• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে কেন এত উন্মাদনা


আবু সাদাত, ডয়চে ভেলে বাংলা নভেম্বর ২৪, ২০২২, ০২:২২ পিএম
বাংলাদেশে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে কেন এত উন্মাদনা

বাংলাদেশের মানুষের ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা বেশ পুরোনো। অর্থাৎ স্বাধীনতারও আগে থেকে ক্লাব ফুটবল বেশ জনপ্রিয় ছিল এই অঞ্চলে। সেটা অব্যহত ছিলো ৯০ এর দশক পর্যন্ত৷ বর্তমান প্রজন্মের কাছে ব্যাপারটা একটু অবিশ্বাস্যই মনে হতে পারে৷ অথচ সে সময় আবাহনী-মোহামেডানের একটা ম্যাচকে কেন্দ্র করে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যেত পুরো দেশ। বাড়িতে বাড়িতে উড়তো দুদলের পতাকা। খেলাকে কেন্দ্র করে ঝগড়াঝাটি, এমনকি মারামারি পর্যন্ত হতো আবাহনী-মোহামেডান সমর্থকদের মধ্যে।

বাড়ির ছাদ, বারান্দা, কিংবা পাড়া মহল্লার অলিগলি। সবখানে পতপত করে উড়তে থাকে হাজার হাজার মাইল দূরের দেশ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি কিংবা স্পেনের পতাকা।

এই তো সপ্তাহ দুয়েক আগে অফিসের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে চোখ আটকে গেলো পাশের বাসার ছাদে৷ বিশাল আকৃতির জার্মানির পতাকা। ওপরে অবশ্য ছোট করে বাংলাদেশের পতাকাও আছে। কিন্তু আমি খানিকটা অবাক হয়েছি, পতাকাটা জার্মানির বলে৷ কারণ বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ যেখানে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলে বিভক্ত, সেখানে জার্মান ভক্তের এমন সরব উপস্থিতি।

বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে এই উন্মাদনা যে শুধু ঢাকা কেন্দ্রিক, তা কিন্তু নয়৷ গত সপ্তাহে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে মিন্টু নামের একজন শখের বাগান বিক্রি আর স্ত্রীর জমানো মোট ৫ লাখ টাকা দিয়ে নিজের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত সাড়ে চার কিলোমিটার লম্বা দক্ষিণ কোরিয়ার পতাকা টানিয়েছেন। একই শহরে একজন তার পাঁচতলা বাড়ি ব্রাজিলের পতাকার রংয়ে রাঙিয়েছেন। মোটকথা বিশ্বকাপ শুরুর সময় যত ঘনিয়ে আসছে, উন্মাদনা ততোই বাড়ছে।

ক্রীড়া সাংবাদিকতায় আসার আগে থেকেই আমি আর্জেন্টিনার ভক্ত৷ কিন্তু সেদিন আমার পাঁচ বছর বয়সি মেয়ে শব্দ-কে জিজ্ঞেস করলাম, মা, তোমার কোন দল ভালো লাগে, ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা? ওর মা পাশে ছিল বলেই কিনা বেশ চটপট উত্তর দিলো আমি ব্রাজিলের সাপোর্টার৷ কেন, জানতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, তার জবাব, 'মা ব্রাজিলের সাপোর্টার তাই আমিও।'

আমার ধারণা বিশ্বকাপ নিয়ে এই যে বিভক্তি, এটা শুধু আমার বাসায় না। খেলা যারা পছন্দ করে এমন সবখানে।

হাজার হাজার মাইল দূরের অচেনা-অজানা এই দেশগুলোকে নিয়ে বাংলাদেশিদের এই যে আবেগের বহি:প্রকাশ, তা দেখে প্রায়ই মনে প্রশ্নে জাগে, কেন এমন আবেগী আর জোড়ালো সমর্থন৷ শুধু কি একজন মেসি, নেইমার কিংবা রোনালদোর কারণেই এতোটা মাতামাতি, নাকি অন্য কিছু!

এই কারণ খোঁজার আগে চলুন জানার চেষ্টা করি, ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের এই যে আগ্রহ আর উন্মাদনা ঠিক কবে থেকে শুরু। এটা একেবারে দিন তারিখ নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না।  তবে বাংলাদেশের মানুষের ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা বেশ পুরোনো৷ অর্থাৎ স্বাধীনতারও আগে থেকে ক্লাব ফুটবল বেশ জনপ্রিয় ছিল এই অঞ্চলে৷ সেটা অব্যহত ছিলো ৯০ এর দশক পর্যন্ত।

বর্তমান প্রজন্মের কাছে ব্যাপারটা একটু অবিশ্বাস্যই মনে হতে পারে৷ অথচ সে সময় আবাহনী-মোহামেডানের একটা ম্যাচকে কেন্দ্র করে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যেত পুরো দেশ৷ বাড়িতে বাড়িতে উড়তো দুদলের পতাকা। খেলাকে কেন্দ্র করে ঝগড়াঝাটি, এমনকি মারামারি পর্যন্ত হতো আবাহনী-মোহামেডান সমর্থকদের মধ্যে।

