• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

রূপকথার গল্প লিখে উচ্ছ্বাস-গর্বের জোয়ারে ভাসছে লেভারকুজেন


ক্রীড়া ডেস্ক এপ্রিল ১৫, ২০২৪, ১১:২৪ এএম
রূপকথার গল্প লিখে উচ্ছ্বাস-গর্বের জোয়ারে ভাসছে লেভারকুজেন

ঢাকা : সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছিলেন শাবি আলোন্সো। ‘অবিশ্বাস্য’, ‘অসাধারণ’, ‘গর্ব’- এই ধরনের কথাগুলি বারবার উঠে আসছিল তার কণ্ঠে। হঠাৎই কক্ষে হইচই। দলবেঁধে হইচই করতে করতে সেখানে ঢুকে গেলে বায়ার লেভারকুজেনের ফুটবলাররা। বিয়ায়ের ছিটিয়ে, বিশাল জগ থেকে বিয়ার ঢেলে তারা ভাসিয়ে দিতে চাইলেন কোচকে। আসলে বিয়ার নয়, তা যেন উচ্ছ্বাসের জোয়ার!

লেভারকুজেনের মাঠের ভেতরেও তখন বইছে আনন্দের সেই স্রোত। সবুজ ঘাসের মাঠের এক চিলতেও দেখা যাচ্ছিল না। ম্যাচ শেষ হতেই ৩০ হাজারের বেশি দর্শক নেমে যান মাঠে। লাল-কালো জার্সি গায়ে দর্শকে ঢেকে যায় গোটা আঙিনা। এমন আনন্দ, এত উৎসব, এই মুহূর্তটির অপেক্ষা কত বছর ধরে করে আসছে এই ক্লাবটি!

সুনির্দিষ্ট করে বললে ১২০ বছর। সেই ১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ক্লাব একটু একটু করে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে জার্মান ফুটবলে। আলাদা পরিচিতি গড়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্ত শত বছর পেরিয়েও লিগ শিরোপার স্বাদ কখনও পায়নি। সেই অধরা সাফল্যই এবার ধরা দিয়েছে শাবি আলোন্সোর কোচিংয়ে জাদৃকরি সাফল্যে।

এই মৌসুমের আগে ক্লাবের ইতিহাসের সোনালি সময় ছিল ১৯৯৬-৯৭ থেকে পরের ছয় মৌসুম। এই সময়টায় চারবার বুন্ডেসলিগায় রানার্স আপ হয় তারা। একবার রানার্স আপ হয় জার্মান কাপে। এমনকি চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও ফাইনালে উঠে শেষ পর্যন্ত হেরে যায় রেয়াল মাদ্রিদের কাছে। ক্লাবের এই স্বর্ণালী সময়ের ইতিহাসও তাই মূলত বেদনায় গাঁথা অপ্রাপ্তির গল্প। বারবার কাছে গিয়েও চূড়ান্ত সাফল্য না পাওয়ায় কৌতূক করে তাদের নামে দেওয়া হয় ‘নেভারকুজেন’, যাদেরকে দিয়ে কখনোই সম্ভব নয়।

কিন্তু আলোন্সো আর তার দল সেই ইতিহাস পাল্টে দিল। ক্লাবকে তারা এনে দিলেন ১২০ বছরের ইতিহাসের সেরা সাফল্য।

২০২২ সালের অক্টোবরে যখন ক্লাবের হাল ধরেন শাবি, লেভারকুজেন তখন ভয়ানকভাবে ধুঁকছে। বুন্ডেসলিগার পয়েন্ট তালিকায় তাদের অবস্থান ছিল ১৭তম। শাবির জন্য সেটিই ছিল শীর্ষ পর্যায়ের কোনো ক্লাবের প্রথম দায়িত্ব। কোচিং অভিজ্ঞতা বলতে ছিল রেয়াল সোসিয়াদাদের ‘বি’ দলের হয়ে তিন বছর কাজ করা। সেই শাবির কোচিংয়েই রেলিগেশনের শঙ্কা উড়িয়ে লেভারকুজেন মৌসুম শেষ করে ষষ্ঠ স্থানে থেকে।

উত্থানের সেই গল্প নতুন উচ্চতায় পৌঁছে যায় এই মৌসুমে। শাবির কোচিংয়ে লেভারকুজেন হয়ে ওঠে অজেয় ও অপ্রতিরোধ্য। একের পর এক ম্যাচ জিতে, রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ে শেষ পর্যন্ত পাঁচ ম্যাচ বাকি থাকতেই তারা নিশ্চিত করে ফেলল শিরোপা জয়। লেভারকুজেনের ১২০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবার বুন্ডেসলিগা চ্যাম্পিয়ন !

