• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আজ সেই নৃশংস দিন


নিজস্ব প্রতিবেদক ডিসেম্বর ১৫, ২০১৮, ১১:১৫ পিএম
আজ সেই নৃশংস দিন

ঢাকা : আজ ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বাঙালি জাতির ইতিহাসে স্মরণীয় ও কলঙ্কের দিন। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিধনের মর্মন্তুদ স্মৃতিঘেরা বেদনাবিধূর দিনও। দিনটি বাঙালির মেধা-মনন-মনীষা শক্তি হারানোর। ১৯৭১ স্বাধীনতার এক দিন আগে পাক হানাদার বাহিনী তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল শামস ও শান্তি কমিটির সদস্যদের সহযোগিতায় বেছে বেছে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। পূর্বপরিকল্পনা মতো জাতির সেরা শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ দেশের বরেণ্য সন্তানদের নৃশংসভাবে হত্যা করে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে।

বাঙালি জাতি আজ গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করছে শহীদ কৃতী সন্তানদের। শোকাহত মানুষের ঢল নামবে আজ ওই হত্যাযজ্ঞের স্মৃতিবিজড়িত রায়েরবাজারে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিস্তম্ভে। অর্পণ করা হবে পুষ্পার্ঘ্য। দেশের সর্বত্র অর্ধনমিত থাকবে জাতীয় পতাকা। উড়বে শোকের প্রতীক কালো পতাকাও। রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান এলাকায় নেওয়া হয়েছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা।

 নির্মম এ হত্যাযজ্ঞের শিকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা এখনো নিরূপণ করা হয়নি। প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাপিডিয়ায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যে সংখ্যা দেওয়া হয়েছে সে অনুযায়ী একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ শিক্ষাবিদ, ১৩ সাংবাদিক, ৪৯ চিকিৎসক, ৪২ আইনজীবী এবং ১৬ শিল্পী, সাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। এদের মধ্যে রয়েছেন ড. জি সি দেব, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, সন্তেষ ভট্টাচার্য, অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, ড. গোলাম মোর্তজা, ড. মোহাম্মদ শফি, শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজউদ্দীন  হোসেন, নিজামুদ্দিন আহমেদ লাডু ভাই, খন্দকার আবু তালেব, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, নাজমুল হক, আলতাফ মাহমুদ, নতুন চন্দ্র সিংহ, আর পি সাহা, আবুল খায়ের, রশীদুল হাসান, সিরাজুল হক খান, আবুল বাশার, ড. মুক্তাদির, ফজলুল মাহি, ড. সাদেক, ড. আমিনুদ্দিন, হাবিবুর রহমান,  মেহেরুন্নেসা,  সেলিনা পারভীন, সায়ীদুল হাসানসহ আরো অনেকে।

একাত্তরের এইদিনে ঢাকায় প্রচণ্ড হামলা চলতে থাকে চারদিক থেকে। সেটা ছিল ঢাকা দখলে নেওয়ার লড়াই। চতুর্মুখী আক্রমণে জেনারেল নিয়াজিদের হূৎকম্প তখন তুঙ্গে। ১৩ ডিসেম্বর রাত থেকে ১৪ ডিসেম্বর ভোর পর্যন্ত পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে মিত্রবাহিনীর কামান অবিরাম গোলা ছুড়তে থাকে।

এই আক্রমণে নিয়াজীর অবস্থা আরো করুণ হয়ে ওঠে। জেনারেল নিয়াজী বার বার নিরাপদ আত্মসমর্পণ নিশ্চিত করতে ভারতের সেনাপ্রধান মানেকশ’র সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আত্মসমর্পণের পর জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী ব্যবহার নিশ্চিত হতে চাইছিলেন পাকিস্তানি জেনারেলরা।

