ঢাকা : আমি বিসিএস (প্রশাসন), ৮৬ ব্যাচের এক জন কর্মকর্তা। ১৯৮৯ সালের ২০ ডিসেম্বর সহকারী কমিশনার হিসেবে সুনামগঞ্জ জেলায় যোগদান করি। মাহমুদ হাসান যোগদান করেন পঞ্চগড় জেলায়। চাকরিতে যোগদানের আগে মাহমুদ হাসানের সঙ্গে পরিচয় ছিল না। তার সঙ্গে পরিচয় অনেক পরে। ২০০১ সালের আগস্টে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় ইউএনও হিসেবে যোগদান করি।
২০০৩ সালের জুন মাসে মৌলভীবাজার সদর উপজেলা হতে ইউএনও হিসেবে পোস্টিং নিয়ে ফুলবাড়ীতে যোগদান করেন মাহমুদ হাসান। তার কাছ থেকে পরে শুনেছি সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের বড়ো ছেলে নাসের রহমানের সঙ্গে জলমহাল ইজারা নিয়ে বিরোধের কারণেই তাকে মৌলভীবাজার সদর উপজেলা হতে বদলি হতে হয়েছিল। সেই তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়।
গাজীপুর জেলার সন্তান মাহমুদ হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিষয়ে পড়াশুনা করেন। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর দুটিতেই প্রথম শ্রেণি। এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষাতেও প্রথম ডিভিশন। অসাধারণ ফলাফল নিয়ে তার সিভিল সার্ভিসে যাত্রা। এরকম ভালো গুণাবলিসম্পন্ন আর কোনো কর্মকর্তা আছেন কিনা আমার জানা নেই।
২০০৬ সালের মে মাসে আমি খুলনাতে এডিসি হিসেবে যোগদান করি, মাহমুদ হাসান আমার এক মাস আগে সাতক্ষীরায় এডিসি হিসেবে যোগদান করেছেন। আবার নতুন করে মেলামেশার সুযোগ। বিভাগীয় পর্যায়ে সভায় যখন মিলিত হতাম—দুজনে, সেই কুড়িগ্রামের স্মৃতি নিয়ে আলোচনা করতাম। স্বল্পভাষী এ কর্মকর্তার প্রতিটি বিষয়ে জ্ঞান ছিল অতি প্রখর। বিশেষ করে বিশ্ব অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক ভাবনা, বাংলাদেশ ও প্রশাসনিক আইন, বিধি ও প্রবিধি সম্পর্কে। দুর্নীতি একবারেই সহ্য করতে পারতেন না। তত্কালীন সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসকের সঙ্গে নীতিগত প্রশ্নে তার বিরোধ সৃষ্টি হয়। জেলা প্রশাসক তাকে সহ্য করতে পারতেন না। তবুও নীতির প্রশ্নে তিনি আপস করেননি।
২০০৮ সালে আমি পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক হিসেবে বরিশালে যোগদান করে মাহমুদ হাসানকে উপ-ভূমি সংস্কার কমিশনার হিসেবে পাই। মাহমুদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে এ পদটি একেবারেই বেমানান, তবুও সে দীর্ঘসময় ঐ পদে যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে চাকরি করেছেন। ভূমি ব্যবস্থাপনায় তার অভিজ্ঞতা দিয়ে অনেক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন। বরিশাল থাকাকালে প্রায়শ আমি তার অফিসে যেতাম। খারাপ পোস্টিংয়ে থেকেও যে জনগণকে সেবা করা যায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মাহমুদ হাসান। তার এ পোস্টিং উপভোগ করেছেন।
২০০৯ সালের কথা, আমি যখন গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক সে সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের পরিচালক হিসেবে ঢাকায় চাকরি করেন। ২০১০ সালের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে তত্কালীন সমাজকল্যাণমন্ত্রী মরহুম এনামুল হক মোস্তফা শহীদের একান্ত সচিব মনীন্দ্র কিশোর মজুমদার আমাকে টেলিফোন করে বলেন, মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। মাননীয় মন্ত্রী আমাকে বলেন, হবিগঞ্জের জন্য এক জন জেলা প্রশাসক খুঁজছি, আপনার ব্যাচের সত্, কর্মঠ এবং স্বাধীনতার সপক্ষের এক জন কর্মকর্তার নাম বলুন। আমি তাত্ক্ষণিক মাহমুদ হাসানের কথা বলি।
২০১২ সালে উভয়ে জেলা প্রশাসক থাকাকালে মাহমুদ হাসান ও আমি যুক্তরাজ্যের উলভারহেমটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সুপার ম্যাট (Managing at the top)’ প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পাই। টেলফোর্ডের সেই অপূর্ব সুন্দর ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন আমরা একত্রে থেকেছি, ক্লাস করেছি। সে সময় মাহমুদ হাসানকে আরো নিবিড়ভাবে দেখার ও জানার সুযোগ হয়েছে।
