• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রমজানে সাদকা ও জাকাতের গুরুত্ব


মো. মুরাদ হোসেন এপ্রিল ১৯, ২০২১, ০৭:২১ পিএম
রমজানে সাদকা ও জাকাতের গুরুত্ব

ঢাকা : রহমত, বরকত, মাগফেরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে মুমিনের দরবারে আবারো এসেছে আত্মশুদ্ধি ও ইবাদতের বসন্তকাল হিসেবে খ্যাত মহামান্বিত মাস রমজান। মহান রবের সন্তুষ্টি ও নৈকট্যলাভের উদ্দেশ্যে দিনে রোজা, রাতে নামাজ, নফল ইবাদত, দান-সাদকা ও জাকাত-ফিতরা আদায়ের মাধ্যমে একজন প্রকৃত মুমিন যথাযথ মর্যাদায় পালন করে থাকে মাহে রমজানের আনুষ্ঠানিকতা। মহামান্বিত এ মাসের রোজা মানুষকে ক্ষুধার যন্ত্রণা উপলব্ধি করিয়ে ক্ষুধার্তের ক্ষুধা, গরিব-দুঃখীর দুঃখ, অসহায় মানুষের অসহায়ত্বের বেদনা অনুধাবন করিয়ে শিক্ষা দেয় পারস্পরিক সমপ্রতি, দানশীলতা, উদারতা ও মিতব্যয়িতার। অর্থাৎ শুধু ভোগের মাধ্যমেই সুখ নয় বরং ত্যাগের মধ্যেও রয়েছে আত্মতৃপ্তির সীমাহীন সুখ যা বাস্তবিক অর্থেই রোজা মুমিনদেরকে উপলব্ধি করতে শেখায়। বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য দূরীকরণ, সমাজের ধনী-গরিবের আর্থসামাজিক বৈষম্য পরিহারের লক্ষ্যে ইবাদতের এ মাসে মহান রাব্বুল আলামীন দান-সদকা, জাকাত-ফিতরার মতো সুন্দরতম বিধান ও আমল দিয়েছেন মুমিনদের জন্য। যার অনুসরণ ও অনুকরণের মাধ্যমে একজন মুমিনের পার্থিব ও পরকালীন জীবন সার্থক ও সুন্দর হয়ে ওঠে।

মানবতার সর্বত্তোম আদর্শ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাহে রমজানকে দানের মাস ও পারস্পরিক সমপ্রতির মাস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মুসলিমদেরকে ভাতৃত্বের সমপ্রতি রক্ষায় একে অপরকে আর্থিক সহযোগিতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে উৎসাহিত করাই মাহে রমজানের অন্যতম দিক। হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই এ মাসের মহত্ত্ব বুঝানোর জন্য অন্যান্য মাসের তুলনায় অত্যাধিক পরিমাণে দান-সদকাহ ও সহানুভূতিশীল আচরণ করতেন। কেননা কোনো মানুষের সাথে হাসিমুখে কথা বলা কিংবা সৎ উপদেশের মাধ্যমে সঠিকপথ দেখিয়ে দেওয়াও সদকার সওয়াবের অনুরূপ। মাহে রমজানের একটি নফল ইবাদতকে ফরজের মর্যাদায় সমুন্নত করা হয়েছে। আর একটি ফরজ আদায় করলে ৭০ থেকে ৭০০ কিংবা তারো বেশি পরিমাণ সাওয়াবের কথা বলা হয়েছে হাদিসে। দানের এমন ঈর্ষান্বিত ফজিলত মাহে রমজানেই মুমিনদের জন্য রাখা হয়েছে। তাই প্রতিটি দান-সদকা, জাকাত-ফিতরা আল্লাহর নিকট অগণিত ফরজ হিসেবে গণ্য হয়ে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির পথকে প্রশস্ত করে।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘মানুষের মধ্যে কল্যাণের পথে সবচাইতে বেশি দানশীল ছিলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। রমজান আসলে তাঁর দানের মাত্রা এতই বেড়ে যেত যে, জিব্রাঈল (আ.) রমজানের প্রতি রাতেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। রমজানে নবীজির দানের উদাহরণ প্রবাহিত বায়ুর ন্যায়। বাতাস যেমন সবকিছুকে ছুঁয়ে দেয়, তেমনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দানও সকলের ওপর দিয়ে নির্বিশেষে বয়ে যেত।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১৯২০)

