• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আহলে বাইতের সম্মান ও মর্যাদা   


মাওলানা আবদুর রশিদ তালহা নোমানি ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২১, ০৬:৫৩ পিএম
আহলে বাইতের সম্মান ও মর্যাদা    

ঢাকা : ইসলাম ধর্মে সাহাবায়ে কেরাম ও আহলে বাইতের মাহাত্ম্য ও গৌরবকে অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই। তারা হলেন সেই পবিত্র মানুষ, যাদেরকে আল্লাহ তায়ালা নবীজির সংস্রবের জন্য বেছে নিয়েছেন। যারা স্বচক্ষে নবীজির সাক্ষাৎ পেয়েছেন। সরাসরি তাঁর থেকে উপকৃত হয়েছেন। যাদের মধ্যস্থতা এবং ত্যাগের মাধ্যমে দ্বীন আমাদের কাছে পৌঁছেছে। আমরা কোরআন ও হাদিসের জ্ঞান লাভ করেছি এবং হকের রাস্তায় পৌঁছাতে সফল হয়েছি। তাই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি আমাদের যেভাবে ঈমান আনা জরুরি, ঠিক তেমনি সাহাবায়ে কেরাম এবং বিশেষ করে আহলে বাইতের সঙ্গে মহব্বত-ভালোবাসার সম্পর্ক রাখাও ঈমান ও ইসলামী শিক্ষার অংশ। যা ছাড়া দ্বীন অসম্পূর্ণ।

আহলে বাইত ইসলামের প্রচারক, কোরআন-হাদিসের ব্যাখ্যাকার ও প্রতিনিধিত্বকারী। যাদের উচ্চ নৈতিকতা ও চরিত্রের উৎকর্ষতা রয়েছে এবং তারা সৎসাহস, দৃঢ়তা ও সত্যবাদিতার জন্য খ্যাত। উম্মাহর উন্নতি ও সংশোধনের জন্য অবিরাম চেষ্টা করেছেন এবং দুনিয়া-আখেরাতে উম্মাহর সাফল্য ও সমৃদ্ধি কামনা করেছেন। আমলের ধারাবাহিকতা তাদের সবসময় ছিল। এ খেদমত কেয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে ইনশাআল্লাহ। এতে কোনো সন্দেহ নেই, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে যার যত নিকটতম সম্পর্ক তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তত পরিমাণ জরুরি ও আবশ্যক। মানুষ স্বভাবতই স্ত্রী ও সন্তানদের বেশি ভালোবাসে। তাই যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালোবাসার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তখন তাঁর পরিবার, সন্তান ও সাহাবায়ে কেরামকেও ভালোবাসার জন্য আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মোটকথা, তাদের প্রতি ভালোবাসা ও মহানুভবতা প্রদর্শনের ব্যাপারে উম্মতের মধ্যে কোনো সময়ই মতভেদ ছিল না। উম্মতের ঐকমত্যে সবার প্রতি শ্রদ্ধা ও মহব্বত রাখা জরুরি। মতভেদ তো সেখানে দেখা দেয়, যেখানে অন্যের মাহাত্ম্যের ওপর আক্রমণ করা হয়। অন্যথায়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিবার হিসাবে, সাধারণ নবী পরিবারের লোকেরা তাদের বংশ থেকে যত দূরেই থাকুক না কেন, তাদের ভালবাসা এবং সম্মান দেখানো সওয়াবের কাজ।

আহলে বাইত হলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণ (যাদের সংখ্যা ১১)। তাঁর পরিবার-পরিজন (যাদের সংখ্যা সাত) এবং বনু হাশেম পরিবার সবাই অন্তর্ভুক্ত। সুরা আহজাবে ‘আহলুল বাইত’ শব্দ দ্বারা নবীপত্মীদের কথা বোঝানো হয়েছে। আর আয়াতটির আগ-পরও এটাই বোঝায়। কোরআনের অন্যান্য আয়াত যেমন সুরা হুদ ও সুরা কাসাসেও নবীপত্নীদের আহলে বাইত বলা হয়েছে। এ আয়াতের অধীনে (নিষ্কুলশতার আয়াত) আবদল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এর একই বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে। (তাফসিরে ফাতহুল কাদির)।

