ঢাকা : কথায় বলে, ‘Example is better than precept.’ আসলেও তাই। নীতিকথা শোনানোর চেয়ে উদাহরণ দেওয়াটাই ভালো। এতে বিষয়টি পরিষ্কার হতে সাহায্য করে। তাই বিষয়বস্তুতে যাওয়ার আগে একটি উদাহরণ দেওয়াই জুতসই মনে হলো।
১৯৮১ সালের কথা। আমি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর একজন রিপোর্টার হিসেবে কলম্ব স্কলারশিপ নিয়ে দিল্লি গিয়েছিলাম ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব মাসকমিউনিকেশন (আইআইএমসি)-এ এজেন্সি জার্নালিজমে ডিপ্লোমা করার জন্য। প্রায় বছরব্যাপী এই কোর্সে বিশ্বের অন্তত ২৪টি দেশের সাংবাদিকরা যোগ দিয়েছিলেন। আমাদের দেশ থেকে তৎকালীন ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সি (এনা)-এর রিপোর্টার ফরিদ হোসেনও (বর্তমানে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের প্রেস মিনিস্টার হিসেবে কর্মরত) অংশ্রগ্রহণ করেছিলেন। আইআইএমসি’র রেওয়াজ অনুযায়ী আমাদেরকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট অধিবেশন পর্যবেক্ষণ করার জন্য পার্লামেন্ট ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
পার্লামেন্ট সেশন বসল। যথারীতি প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্ধিরা গান্ধী বিপুল করতালির মধ্য দিয়ে হাউজে প্রবেশ করলেন। তাঁর পেছনে চিরাচরিত প্রথা অনুসারে একটি কালো ক্লাসিক্যাল ব্রিফকেস হাতে নিয়ে প্রবেশ করলেন ভারতের সর্বকনিষ্ঠ অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি (এই বাঙালি মেধাবী রাজনীতিবিদ, পরে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদ অলংকরণ করেছিলেন)। কিন্তু সবাই বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলেন বিরোধীদলীয় সদস্যদের সব চেয়ার ফাঁকা।
অভিজ্ঞ স্পিকার বলারাম জাকার এদিক-ওদিক তাকিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে তার সামনের সেক্রেটারিয়াল স্টাফদের জিজ্ঞাসা করলেন, আজ বিরোধী দলের বাজেট অধিবেশন বর্জনের কোনো পূর্ব ঘোষণা আছে কি না। হঠাৎ করে শোরগোল শোনা গেল। সব বিরোধীদলীয় এমপি একযোগে স্লোগান দিতে দিতে হাউজে ঢুকতে শুরু করলেন। সবার গলায় পেঁয়াজের মালা। বলারাম জাকার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ কেয়াসে তামাশা হায়?’
বিরোধী দলের পক্ষ থেকে একজন বললেন, ‘মাননীয় স্পিকার, ইহা কোনো তামাশা নয়। আজ প্রণব বাবু সংসদে বাজেট ঘোষণা করবেন। চারদিকে কানাঘুষা, কোন জিনিসের ওপর কত ট্যাক্স বসাবেন তা ভগবানই জানেন। অজানা আশঙ্কায় দিল্লির বাজারগুলোতে ইতোমধ্যে পেঁয়াজের দাম পার কিলো নয়াদশ (দশ পয়সা) বাড়িয়ে দিয়েছে। আজকে বাজেট পেশের পর পেঁয়াজের দাম হয়তো এমনভাবে বেড়ে যাবে যাতে গলায় মালা পরার মতো মূল্যবান হয়ে যাবে এই পণ্যটি। তাই আগেভাগেই পেঁয়াজের মালা পরে সংসদে আসলাম।’
বয়স, অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার ভারে নুয়ে পড়া বলারাম জাকার রগড় করে বললেন, ‘এই যাত্রা ভগবান আপনাদের রক্ষা করেছেন। পেঁয়াজের ওপর দিয়েই চলে গেলেন। ভগবান না করুক আগামী বাজেট সেশনে প্রণব বাবু যদি জুতার দাম বাড়িয়ে দেন আপনারাই বিপদে পড়বেন।’ সারা সংসদে হাস্যরোলের বন্যা বয়ে গেল।