পবিত্র কোরআনে সালাতের পর সামর্থ্যবানদের ওপর জাকাত আদায়কে ফরজ করা হয়েছে। ইসলামে নামাজ ও রোজাকে শারীরিক ইবাদত ও জাকাত-সদকাকে আর্থিক ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়। জাকাত হলো-সারা বছর নিজের ও পরিবারের যাবতীয় খরচ বাদ দিয়ে নিসাব পরিমাণ অর্থাৎ কমপক্ষে সাড়ে ৭ তোলা স্বর্ণ অথবা সাড়ে ৫২ তোলা রৌপ্য অথবা সমমূল্যের নগদ অর্থ বা ব্যবসা পণ্য থাকে, তবে তাঁর সম্পদের শতকরা আড়াই শতাংশ হিসাবে আল্লাহর নির্ধারিত খাতে অসহায়-গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বণ্টন করা। জাকাত গরিবের প্রতি ধনীর অনুগ্রহ নয়; বরং তাদের ন্যায্য অধিকার। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘তাদের (সম্পদশালীদের) ধনসম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতের হক।’ (সুরা আল-জারিআত, আয়াত-১৯) জাকাত দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময়ের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও রমজান মাসই জাকাত প্রদানের সর্বোত্তম সময়। বিত্তবানদেরকে দান-সাদকাও জাকাত-ফিতরা প্রদানে উৎসাহিত করা হয়েছে এ মাসে। কেননা রমজান মাসে দান-সাদকা করলে অন্য সময়ের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি সওয়ার হয়। তাই রমজান মাসে রোজাদার মুমিন বান্দারা গরিবের হক দান-সাদকাহ ও জাকাত-ফিতরার মতো আর্থিক ইবাদত করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। দারিদ্র্য দূরীকরণ ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে জাকাত ও সাদকাহ শ্রেষ্ঠতম উপায়। রোজাদার ধনী লোকেরা অসহায়দের জাকাত প্রদান করার ফলে সমাজের গরিব-নিঃস্ব ব্যক্তিরা দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে রেহাই পাবে এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিও হবে। রমজান মাসে ধনী লোকেরা দরিদ্রদের জাকাত প্রদানের ফলে উভয় শ্রেণির মানুষের মধ্যে লেনদেন হয় এবং পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে উঠে যার ফলে উভয়ই বেশ উপকৃত হয়। তবে দান-সাদকা ও জাকাত-ফিতরা দিতে হবে মহান রবের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। তাতে থাকবে না কোনো লৌকিকতা ও সুনাম অর্জনের ইচ্ছা। দানগ্রহীতাকে দানের প্রেক্ষিতে খোঁটা দেওয়া বা দান উপলক্ষে যে কোনো ধরনের কাজ বা উদ্দেশ্য হাসিল করা থেকে বিরত থাকতে হবে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা খোঁটা ও কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে তোমাদের দানকে বাতিল করো না সে ব্যক্তির মতো যে, তার সম্পদ ব্যয় করে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে এবং বিশ্বাস করে না আল্লাহ ও পরকালকে।’ (সুরা বাকার, আয়াত-২৬৪)

দান-সাদকাহ এমন একটি আর্থিক আমল যা মৃত্যুর পরেও চলতে থাকে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘মানুষের মৃত্যুর পর সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তিনটি আমল অবশিষ্ট চালু থাকে। ক. সদকায়ে জারিয়া। যা মহান রবের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য নিঃস্বার্থভাবে দেওয়া হয়। খ. ইলম, যার দ্বারা মানুষের উপকার হয়। গ. সুসন্তান, যে পিতামাতার জন্য দোয়া করে।’ (সহিহ মুসলিম) হজরত কাআব ইবনে উজরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দান-সদকাহ পাপকে এমনভাবে নিভিয়ে দেয় যেভাবে পানি আগুন নিভিয়ে দেয়।’ (তিরমিজি)

