৪৮ শতাংশ পরিবারই বিষন্নতায় ভুগে, ৪০ শতাংশ পরিবারের ঘুমের জটিলতা তৈরি হয়। তাছাড়া কিছু কিছু পরিবারের এক ধরনের দায় চাপাচাপির মতো পরিবেশ তৈরি হয়।

ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, বিদেশে মৃতদের বেশিরভাগই হার্ট অ্যাটাক, ব্রেইন স্ট্রোক, দুর্ঘটনাজনিত কারণে মারা যান। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি, একটা মানুষ বিদেশ যাওয়ার আগে তাকে বেসিক ধারণা দিতে হবে। সৌদি আরবে আবহাওয়া কেমন, সেখানে কোন ধরনের খাবার খাওয়া উপযোগী। দেশভিত্তিক এই ধরনের বিষয়ে সচেতনতা যেমন একদিকে দরকার, আরেকদিকে মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করা। বলা হয় আত্মহত্যা, দুর্ঘটনা , আসলেই তাই কিনা। আমরা যদি মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করতে পারি তাহলে কিন্তু বিদেশগামী কর্মীদের সেভাবে সচেতন করতে পারি। আমাদের অভিবাসী কর্মীদের স্বাস্থ্যের বিষয়টি এত বেশি উপেক্ষিত থেকে যায়, বিদেশে একসঙ্গে অনেকজন গাদাগাদি করে থাকে, সারাক্ষণ মাথার মধ্যে চিন্তা, দেনা শোধ করার চিন্তা, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। এসব কিছু মিলিয়ে কিন্তু মৃত্যুর দিকে যায়। গত ১৩-১৪ বছরের আমাদের ৪০ হাজারের মতো প্রবাসী মারা গেলেও এটা নিয়ে খুব একটা বড় কাজ আমাদের হয়নি। অভিবাসী কর্মীদের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া খুবই জরুরি।

অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, অভিবাসী কর্মীদের মৃত্যুর ঘটনা পুনরায় ময়নাতদন্ত করার সুযোগ বের করা দরকার। যে মৃত্যু বলা হচ্ছে হার্ট অ্যাটাকে সেটার কারণ কি অথবা যে রিপোর্টগুলো হচ্ছে সেটা কি যা হচ্ছে তাই দিচ্ছে নাকি ম্যানিপুলেশন আছে সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ নিয়োগকর্তার দায় এড়ানোর সুযোগের জায়গা থেকে এমনটা করা হতেই পারে। বেশিরভাগই যারা হার্ট অ্যাটাকে মারা যাচ্ছে তারা খুব কম বয়সের। এই হার্ট অ্যাটাকের কারণটি আসলে কি সেটা জানা দরকার।

তিনি আরো বলেন, একজন কর্মীর মৃত্যুর পর তার পরিবারের আর্থিক সঙ্কট তৈরি হয়। আমরা যখন অভিবাসী কর্মীদের সুরক্ষার কথা বলি, তখন এই মারা যাওয়ার প্রেক্ষিতে নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে কতটুকু কাজ করা হয়? কর্মীদের স্বাস্থ্যবীমা আছে, সেক্ষেত্রেও বীমার টাকা আদায়ে দূতাবাস একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু আমরা জানি না বিভিন্ন কারণে মারা যাওয়া কর্মীদের বীমার টাকা দাবি করা হয় কিনা। এই বিষয়গুলা একটু ভালো করে খতিয়ে দেখার দরকার আছে।

সোনালীনিউজ/এমএএইচ

Wordbridge School
Link copied!