কিন্তু ফুটবল কর্তাদের সূদুর প্রসারী কোনো পরিকল্পনা না থাকায়, কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে বাংলাদেশের ক্লাব ফুটবলের সেই সোনালী অধ্যায়৷ স্তিমিত হয়ে গেছে ঘরোয়া ফুটবল নিয়ে সাধারন মানুষের উন্মাদনা। কিন্তু নিজেদের রক্তে ফুটবলের মোহনীয় জাদুর যে স্পর্শ সেসময় পেয়েছিল বাঙালি, তা কি কখনো ভোলা যায়? একদমই না।

আমার ধারনা ফুটবল নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের এই উন্মাদনা তা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়ার মূল কারিগর আর্জেন্টিনার দিয়েগো ম্যারাডোনা। তবে তার সঙ্গে আরও একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ তা টেলিভিশনে খেলা দেখানো। এ নিয়েই সেদিন কথা হচ্ছিলো ফুটবল কোচ সাইফুল বারী টিটুর সঙ্গে৷ তিনি তার স্মৃতি হাতরে মনে করছিলেন সেসব দিনের কথা৷ বলছিলেন, বিটিভির পর্দায় ১৯৮২ সালের সেই বিশ্বকাপ এখনো চোখের সামনে ভাসে। একদিকে আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা, অন্যদিকে ব্রাজিল দলে জিকো, সক্রেটিসের মতো ফুটবলারদের নৈপুণ্য৷ সঙ্গে ঐ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন দল ইতালির পাওলো রসির খেলা এখনো নাকি স্পষ্ট দেখতে পান সাইফুল বারী টিটু।

তবে তার মতে, এসব খেলোয়াড়দের বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যেতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে টেলিভিশন।

টিটুর সঙ্গে আমিও পুরোপুরি একমত। আমার কাছে সবসময়ই মনে হয়, ম্যারাডোনার সেই চোখ ধাঁধানো নৈপুণ্যের সঙ্গে, ব্রাজিলের শৈল্পিক ফুটবল৷ সবমিলিয়ে লাতিন ফুটবলের প্রতি আরো বেশি বুদ হয়ে যায় বাংলাদেশিরা।

পেলে-ম্যারাডোনার রেখে যাওয়া সেই ব্যাটন উঠেছে লিওলেন মেসি আর নেইমারদের হাতে৷ যাদের পায়ের যাদুতে তাবত পৃথিবীর ফুটবলপ্রেমীদের মতোই মুগ্ধ বাংলাদেশিরা।

তারপরও মনে একটা প্রশ্ন চলেই আসে৷ তা হলো, মেসি অনেক বড় খেলোয়াড় তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু ম্যারাডোনার যে জাদু সেটাকে কি ছাপিয়ে যেতে পেরেছেন মেসি? আবার সাফল্যের প্রয়োজনে মাঠের সেই শৈল্পিকতাকে বিদায় জানিয়েছে ব্রাজিল৷ তারপরও কেন, বাংলাদেশের মানুষ এতোটা আবেগী এই দুটো দলকে নিয়ে৷ এর কয়েকটি যুক্তিযুক্ত কারণও আছে।

প্রথমত, দেশের ফুটবলে বলার মতো সাফল্য নেই। আবার নিকট ভবিষ্যতে যে সাফল্য আসবে তার ছিটেফোঁটা কোন লক্ষণও নেই। আবার দেশের ক্লাব ফুটবলের অবস্থাও বিবর্ণ, আকর্ষণহীন। ফলে দৈনন্দিন জীবনে নানামুখী সমস্যার সঙ্গে লড়াই করতে থাকা আমার মতো অসংখ্য মানুষ বিনোদনের উপায় খুঁজতে গিয়ে সারাবছর রাত জেগে দেখি ইউরোপের ক্লাব ফুটবল৷ আর চার বছর পরপর আসা বিশ্বকাপ তো আমাদের কাছে  রীতিমতো ঈদের আনন্দের চেয়ে বেশি মনে হয়।

দ্বিতীয়ত, কাগজে কলমে বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকলেও, বাস্তবতা পুরোপুরি উল্টো। মন খুলে রাজনীতি, ধর্ম কিংবা নিজের সমস্যা নিয়ে কথা বলতেও আমরা ভয় পাই। অথচ দলমতের ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করাতে পারে শুধুমাত্র ক্রিকেট আর ফুটবলই। শুধু তাই না, ঘোরতর শত্রুর সামনেও গলা উচিয়ে জানাতে পারি নিজের পছন্দ আর অপছন্দের কথা।

আবার জাতিগত ভাবে আমরা বাংলাদেশিরা এমনিতেই খানিকটা উৎসব প্রেমী। উপলক্ষ পেলে, হাজারো সমস্যার মধ্যেও, আনন্দ খুঁজি নানাভাবে৷ যা অবশ্যই ইতিবাচক৷ তাই চার বছর পরপর আসা এই বিশ্বকাপ যদি কিছুসময়ের জন্যে হলেও কমিয়ে আনে শত্রু আর মিত্রের দূরত্ব, তবে আনন্দেই কাটুক না আগামী একমাস। তাতে জয় হবে ফুটবলেরই।

সোনালীনিউজ/এম

Wordbridge School
Link copied!