• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অহংকারের ক্ষতি এবং দূর করার পদ্ধতি


মুফতি কাজী সিকান্দার নভেম্বর ২৮, ২০২০, ০৩:১৫ পিএম
অহংকারের ক্ষতি এবং দূর করার পদ্ধতি

ঢাকা : অহংকার হলো দিনী ও দুনিয়ার গুণাবলির ক্ষেত্রে নিজেকে অন্যের তুলনায় ইচ্ছাকৃত বড় মনে করা এবং সাথে সাথে অন্যকে ছোট ও তুচ্ছ মনে করা।

হাদিস শরিফে অহংকারের ব্যখ্যা এই ভাবে দেওয়া হয়েছে যে, অহংকার হচ্ছে হককে অস্বীকার করা এবং মানুষকে তুচ্ছ মনে করা। একজন মানুষ তখন নীতির বিপরীত চলতে পারে যখন নিজেকে বড় মনে করে আইন বা অন্যকে তুচ্ছ ও ছোট মনে করে।

যদি অনিচ্ছা সত্ত্বে নিজেকে বড় ও অন্যকে তুচ্ছ মনে করার খেয়াল আসে তবে তাতে সমস্যা নেই।

কিন্তু তা যেন ইচ্ছায় পরিণত না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। কেউ যদি বাস্তবে বয়সে বা টাকায় বড় হয় অন্যকে তুচ্ছ না ভেবে এমনিতে বড় ও ছোট বলা হয় তবে সেটা অহংকার হবে না।

আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘আমি এমন লোকদেরকে স্বীয় আহকাম থেকে ফিরিয়ে রাখব, যারা দুনিয়াতে আহংকার করে, যে বিষয়ে তাদের কোনো হক নেই।’ আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক বস্তু বা প্রাণীকে স্বীয় উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন।

তিনি কোনো বস্তুকে উপকারহীন সৃষ্টি করেননি। পরিচয় বা  শৃঙ্খলার জন্য সৃষ্টিকুলকে বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত করে সৃষ্টি করেছন। তবে সব সৃষ্টির সেরা হিসেবে মানুষকেই সম্মানিত করেছেন। মানুষকে দিয়েছেন জ্ঞান-বুদ্ধি। দিয়েছেন বিবেক। বাকি সব সৃষ্টিকে মানবের সেবায় নিয়োজিত করেছেন। প্রত্যেক মানবের সেবায় শত শত মাখলুক। মানুষকেই দয়াময় সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছেন। এই বিশ্বজাহান মানুষের জন্য। আলো, বাতাস, পানি, সাগর, ঝরনাসহ সবই মানুষের জন্য। সব সুখের উপকরণ মানুষের জন্য। জান্নাত সেটাও মানুষের জন্য। ফেরেশতারাও নিয়োজিত মানুষের খেদমতে।

মানুষই সৃষ্টির সেরা। তবে সুন্দর বিন্যস্তের জন্য মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন ধনী-গরিব, কালো-ধলা, ছোট ও বড় করে। যাতে একে অন্যের সম্পূরক হতে পারে। একে অন্যের দারস্থ হয়ে সমভাবে জীবনযাপন করতে পারে। এগুলো সবই সৃষ্টিকর্তার দান। মানুষের নিজের বলে কিছুই নেই। অপর দিকে মানুষকে মহান হাকীম সৃষ্টি করেছেন এক ফোঁটা নাপাক পানি থেকে। মৃত্যুর পর সেই মানুষটি হয়ে যাবে মূল্যহীন একটি লাশ। সুতরাং অহংকার করা মানুষের জন্য নয়; বরং অহংকার একমাত্র আল্লাহর জন্য।

যেমন হাদিসে বর্ণিত আছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে-‘হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অহংকার আমার গায়ের চাদর আর মহত্ত্ব আমার পরনের লুঙ্গি। তাই অহংকার করা মানুষের জন্য সাজে না। কারণ এতে তার কোনো কৃতীত্ব নেই। মানুষ তো সবাই একই শ্রেণির। তবে যারা তাকওয়া অর্জন করেছে তারা অগ্রগামী।

স্রষ্টার কাছে তাদেরই দাম রয়েছে, যারা স্রষ্টাকে চিনেছে, বুঝেছে ও মেনেছে। তাবে যারা অহংকার করে, তারা আল্লাহর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। আল্লাহতায়ালা বলেন, আল্লাহতায়ালা অহংকারকারীকে ভালোবাসেন না।’ (সুরা নাহাল, আয়াত-২৩)। আল্লাহপাক আরো বলেন, ‘এমনিভাবে আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক অহংকারী এবং জালেমের অন্তরে মোহর লাগিয়ে দেন।’

হাদিসে বর্ণিত আছে-রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘সেই ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার অন্তরে সরিষা পরিমাণ অহংকার আছে।’ (মুসলিম)
অন্য এক হাদিসে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কেয়ামতের দিন জাহান্নাম থেকে একটি গর্দান বের হবে। তার কান, জিহ্বা ও চক্ষু থাকবে যা দ্বারা সে শুনবে, কথা বলবে ও দেখবে। সে বলবে আমি ওই সব লোকের শস্তি দেব যারা অহংকারী, যারা আল্লাহর সাথে শরিক করে এবং যারা জীবের ছবি আঁকে।’

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-‘কেয়ামতের দিন অহংকারীকে পীপিলিকার ন্যায় ক্ষুদ্র করে দেওয়া হবে। মানুষ তাদেরকে পদদলিত করবে।’ হজরত আবু বকর (রা.) বলেন, ‘কোনো মুসলমানকে তুচ্ছ মনে করো না। কেননা ছোট মুসলমানও আল্লাহর কাছে বড়।’