আহলে বাইতের ফজিলত ও মর্যাদা হাদিস ও সাহাবায়ে কেরামের বাণীতে প্রচুর পরিমাণে বর্ণিত হয়েছে। হাদিস আর প্রসিদ্ধ সিরাতগ্রন্থে তাঁদের ফজিলত ও মর্যাদার বিষয়টি স্বতন্ত্র অধ্যায়ে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে হাদিসে তাদের কিছু অধিকারের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এ অধিকারসমূহের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো, আহলে বাইতকে সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা। তাদের যথোপযুক্ত সম্মান করা। তাদের ভালো আলোচনা করা। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা। বিশেষভাবে তাদের প্রতি মহব্বত পোষণ করা। তাদের প্রতি নিখাদ ভালবাসা পূর্ণাঙ্গ ঈমান অর্জনের উপায়। ইবনে আব্বাস (রা.)-এর অভিযোগের ভিত্তিতে অত্যন্ত হূদয়গ্রাহীভাবে নবী (সা.) বলেছেন, ‘কসম ওই সত্তার যার হাতে আমার জান! কোনো ব্যক্তির অন্তরে ঈমান প্রবেশ করবে না, যদি না তারা আল্লাহ ও ও রাসুলের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তোমাদের আহলে বাইতকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ না করে (তিরমিজি)।

প্রকৃতপক্ষে আহলে বাইতকে ভালোবাসা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ভালোবাসার প্রমাণ। নবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক রাখ, কেননা আল্লাহই তোমাদের রিজিক দেন এবং তোমাদের লালন-পালন করেন। আর আল্লাহর মহব্বতের ভিত্তিতে আমার সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক রাখ এবং আমার মহব্বতের কারণে আমার আহলে বাইতের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক রাখ।’ (তিরমিজি)।

আহলে বাইতের প্রতি দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হলো, তাদের আদর্শ গ্রহণ করা। তাদের উত্তম চরিত্র ও আমল অবলম্বন করা এবং ধর্মীয় বিষয়ে তাদের অনুসরণ করা, কারণ পবিত্র কোরআনের পরে আহলে বাইতের আদর্শ অনুকরণীয়। হাদিসে তাদের অনুসরণ করার জন্য জোর তাকিদ ও উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিম উম্মাহকে ঘোষণা করেছেন, ‘আমি এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছি, তবে হেদায়েত ও নির্দেশিকা হিসেবে কোরআন ও আমার পরিবার তোমাদের মধ্যে রেখে যাচ্ছি। আমার পরে যতক্ষণ তোমরা তাদের অনুকরণ করবে, ততক্ষণ তোমরা বিপথগামী হবে না। এর মধ্যে একটি অপরটির চেয়ে বড়। একটি হলো, আল্লাহর কিতাব মহিমান্বিত কোরআন, আর এটি আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত বিস্তৃত আল্লাহর রশি। দ্বিতীয়টি হলো, আমার সন্তান-সন্ততি ও আমার পরিবার-পরিজন।’ (তিরমিজি)। এ হাদিসে পবিত্র কোরআন ও আহলে বাইতকে অনুসরণ করার তাকিদ করেছেন নবীজি। কারণ আহলে বাইত-ই সর্বোচ্চ সুন্নাহর অনুসারী। এ হিসেবে তাঁদের অনুসরণও সুন্নতের অনুসরণ। এর দ্বারা এটাও বোঝা গেল যে, আহলে বাইতের প্রতি যদি এমন কিছু সম্বন্ধ করা হয় যা পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট বিধানের পরিপন্থী, তবে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। নবী পরিবারের অনুসরণের নাম করে শিয়ারা এমন অনেক কিছুই আহলে বাইতের প্রতি সম্বন্ধ করেছেন যা একেবারেই বাস্তববিরোধী। আহলে বাইত এ-জাতীয় মিথ্যা ও বানোয়াট জিনিস থেকে একেবারে মুক্ত। উম্মতের পক্ষে এ জাতীয় বিষয়ে আস্থা রাখা জায়েজ নয়। আহলে বাইতের উপরোক্ত অধিকার ব্যতীত আরো ছোট-বড় অধিকার রয়েছে। এর মধ্যে তাদের প্রতি কল্যাণকামিতা, সহমর্মিতা ও সহযোগিতা সবার আগে। (খোতবাতে হাব্বান সংক্ষিপ্তসার)।