সে সময় লেবার পার্টির সংসদ সদস্য রুশনারা আলীর আমন্ত্রণে আমরা ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের ‘হাউজ অব কমন্স’ ও ‘হাউজ অব লর্ডস’ দেখার সুযোগ পাই। লন্ডন প্রবাসী শ্রদ্ধেয় সৈয়দ মোজাম্মেল আলী ও বার্মিংহামের ওয়াসিমের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। লেবার পার্টির হলবর্ন ও সেইন্ট প্যাংক্রাস এলাকার সংসদ সদস্য ও লেবার পার্টির স্বাস্থ্যমন্ত্রী (১৯৯৭-৯৯) ফ্রাঙ্ক গর্ডন ডভসন আমাদের টেমস্ নদীর তীরে পার্লামেন্টের ক্যান্টিনে কফি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। আমাদের পাশের টেবিলে এক ভদ্রমহিলা কফি খাচ্ছেন। গর্ডন তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি তত্কালীন কনজারভেটিভ পার্টির এমপি ও আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী জাস্টিন গ্রিনিং। পরে তিনি শিক্ষামন্ত্রীও হয়েছিলেন।
যাহোক, মাহমুদ হাসান জেলা প্রশাসক থেকে প্রত্যাহার হয়ে ঢাকায় চলে আসেন। আমিও ঢাকার জেলা প্রশাসক হিসেবে চলে আসি। বিভিন্ন সময়ে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমরা একত্রিত হয়েছি। পারিবারিকভাবে আমরা একে অপরের বন্ধু ছিলাম। ভাবি অতি অমায়িক। তার দুটি পুত্রসন্তান পিতার গুণে গুণান্বিত।
২০১৭ সালে ফেব্রুয়ারিতে আমি যখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব (এপিডি) হিসেবে যোগদান করি তখন মাহমুদ হাসান একই অনুবিভাগের যুগ্ম-সচিব। ব্যাচমেট ও বন্ধু মাহমুদ হাসান আমাকে কীভাবে গ্রহণ করবেন সে দুশ্চিন্তা আমার ছিল। কিন্তু দেখলাম তিনি আমাকে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছেন। বিশাল হূদয়ের অধিকারী না হলে সাধারণত ব্যাচমেটকে বস হিসেবে গ্রহণ করা সবার জন্য সহজ হয় না।
আমি সব সময় তার সহযোগিতা পেয়েছি। এরপর তিনি বিসিএস (প্রশাসন) একাডেমিতে পরিচালক হিসেবে পোস্টিং পান। ২০১৮ সালের মে মাসের মাঝামাঝি আমরা একত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনায় অবস্থিত ডিউক ইউনিভার্সিটিতে ‘প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম’-এর আওতায় ১৫ দিনের একটি কোর্সে যাই। সেখানে মাহমুদ হাসানকে আমার রুমমেট হিসেবে পাই।
তিনি কোর্সে ‘ডেপুটি কোর্স লিডার’ মনোনীত হন। রুমে একসঙ্গে রান্না করে খাওয়ার সুযোগ আমাদের হয়েছিল। ভালো আলু ভর্তা তৈরিতে তার জুড়ি মেলা ভার। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃভ্রমণ, শপিং, বাসে করে ক্লাসে যাওয়া, এসাইনমেন্ট তৈরি কতই না স্মৃতি রয়েছে আমাদের! কিছুদিন পর মাহমুদ হাসান এক জটিল রোগে আক্রান্ত হন। অজ্ঞাত কারণে তার রক্তের প্লাটিলেট ভেঙে যেতে থাকলে আমরা তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করি।
তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে পড়লে ব্যাচমেটরা তাকে সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি করি। সেখান হতে তিনি ভালো হয়ে ফেরত আসেন। অসম্ভব মনোবলের অধিকারী মাহমুদ হাসানের সবকিছুকে জয় করার একটি শক্তি ছিল।
২০১৮ সালের জুলাই মাসের দিকে তিনি বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে ময়মনসিংহে যোগদান করেন। দীর্ঘ এক বছর তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করেন। বিভাগের সব কর্মকর্তার জন্য তিনি ছিলেন রোলমডেল। কথাবার্তা, চালচলনে ছিলেন জুনিয়র সহকর্মীদের কাছে অনুকরণীয়। নবযোগদানকৃত সহকারী কমিশনারদের একটি ওরিয়েনটেশন কোর্সে ময়মনসিংহে আমার অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে তিনি যে সূচনা বক্তব্য দিয়েছিলেন আজও তা আমার কাছে বিস্ময়। ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় সুন্দর বাচনভঙ্গি দিয়ে যে কোনো লোককে তিনি আকৃষ্ট করতে পারতেন।
এখন বন্ধু মাহমুদ হাসান করোনা রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। মে মাসের ১৫/১৬ তারিখের দিকে আমাকে টেলিফোন করে বললেন, ‘হারুন, আমার কয়েকদিন যাবত্ জ্বর এবং কাশি। কোভিড টেস্ট করা প্রয়োজন’। আমি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে টেস্টের ব্যবস্থা করি। টেস্ট পজিটিভ হয়। ঢাকা মেডিক্যালের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে ১০৩ নম্বর কেবিন যোগাড় করে দিই। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কোভিডের কারণে সে ‘সিভিয়ার নিউমোনিয়ায়’ আক্রান্ত। তাছাড়া আগের মতো প্লাটিলেট ভেঙে যাচ্ছে। ‘মালটিপল কমপ্লেক্স’ নিয়ে সে এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। মহান আল্লার কাছে আমাদের প্রার্থনা, ‘সজ্জন ও বন্ধু মাহমুদ হাসানকে তার পরিবারের কাছ হতে কেড়ে নিয়ো না’। তার তো আরো অনেক কিছু দেবার রয়েছে।
লেখক: শেখ ইউসুফ হারুন, সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।
আপনার মতামত লিখুন :