• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

যে রাতের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন আল্লাহ


ধর্মচিন্তা ডেস্ক এপ্রিল ৬, ২০২৪, ০২:২৭ পিএম
যে রাতের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন আল্লাহ

ঢাকা : মহান আল্লাহ একটি রাতের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বছরের একটিমাত্র রাত। সে রাত মর্যাদাসম্পন্ন। হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। শেষ ঐশীগ্রন্থ অবতরণের সূচনা সে রাতে। সে রাতে সংখ্যাতীত ফেরেশতা আগমন করেন পৃথিবীবাসীর অদৃষ্ট ভাগ্য নিয়ে, যা অবধারিত করেছেন মহান আল্লাহ। মহান আল্লাহ সে রাতের নাম দিয়েছেন লাইলাতুল কদর। আমাদের ভাষায় শবেকদর বা ভাগ্য রজনী।

চলছে ছাব্বিশতম রোজা। আজ সূর্যাস্তের পর শুরু হবে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম ও মহিমান্বিত রজনী শবেকদর। যদিও কোথাও স্পষ্ট করে বলা নেই শবেকদর সম্পর্কে। তারপরও ইসলামি চিন্তাবিদ ও বুজুর্গরা নিজস্ব ইজতিহাদ, গবেষণা ও গাণিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে রমজানের ২৭তম রাতে লাইলাতুল কদর হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা জোর দিয়ে বলে গেছেন। সে হিসাবে রমজানের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতকে লাইলাতুল কদর হিসেবে একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।

কোরআনের বিভিন্ন আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় শবেকদর রমজান মাসে। কিন্তু এর সঠিক তারিখ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় না। ইসলামি স্কলাররা বিভিন্ন হাদিস পর্যালোচনা করে বলেন, শবেকদর রমজান মাসের শেষ দশ দিনের মধ্যে আসে। কিন্তু এরও কোনো তারিখ নির্দিষ্ট নেই। বরং যেকোনো রাতে হতে পারে। আবার প্রত্যেক রমজানে তা পরিবর্তিতও হতে পারে। তবে শবেকদর হওয়ার অধিক সম্ভাবনা রয়েছে রমজানের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রমজান মাসের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করো।’ (সহিহ বোখারি)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর তালাশ করো।’ (সহিহ মুসলিম ১১৬৯)

আলেমদের বড় এক জামাত, কতক মুজতাহিদ ইমাম এবং কতক সাহাবায়ে কেরামের মতে শবেকদর রমজানের ২৭তম রাতে। এ বিষয়ে হাদিসের বর্ণনাও রয়েছে। হজরত জির ইবনে হুবাইশ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘আমি উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে বললাম, আপনার ভাই আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি সারা বছর রাত জাগরণ করবে সে শবেকদরের সন্ধান পাবে। এ কথা শুনে উবাই ইবনে কাব বললেন, আল্লাহ তার ওপর রহম করুন। এর দ্বারা তিনি এ কথা বোঝাতে চাচ্ছেন যে, লোকেরা যেন শুধু একটি রাতের ওপর ভরসা করে বসে না থাকে। অথচ তিনি অবশ্যই জানেন, শবেকদর রমজান মাসের শেষ দশ দিনের মধ্যে, ২৭তম রজনীতে। অতঃপর তিনি দৃঢ় শপথ করে বললেন, শবেকদর ২৭তম রজনীতে। জির ইবনে হুবাইশ তাকে বললেন, আপনি কীসের ভিত্তিতে বলছেন শবেকদর ২৭তম রজনীতে? উবাই ইবনে কাব বললেন, বিভিন্ন আলামত ও নিদর্শনের ভিত্তিতে, যে সম্পর্কে রাসুল (সা.) আমাদের অবহিত করেছেন।’ (সহিহ মুসলিম ২৬৬৭)

শবেকদরের বিভিন্ন নিদর্শন সম্পর্কে হাদিসের বর্ণনা রয়েছে। তা হলো, এ রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না, নাতিশীতোষ্ণ হবে, মৃদু বাতাস প্রবাহিত হতে থাকবে, মানুষ ইবাদত করে তৃপ্তিবোধ করবে। সকালে হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে, যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মতো। কোনো ইমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ স্বপ্নে হয়তো তা জানিয়েও দিতে পারেন। এ ছাড়া শবেকদরের রাতে বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে।

হাদিসের এসব বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায়, রমজানের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে শবেকদর হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। আর রমজান শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত এ সম্ভাবনা থেকেই যায়। তাই আজকের রাতের ন্যায় পরবর্তী বেজোড় রাতেও কদরের রাতের আশায় ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকা দরকার।