প্রথমবারের মতো পুরো মৌসুমের দায়িত্ব পালন করেই শাবি ক্লাবকে এনে দিলেন অনির্বচনীয় সাফল্য।

ট্রফির সুবাস নিয়েই রোববার নিজেদের মাঠে খেলতে নামে লেভারকুজেন। জিতলেই শিরোপা নিশ্চিত, এই সমীকরণে জেনে মাঠে নেমে ভার্ডার ব্রেমেনকে বিধ্বস্ত করে তারা ৫-০ গোলে। পাঁচ ম্যাচ বাকি থাকতে বায়ার্ন মিউনিখের সঙ্গে পয়েন্টের ব্যবধান হয়ে যায় ১৬। থমকে যায় বুন্ডেসলিগায় বায়ার্ন মিউনিখের টানা ১১ বছরের শ্রেষ্ঠত্ব।

বুন্ডেসলিগায় রেকর্ড ২৯ ম্যাচ ধরে অপরাজিত লেভারকুজেন। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে জার্মান কোনো দলের রেকর্ড অপরাজেয় যাত্রা তারা পৌঁছে নিয়েছে ৪৩ ম্যাচে।

কয়েক রাউন্ড আগে থেকেই আসলে নিশ্চিত হয়ে যায়, এবার ট্রফি জিততে চলেছে লেভারকুজেন। তার পরও বারবার সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন আলোন্সো। শিরোপা জয় নিশ্চিত হওয়ার পর অবশ্য উচ্ছ্বাস আর চাপা দিলেন না তিনি।

“ক্লাবের জন্য এটি স্পেশাল এক মুহূর্ত। ১২০ বছর পর বুন্ডেসলিগা জিততে পারা মানে অসাধারণ কিছু একটা। ছেলেরা পারফর্ম করছে, একতাবদ্ধ হয়ে শীর্ষ মানের দল গড়ে তুলেছে। ওদেরকে নিয়ে আমি গর্বিত। এখানে কাজ করতে পারাটা আমার জন্য সম্মানের।”

“সবাই, দলের প্রতিটি বিভাগ একসঙ্গে কাজ করে লড়াই করেছে শিরোপার জন্য। অনেক বছরের কঠোর পরিশ্রমের ফসল এটি। ক্লাবের বড় সাফল্য উদযাপনের সময় এটি। প্রথম কোনো কিছু সবসময়ই সবার জন্য স্পেশাল। আমরা গর্ব নিয়ে বলতে পারি, বায়ার লেভারকুজেনের ইতিহাসের এমন একটি বড় দিনের অংশ ছিলাম। এই অনুভূতি অবিশ্বাস্য।”

মৌসুম শুরুর আগে লেভারকুজেনের শিরোপা জয় তো কারও ভাবনার সীমানায় থাকারই কথা নয়। সেই অকল্পনীয় সাফল্যই পেয়েছে আলোন্সোর দল। সেটিও প্রবল দাপটে। বছরের পর বছর ধরে বায়ার্ন মিউনিখ যেভাবে বিশাল ব্যবধানে বুন্ডেসলিগা জিতে এসেছে, এবার সেরকম ব্যবধানেই বায়ার্নকে পেছনে ফেলেছে তারা।

এমন দাপুটে পথচলায় ট্রফি জিততে পারা বাড়তি তৃপ্তি দিচ্ছে আলোন্সোকে।

“আমরা এই মৌসুমে খেলতে চেয়েছিলাম ভালো মানসিকতা নিয়ে এবং ছেলেরা বেশ দ্রুতই একসঙ্গে কার্যকর খেলা শুরু করে দেয়। কয়েকটি ম্যাচ যাওয়ার পর আমরা দেখলাম, এই দলটি সত্যিই দুর্দান্ত ফুটবল খেলতে পারে।”