বিশেষ কারণে ভারতীয় জনজীবনে পেঁয়াজের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। আইআইএমসি থেকে আমরা প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ অতিথি হিসেবে ‘ভারত দর্শন’ ট্যুরে দিল্লি থেকে বের হয়েছিলাম বিশেষ এক শীতাতপনিয়ন্ত্রিত রেলের বগিতে চড়ে। লক্ষ্য ছিল, হিমালয় থেকে কন্যাকুমারীজুড়ে ভারতের আকর্ষণীয় ঐতিহাসিক স্থানসমূহ ঘুরে দেখা। একপর্যায়ে আমরা গিয়ে পৌঁছলাম ভুপালে। ভুপালের তৎকালীন গভর্নর ও একজন সুপরিচিত কবি মমিনউদ্দিন চৌধুরী আমাদের নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
ভারতের আর্থসামাজিক বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এই কবি-গভর্নর আমাদের জানালেন, ‘এখনো ভারতবর্ষে অন্তত ১৫ কোটি হতদরিদ্র মানুষ রয়েছে যারা খাবারের মেন্যু বলতে কেবল দুটি মোটা আটার রুটি ও দুটি পেঁয়াজ ছাড়া আর কিছুই চিন্তা করতে পারে না।’ সত্যিই যারা ভারতের হতদরিদ্র মানুষের খোঁজখবর নেন তারা জানেন এই পেঁয়াজ আর রুটি তাদের বাঁচার একমাত্র নিয়ামক।
আমাদের দেশেও হতদরিদ্র মানুষ রয়েছে। কতদিন আগেও মানুষ না খেয়ে থাকত, কচু-ঘেঁচু খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্ত করত। তবে কেবল রুটি আর পেঁয়াজ খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি গুজার করে এমন লোকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। আমি একসময় চট্টগ্রামের রেলওয়ের পোলো গ্রাউন্ড কলোনিতে থাকতাম। কলোনির চারপাশে অসংখ্য ভিখারির আস্তানা ছিল। সারা দিন ভিক্ষা করে সাঁঝের বেলা যখন বস্তিতে ফিরে আসত তখন দেখতাম ছোট ছোট মাছ কিংবা টুকিয়ে-টোকায়ে আনা মাংস রান্না করছে রাতের খাবারের জন্য। সে যাক, আমাদের দেশে পেঁয়াজ রান্নাবান্নার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মাছ-মাংস, তরিতরকারি, ভর্তা-ভাজি যাই আমরা খাই তাতে অবশ্যই পেঁয়াজ থাকতে হবে। তবে হঠাৎ করে পেঁয়াজ অগ্নিমূর্তি ধারণ করে সবাইকে কাঁদাচ্ছে কেন? নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম হঠাৎ করে বাড়তেই তো পারে। তবে তার তো একটা সীমারেখা চাই। পেঁয়াজ কোনো অলৌকিক জিনিস নয়। এটি কোনো দুষ্প্রাপ্য সামগ্রীও নয়।
এর একটা হিসাবনিকাশ আছে। আছে আমাদের বাৎসরিক চাহিদ, চাহিদার পরিমাণ ও একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের হিসাবনিকাশ। আমাদের বিদেশ থেকে কী পরিমাণ পেঁয়াজ আনতে হবে তারও হিসাব রয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে।
কিন্তু বর্তমানে যে নিষ্ঠুর খেলা চলছে এই পেঁয়াজ নিয়ে তথা সাধারণ মানুষের অত্যাবশ্যকীয় এই ভোগ্যপণ্যটি নিয়ে, তাতে প্রমাণ হয়েছে সংশ্লিষ্টরা কেউই তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি। পেঁয়াজ কত উৎপাদিত হয়েছে, কত প্রয়োজন, কত আমদানি করতে হবে কেউই তার খবর রাখেননি।
একটি পত্রিকার রিপোর্টে দেখলাম, পেঁয়াজ আমদানির জন্য ৪৬ হাজার টনের এলসি খোলা হয়েছে যার বিপরীতে এসেছে মাত্র ৮ হাজার মেট্রিক টন। তা হিসাবে যতই নয়ছয় হোক না কেন, পেঁয়াজ নিয়ে যা চলছে তা শ্রেফ জালিয়াতি-জুয়াচুরি। পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে দুপুরবেলা ব্যবসায়ীরা মিটিং করে ঘোষণা দিয়েছেন পেঁয়াজের মূল্য ৬০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যেই রাখা হবে।
অথচ বিকেলেই বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘প্রতি কেজি একশ টাকার নিচে পেঁয়াজের দাম কমানো সম্ভব নয়।’ সঙ্গে সঙ্গেই আশকারা পেয়ে বসেছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