আহলে বাইতের ত্যাগ-তিতিক্ষা : আহলে বাইতের সংগ্রাম এবং দ্বীনের ক্ষেত্রে তাদের প্রচেষ্টা, আত্মত্যাগ অপরিসীম, কারণ তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশেষ বিশেষ হেদায়াতপ্রাপ্ত। নবীজির অনুপম দীক্ষায় দীক্ষিত। নবী (সা.)-এর মতো তাদের জীবনও ছিল সংগ্রামমুখর, ত্যাগের। ত্যাগের প্রতিটি  মুহূর্তে তিনি এবং তার পরিবার এগিয়ে থাকতেন। অথচ সুযোগ-সুবিধা লাভের প্রতিটা ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকতেন। তিনি সাহাবিদের খাদেম দিয়েছেন। কিন্তু প্রয়োজন সত্ত্বেও আদরের দুলালী কলিজার টুকরা ফাতেমাকে (রা.) তিনি কোনো খাদেম দেননি; বরং তিনি তাকে তাসবিহ ও জিকিরের পাবন্দি করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এটিকে খাদেমের চেয়ে উত্তম বলে বর্ণনা করেছেন। (বুখারি)। মোমিনদের মা নবীপত্নীরাও ছিলেন অল্পেতুষ্ট ও ধৈর্যের উপমা। প্রায়ই অভাব-অনটনে জীবনযাপন করতেন। খায়বার বিজয়ের পরে যখন মুসলমানদের একটু সচ্ছলতা এলো, তখন নবীপত্নীরা-যারা নবীও ছিলেন না, ওহীর ধারকও ছিলেন না, বরং শুধু উম্মত ছিলেন-তাদের অন্তরে মানবস্বভাবসুলভভাবে অন্তরে উদয় হলো, এখন আমাদের খরচায় যৌক্তিক বৃদ্ধি হওয়া উচিত। এ ইচ্ছা নবীজির কাছে পেশ করা হলো। দুনিয়া অন্বেষণের এতটুকু চাহিদাও নবীজির কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াল। এ প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে কিছু আয়াতও নাজিল হলো। সবাইকে তখন নবীজি দুনিয়া ও তার কাছে থাকার ব্যাপারে স্বাধীনতা দিলেন। কিন্তু আয়েশাসহ (রা.) কোনো নবীপত্নী বিলাসিতাকে প্রাধান্য দেননি। সকলেই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

ইবনে মাজাহ (রহ.) স্বীয় গ্রন্থের কিতাবুল ফিতানে ইমাম মাহদি আত্মপ্রকাশ অধ্যায়ের অধীনে একটি বর্ণনা এনেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন, ‘আমরা রাসুলের (সা.) কাছে বসা ছিলাম। তখন বনু হাশেমের কিছু লোক এলো। নবী (সা.) তাদের দেখলেন তখন তাঁর চোখ অশ্রুতে ভরে গেল এবং তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। আমি বললাম, আমরা সর্বদা আপনার চেহারায় এমন কিছু দেখতে পাই, যা আমরা পছন্দ করি না (অর্থাৎ এ অবস্থা আমাদের কষ্টের কারণ) নবী (সা.) বললেন, ‘আমরা সেই পরিবার, যার জন্য আল্লাহ দুনিয়ার বিপরীতে আখেরাতকে বেছে নিয়েছেন। আমার পরে খুব শীঘ্রই আমার পরিবারের অনেক কষ্ট, বহিষ্কার এবং নির্বাসিত জীবনযাপন করতে হবে। এমনকি আগে থেকে কিছু লোক আসবে, যাদের সঙ্গে কালো পতাকা থাকবে। তারা কল্যাণ (ধন-সম্পদ) চাইবে, লোকেরা তাদের দেবে না, তারা তাদের সঙ্গে লড়াই করবে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের সহায্য নেমে আসবে। পরে তারা যা চেয়েছিল তা তাদের দেওয়া হবে অর্থাৎ লোকেরা তাদের ক্ষমতার সম্মতি জানাবে এবং ধন-সম্পদ হস্তান্তর করে দেবে। এ ব্যক্তিরা সে সময় নিজেদের জন্য ক্ষমতা গ্রহণ করবে না। এমনকি আমার আহলে বাইতের একজনকে এ ভান্ডার ও রাজত্ব দেওয়া হবে, সে এ জমিনকে ইনসাফ দ্বারা এভাবে ভরে দেবে, যেভাবে তারা জুলুম দিয়ে ভরে দিয়েছিল। তাই তোমাদের কেউ এ জমানা পেলে ওই লোকদের বাহিনীতে শরিক হবে, যদিও তাকে বরফে হাঁটতে হয়।’

আজ জাতি শতধা বিভক্ত। একক জাতির পরিচয় হারিয়ে গেছে। সব দলই নিজেদের সত্য সঠিক দল মনে করছে, জান্নাতি মনে করছে। এমতাবস্থায় আমাদের সাহাবায়ে কেরাম ও আহলে বাইতের পথ ও পন্থা আঁকড়ে থাকা উচিত। নবীজির সুন্নাহ ও খোলাফায়ে রাশেদিনের পদ্ধতি অনুসারে আমল করা উচিত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে, একটি দল ব্যতীত সবাই জাহান্নামে যাবে। রাসুল (সা.) কে জিজ্ঞেস করা হলো, তারা কোন দল? তিনি বললেন, তারা ওই দল যারা আমি ও আমার সাহাবিদের পথে চলবে।’ (তিরমিজি)।

তামিরে হায়াত থেকে ‘নূর মুহাম্মদ রাহমানী’র ভাষান্তর

Wordbridge School
Link copied!