“তবে এভাবে এই অর্জন (শিরোপা) ছুঁয়ে ফেলা মানে শীর্ষ মানের… অসাধারণ। অবশেষে আমরা বলতে পারছি যে, বায়ার লেভারকুজেন এখন জার্মান চ্যাম্পিয়ন। আমাদের সবার জন্যই এটা বড় সম্মানের। এই দল, এই ক্লাব ও সমর্থকদের এটা দারুণভাবে প্রাপ্য।”

মৌসুমের শুরু থেকে লেভারকুজেন দারুণ খেললেও একটা সময় পর্যন্ত বায়ার্নও ছিল নাগালেই। গত ১০ ফেব্রুয়ারি বায়ার্নের বিপক্ষে ম্যাচের আগে আলোন্সোর দল এগিয়ে ছিল কেবল দুই পয়েন্টে। ওই ম্যাচ জিতে পাঁচ পয়েন্টে এগিয়ে যায় তারা। এরপর ব্যবধান কেবল বাড়তেই থাকে।

আলোন্সো বললেন, ওই ম্যাচের পরই শিরোপার ছবি আঁকতে শুরু করেছিলেন তারা।

“বায়ার্নের বিপক্ষে ঘরের মাঠের সেই ম্যাচটি… এমনও হতে পারত, ওরা আমাদেরকে টপকে যেতে পারত। কিন্তু আমরা তা হতে দেইনি। এরপরই আমরা জানতাম। ড্রেসিং রুমে আমরা কেউ এটা নিয়ে খুব একটা আলোচনা করিনি। কিন্তু আমাদের ভাবনায় ঠিকই ছিল। আমরা সবাই জানতাম।”

এবারের লিগের ২৯ ম্যাচের ২৫টিতেই জিতেছে লেভারকুজেন, ড্র করেছে বাকি চারটি। গোল করেছে ৭৪টি, হজম করেছে কেবল ১৯টি। মৌসুমজুড়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বেশ কয়েকবার তারা পরাজয় বা পয়েন্ট হারানোর কাছাকাছি ছিল। কিন্তু শেষ দিকে অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে জিতে গেছে শেষ পর্যন্ত। সেই কৃতিত্ব ফুটবলারদেরই দিলেন কোচ।

“যে ধারাবাহিকতা আমরা দেখিয়েছি, মৌসুমজুড়ে যে মানের ফুটবল খেলেছি, আমরা এই সাফল্য অর্জন করে নিয়েছি। কাজটা সহজ ছিল না। তবে আমরা প্রতিটি দিনে থাকতে চেয়েছি, যা আমাদেরকে বিশ্বাস জুগিয়েছে।”

“অবিশ্বাস্য একটি দল এটি। ছেলেরা সবাই এত পরিশ্রম করেছে… এমনকি তরুণ ছেলেরাও। সবাই কঠোরভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে। আমাদের এই সাফল্যের ওজন বুঝতে আরও কিছুটা সময় হয়তো লাগবে, তবে আপাতত আমরা এই সাফল্য উপভোগ করতে চাই।”

এই মৌসুমে আরও সাফল্যের হাতছানি আছে আলোন্সোর দলের। জার্মান কাপের ফাইনালে উঠে গেছে তারা। এখানে তাদের একমাত্র শিরোপাটি এসেছিল সেই ১৯৯২-৯৩ মৌসুমে। ইউরোপা লিগের কোয়ার্টার-ফাইনালের প্রথম লেগে ২-০ গোলে জিতে সেমি-ফাইনালের পথে এগিয়ে আছে তারা। এখানে তাদের একমাত্র শিরোপাটি এসেছিল ১৯৮৭-৮৮ মৌসুমে (তখনকার উয়েফা কাপ)। এই দুই আসরেই এখন ফেভারিট তারা।

লিগ জয়ের উৎসবের পাশাপাশি সামনের হাতছানির কথাও দলকে মনে করিয়ে দিলেন কোচ।

“তীব্র লড়াইয়ের মৌসুম ছিল এবং এখনও তা শেষ হয়নি। আমাদের তা ভুলে গেলে চলবে না। এটা(লিগ শিরোপা) এখন আমাদের জন্য অতীত এবং এখনও এই মৌসুমে বড় লক্ষ্য আছে আমাদের সামনে।”

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!