সকালে ৮০ টাকা, বিকেলে ১০০ টাকা, তারপর রাত না পোহাতেই ১৫০ টাকা, পরদিন ২০০ টাকা। আর আজ (গতকাল) পত্রিকা খুলেই দেখলাম প্রতি কেজি ২৩০ থেকে ২৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এ যেন মগের মুল্লুক। এই কালোবাজারি, মুনাফাখোরি কঠোর হস্তে দমন না করে দায়িত্বশীল মহল থেকে যার যেমন মনে হয় তেমন বলে যাচ্ছেন। কেউ বলেন দু-তিন মাসের মধ্যেই পেঁয়াজের দাম কমে যাবে, কেউ আবার বলছেন পেঁয়াজ না খেলে কী হয়।
তবে আসল জিনিসটি বুঝেছেন রাজনীতির মেধাবী মুখ, নন্দিত জননেতা ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, ‘এক অশুভ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কারসাজি করে কতিপয় অর্থগৃধ্নু লোভীমহল এই পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির পেছনে কলকাঠি নাড়ছে।’
তিনি আরো বলেছেন, ‘শিগগিরই এই সিন্ডিকেট ভাঙা হবে এবং পেঁয়াজের দাম স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা হবে।’ মাননীয় মন্ত্রীর কথাই সঠিক। এই অসাধু চক্রকে দ্রুত দমন করে এই কৃত্রিম সংকটের হাত থেকে পেঁয়াজের দাম স্বাভাবিক পর্যায়ে এনে জনজীবনের দুর্ভোগ দূর করা হবে। হয়তো আমার এ লেখা প্রকাশের আগেই পেঁয়াজের বাজার স্বাভাবিক হতে শুরু করবে।
তারপরও কথা থাকবে, একদা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে লুটেরা অর্থলোলুপ, মুনাফাখোর, মজুতদার চক্র মিলে দেশে লবণ সংকট তৈরি করেছিল। মানুষ কষ্ট পেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এই চক্রের মূল হোতা আড়তদার সমিতির সভাপতি আমানউল্লাহকে গ্রেপ্তার করে কারারুদ্ধ করেছিলেন। সেই চক্রান্ত নস্যাৎ হয়েছিল বটে, লোভীরা শাস্তি পেয়েছিল বটে, তবুও আজ ৪৮ বছর পরও সেই লবণ কেলেঙ্কারির দাগ মুছে যায়নি। কথায় কথায় সেই খোঁটা শুনতে হয় আওয়ামী লীগকে। কয়েকদিন আগে আমি রেলের এসি কামরায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম। আমার এক সাংবাদিক বন্ধুর টেলিফোন পেলাম। একটি শোক সংবাদ। শুনে আমি ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমার একই কামরায় ভ্রমণরত একজন যাত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে মারা গেল ভাই।’ আমি বললাম কাজী জাফর আহমেদ। ভদ্রলোক ছিলেন একজন অধ্যাপক।
তিনি বললেন, ‘কে আমাদের চিনি জাফর মারা গেলেন।’ শুনে কষ্ট পেলাম। আমাদের দেশের বামপন্থি রাজনীতিবিদরা সময়ের বাঁকে বাঁকে এসে বিভিন্নভাবে বিতর্কিত হয়েছেন, সমালোচিত হয়েছেন। তবে এ দেশে ছাত্র আন্দোলনে, স্বাধিকার আন্দোলনে, ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনে জাফর সাহেবের নান্দনিক ভূমিকা ছিল। তবে স্বৈরশাসকের সহযোগী হিসেবে দুর্নামও কুড়িয়েছিলেন। ফলে তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়ার আগেই একজন তাকে গালি দিয়ে বসলেন চিনি জাফর বলে। এটা জাফর সাহেবের কৃতকর্মের অনিবার্য ফল।
আজকের পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি চিরস্থায়ী হবে না, মজুতদার-মুনাফাখোর সবাইকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে, শাস্তি ভোগ করতে হবে। কিন্তু ২০০-২৫০ টাকা প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রির কলঙ্ক আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে অনেকদিন। হয়তো এর খেসারতও দিতে হবে চড়া মূল্যে।
লেখক : সাংবাদিক
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।
আপনার মতামত লিখুন :