মিত্রবাহিনীর কামানের গোলা গিয়ে পড়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টেও। সে গোলার আওয়াজে কেঁপে ওঠে গোটা শহর। ঢাকার সবাই বুঝতে পারে, আর রক্ষা নেই। গভর্নর মালিক সেদিন সকালেই পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য গভর্নর হাউজে মন্ত্রিসভার এক জরুরি বৈঠক ডাকেন। বৈঠক বসে বেলা ১১টা নাগাদ। মিত্রবাহিনীও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জেনে গেল এই বৈঠকের খবর। কয়েক মিনিটের মধ্যেই একঝাঁক ভারতীয় জঙ্গিবিমান গভর্নর হাউজের ওপর রকেট  ছোড়ে। গোটা পাঁচেক গিয়ে পড়ে গভর্নর হাউজের ছাদের ওপর। মালিক ও তার মন্ত্রীরা ভয়ে কেঁপে ওঠে। মিটিংয়ে উপস্থিত  চিফ সেক্রেটারি, আইজি পুলিশসহ বড় বড় অফিসার ভয়ে যে যেমনি পারে, সেখান থেকে পালিয়ে যায়।

বিমান হানার পর গভর্নর মালিক পাকিস্তানি মিত্রদের সঙ্গে আবার বসেন এবং পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকার আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির প্রতিনিধি রেনডের কাছে আশ্রয় চাইলেন। রেডক্রস তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালকে তাদের অধীনে ‘নিরাপদ এলাকা’ করে নিয়েছেন। বহু বিদেশি এবং পশ্চিম পাকিস্তানি আশ্রয় নেয় ওই হোটেলে।

নিয়াজী তখনো মার্কিনিদের ভরসায় মুখে বলছে, শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব। কিন্তু ভেতরে ভেতরে নিরাপদ আত্মসমর্পণের জন্য মরিয়া। মার্কিন সপ্তম নৌবহর যে বঙ্গোপসাগরের দিকে এগোচ্ছে এ খবর চার-পাঁচ দিন আগে থেকেই জানা ছিল। গোটা দুনিয়ায় তখন সপ্তম নৌবহরের বঙ্গোপসাগরে আগমন নিয়ে জোর জল্পনা-কল্পনা চলছে।

পাকিস্তানিরা জানত তাদের পরাজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র, তবে তা ছিল মাত্র ৪৮ ঘণ্টার দূরত্বে, তারা হয়তো তা কল্পনা করতে পারেনি। তাই তাদের লক্ষ্য থেকে তারা বিচ্যুত হয়নি। পরাজয়ের গ্লানি ও বেদনা তারা ঢেকে দিতে চেয়েছিল এ দেশের সবচেয়ে দীপ্যমান কিছু মনীষীর জীবনের সমাপ্তি ঘোষণা করে। রায়েরবাজারের বধ্যভূমি পাকিস্তানিদের গ্লানি ভুলে যাওয়ার একটা সুযোগ করে দিয়েছিল।

গত ৪৭ বছরে ১৪ ডিসেম্বরকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাঙালিদের কোনো একটি সত্তা অন্য সব প্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করেনি, বরং একটি সমবায়ী সত্তাই সর্বত্র বিরাজমান ছিল। এই সমবায়ী সত্তায় লীন হয়েছিলেন যোদ্ধারা, দেশের ভেতরে আইনে পড়া বাঙালি নাগরিকরা, স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা। আমরা নানা নামে তাদের ডেকেছি, কিন্তু একটি নাম ইতিহাসে স্থান পেয়েছে— মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরজুড়ে মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন অগ্রবর্তী ভূমিকায়। তাদের নেতৃত্ব সবাই মেনে নিয়েছিল এবং এক অভিন্ন উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্যে ধাবিত হচ্ছিল।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস প্রথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতি শহীদদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারবগের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মহান ত্যাগকে স্মরণ করে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতামুক্ত জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে এগিয়ে আসার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, সুখী সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হব।’

জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে দেওয়া বাণীতে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়তে সকলকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান।

কর্মসূচি : যথাযোগ্য ও শোকের আবহে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনে দেশব্যাপী বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, আলোচনা সভা, গান, আবৃত্তি, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা।

আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সূর্যোদয় ক্ষণে কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবন ও সারা দেশের দলীয় সংগঠনের কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন, জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ, সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে, সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে এবং সকাল সাড়ে ৮টায় রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন এবং বিকালে আলোচনা সভা।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!