আর্থিক ইবাদত, অর্থপ্রদানকারী ব্যক্তির জন্যই লাভ এতে তাঁর গুনাহ মাফ হয় এবং অগনিত সওয়াব আমলনামায় জমা হয়। মহান রব আমাদেরকে আর্থিক ইবাদতে উৎসাহিত করে বলেন, ‘যারা আল্লাহর পথে নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে তাদের উপমা একটি শস্য বীজের মতো, যা উৎপন্ন করে সাতটি শীষ, প্রতিটি শীষেই  (উৎপন্ন হয়) একশত করে শস্য এবং আল্লাহ যাকে চান তাঁর সম্পদ বহুগুণে বাড়িয়ে দেন। আল্লাহ অতি দানশীল ও মহাজ্ঞানী।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-২৬১) জাকাত-সাদকার মতো আর্থিক ইবাদত মুমিনের বিপদ-আপদ বালা-মুসিবত ও ব্যক্তির অন্তরে হাতাশা দূর করে শান্তিতে বসবাসে সহায়তা করে এবং জীবনের আয়ু বৃদ্ধি করে অপমৃত্যু থেকে রক্ষা করে। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে যদি রোজাদারের অন্তরে তাকওয়া, খোদাভীরুতা, দানশীলতা ও পারস্পরিক কল্যাণকামিতার গুণাবলি সৃষ্টি না হয়, তাহলে বুঝতে হবে তার রোজা পালন নিছক উপবাস ছাড়া আর কিছুই নয়। যে ব্যক্তি শুধু রোজা পালন করে কিন্তু আল্লাহর রাস্তায় দান-সাদকা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সমাজের গরিব-দুঃখীদের অভাব দূরীকরণ তথা দারিদ্র্য বিমোচনে তার হাত সমপ্রসারিত না করে, সে রমজানের দাবি পূরণে ব্যর্থ হয় এবং রমজানের রহমত থেকেও বঞ্চিত হয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, একজন কৃপণ ইবাদতকারীর চেয়ে একজন মূর্খ দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। সাধারণভাবে ইসলাম আর্থিক ভারসাম্য বিধানকারী এমন একটি সফল ব্যবস্থার নাম। যেখানে আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিকে বলা হয়েছে ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে আসা ব্যক্তি কিছু চাইলে তাকেও ফিরিয়ে না দিতে। ভিখারিকেও বলা হয়েছে অন্যের কাছে হাত পাতা থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকতে। অর্থাৎ দানকারী ও দানগ্রহণকারীর মাঝে ভারসাম্যতা বিধান দিয়েছে। যার অনুসরণে সমাজে দারিদ্র্যতা হ্রাস পেয়ে ভাতৃত্ববোধ বৃদ্ধি পাবে। মাহে রমজান আমাদেরকে যতগুলো ইবাদত ও সৎকাজ করার রাস্তা দেখায় তার মধ্যে জাকাত ও সাদকাহ আদায় হলো অন্যতম। যারা প্রাচুর্য ও দুনিয়ার মোহে জীবনযাপনে ব্যস্ত তাদেরকে ক্ষুধা ও পিপাসার যন্ত্রণা বুঝিয়ে দিয়ে অসহায় মানুষদের অধিকার ও কল্যাণে এগিয়ে আসতে অনুপ্রাণিত করে পারস্পরিক সমপ্রতির মাস রমজান। তাই গরিব-দুঃখীদের প্রতি দানের হাত প্রসারিত করে তাদের অভাব মোচেন এগিয়ে আসা মুমিন হিসেবে আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ব।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
কার্যকরী সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ লেখক ফোরাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা
[email protected]

Wordbridge School
Link copied!