অহংকারী যেমন আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট লাঞ্ছিত ও অপদস্থ-বঞ্চিত, তেমনি দুনিয়াতে ঘর-বাড়ি, সমাজ, রাষ্ট্রেও অপমানিত। অহংকারী ব্যক্তি সমাজে অনৈক্য দ্বন্দ্বের কারণ হয় থাকে।

আজকে আমাদের সমাজে অশান্তি, সন্ত্রাস, হত্যা ও নির্যাতন সব অনিয়মের পেছনে কিন্তু এই অহংকার নীরবে কাজ করে যাচ্ছে। অহংকারের গর্বে গর্বিত হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে বুক ফুলিয়ে চলছে তারা। সমাজে যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াচ্ছে। নিজেকে শ্রেষ্ঠ ও একমাত্র হকদার মনে করে অন্যের হক বিনষ্ট করছে। অহংকার একটি ঘৃণিত ও মন্দ স্বভাব। এতে জাগতিকভাবে যেমন সমস্যা আছে তেমনি পরকালেও সমস্যা আছে।

অহংকারকারীকে মানুষও ভালোবাসে না, আল্লাহও ভালোবাসেন না। তাই চারদিক থেকে একসময় তার জীবনে নেমে আসে অধ:পতন, লাঞ্ছনা ও বঞ্চনা। সে যদি কোনো বিপদে পড়ে আল্লাহ যেমন সাহায্য করেন না, তেমনি মানুষও তার সাহায্যে এগিয়ে আসে না। সে হয়ে যায় একাকী। তার কেউ আপন বলে থাকে না। এই অহংকারের তলায় আজ পিষ্ট হচ্ছে আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজনীতি সব। অহংকার করার কারণে নেয়ামত ছিনিয়ে নেওয়া হয়। অহংকারীর মধ্যে একতা হয় না।

আর যখন আমরা অপরকে আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করব এবং অহংকার বর্জন করব তখন সামাজে, রাষ্ট্র, রাজনীতিতে সর্বাঙ্গণে ফিরে আসবে সজীবতার প্রাণ। স্থাপিত হবে সমাধিকার। সম্মান, শ্রদ্ধাবোধ ফিরে আসবে। কোনো অঙ্গনে আর হবে না ঝগড়া-বিবাদ। সর্বোপরি তখন আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে ভালোবাসবেন। মানুষও আমাদেরকে ভালোবাসবেন। আর যখনই ভালোবাসার আবহ প্রবাহিত হবে পৃথিবীময় তখন অনাবিল শান্তি বিরাজ করবে মানবের অলিগলিতে। ঐক্য হওয়ার অবকাঠামো তৈরি হবে। পরস্পর বন্ধন হবে দৃঢ়।

অহংকার দূর করার পদ্ধতি : অহংকার একটি গোপন রোগ। ইলমে তাযকিয়ার পরিভাষায় এটি তাখলিয়ার একটি প্রকার। অর্থাৎ তাযকিয়ার জন্য কিছু গুণ আছে যা থেকে অন্তরকে পরিষ্কার করতে হবে। আর কিছুগুণ আছে তা হূদয়ে স্থাপন করতে হবে। তাখলিয়া হলো যা দূর করতে হবে। অহংকার তাখলিয়ার একটি অংশ। এটি অন্তর থেকে দূর করে তাতে বিনয় স্থাপন করতে হবে। এ অহংকার দূর করার কিছু কর্মপদ্ধতি রয়েছে।

এক. এটি দূর করার জন্য মোরাকাবা (গভীর ধ্যান) করবে। আর মেরাকাবায় ভাববে যে, বাস্তবিকই আমার মধ্যে যে গুণ রয়েছে সেটা তো আমার অর্জিত গুণ নয়। তা মহান আল্লাহতায়ালার দান।

দুই. এটি আল্লাহতায়ালা আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। সুতরাং আমি কেন অহংকার করব। আমার এই গুণ যে কোনো সময় চলে যেতে পারে।

তিন. অপরদিকে যাকে তুচ্ছজ্ঞান করেছি, যে কোনো সময় আল্লাহ তাকে গুণ, জ্ঞান ও সম্পদ দিতে পারেন। আর আমার থেকে ছিনিয়ে নিতে পারেন।

চার. হয়তো যাকে আমি তুচ্ছ ভাবছি তার মধ্যে এমন কোনো গুণ রয়েছে যা আমি জানি না। তার তো কিছু ভালো গুণও আছে সেগুলো খেয়াল করা আর নিজের দোষগুলো ভাবা।

পাঁচ. হয়তো সে আল্লাহর অনেক প্রিয় আমি হতেও পারি নাও হতে পারি, তাহলে কেন তাকে তুচ্ছ মনে করব?

ছয়. মোরাকাবায় দেখবে আসলে অহংকার অন্তরে আছে কিনা? যদি থাকে তখন নিজের ওপর আর্থিক দণ্ড সাব্যস্ত করা। দশ-বিশ রাকাআত নফল নামাজ পড়া। আল্লাহর কাছে দোয়া করা।

সাত.আল্লাহতায়ালার বড়ত্ব, মহত্ত্বকে স্মরণ করা। নিজের শেষ পরিণতির কথা ভাবা।

আট. কোনো আল্লাহর ওলীর হাতে হাত রেখে বাইয়াত হয়ে তাকে সব খুলে বলে চিকিৎসা করানো। তখন এ অহংকার ধীরে ধীরে চলে যাবে। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে এ ব্যাধি থেকে মুক্তি দান করুন এবং সবপ্রকার অপরাধ থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। আমীন!

লেখক : পরিচালক, ইসলাহ বাংলাদেশ

 

Wordbridge School
Link copied!