শবেকদর হচ্ছে অন্তরের যাবতীয় ময়লা-আবর্জনা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে মহান আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হওয়ার রাত। যারা কদরের রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত-বন্দেগি করেন, আল্লাহতায়ালা তাদের নাম পুণ্যবানদের তালিকাভুক্ত করে নেন। কদরের রাতের ইবাদত এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, রাসুল (সা.) দুর্বল ও অপারগ ব্যক্তিদেরও এ রাতের ইবাদত-বন্দেগিতে মগ্ন থাকতে বলেছেন।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশ দিনে শবেকদর অনুসন্ধান করো। তোমাদের কেউ যদি দুর্বল অথবা অপারগ হয়ে পড়ে, তবে সে যেন শেষের সাত রাতে অলসতা না করে।’ (সহিহ মুসলিম ২৬৫৫)

শবেকদর অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও মহিমাময় একটি রাত। এই রাত হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এই রাতের ইবাদত-বন্দেগির মর্যাদাও এক হাজার মাসের রাত্রিগুলোতে ইবাদত-বন্দেগির চেয়ে বেশি। আল্লাহতায়ালা এ রাতে বান্দার তওবা কবুল করেন, বান্দাদের ব্যাপকহারে ক্ষমা করেন এবং বান্দাদের মাঝে অফুরান কল্যাণ দান করেন।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইমান ও সওয়াবের আশায় কদরের রাতে নামাজ আদায় করতে দাঁড়াবে, তার পূর্ববর্তী সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (সহিহ মুসলিম ৭৬০)

অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘এতে (রমজানে) এমন এক রাত রয়েছে, যা হাজার মাস থেকেও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে সে যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে।’ (মুসনাদে আহমাদ ২২৩০)

শবেকদরের বরকত ও কল্যাণ প্রাপ্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজন বেশি বেশি তওবা ইস্তেগফার পড়া, নফল নামাজ পড়া, কোরআন তিলাওয়াত করা, জিকির-আজকার করা, দান-খয়রাত করা, দুরুদ শরিফ পড়া, পরিবার-পরিজন ও মা-বাবার জন্য দোয়া করা, মৃতদের জন্য মাগফিরাত কামনা করা, কবর জিয়ারত করা, রাতে তারাবির নামাজ পড়া, শেষ রাতে সাহরির আগে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া। এভাবে সারা রাত ইবাদতে কাটানো কাম্য। তবেই মহিমান্বিত এ রাতের ফজিলত ও বরকত দ্বারা উপকৃত হওয়া যাবে। এ ছাড়া কদরের রাতে রাসুল (সা.) বিশেষ দোয়া পাঠ করার কথা বলেছেন। তা হলো ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন কারিমুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি।’ অর্থাৎ হে আল্লাহ, আপনি মহানুভব ক্ষমাশীল এবং ক্ষমা করতে পছন্দ করেন। অতএব আমাকে ক্ষমা করুন। (সুনানে তিরমিজি ৩৫১৩)

কদরের রাত এ কারণেও গুরুত্বপূর্ণ যে, এই রাতে মানুষের পুরো বছরের ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়। মানুষের পরবর্তী এক বছরের ভাগ্য, অর্থাৎ তার সামনে যা যা আসবে বা তার জীবনে যা কিছু ঘটবে, সেসব নির্ধারণ করা হয়। তার বেঁচে থাকা কিংবা মৃত্যু, তার ভালো-মন্দ, তার রুটি-রুজি ইত্যাদি বিষয় নির্ধারণ করা হয় এই রাতে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘(কদরের) এই রাতে প্রত্যেক হেকমতপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।’ (সুরা দোখান ৪)

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘তুমি কোনো মানুষকে বাজারে হাঁটাচলা করতে দেখবে। অথচ তার নাম মৃতদের তালিকায়। তারপর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করে বলেন, প্রতি বছরই এ বিষয়গুলো নির্ধারিত হয়ে যায়।’ (মুসতাদরাকে হাকিম ২/৪৪৮)

মহান আল্লাহ কদরের রাতকে বলেছেন শান্তিময়। এ রাতে পৃথিবী আবৃত হয় শান্তির পালকে। যার ব্যাপ্তি সন্ধ্যা থেকে ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত। হয়তো আকাশে সেই শান্তির পালক মেঘ হয়ে উড়ছে। বর্ষণ শুরু হবে সন্ধ্যার পর। অব্যাহত থাকবে ফজর পর্যন্ত। এ সময়ে বিশুদ্ধচিত্তে গভীর একাগ্রতায় মহান আল্লাহর ধ্যান ও ইবাদতে মশগুল হলে আমরাও সিক্ত হব সেই শান্তির বর্ষণে।

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!