• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কাশ্মীরি তরুণীরা এভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে


নিজস্ব প্রতিনিধি সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৯, ০৬:৫৪ পিএম
কাশ্মীরি তরুণীরা এভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে

ঢাকা: শ্রীনগরের প্রান্তদেশে অবস্থিত হাবাক সানপোরা এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর রাতভর সংঘর্ষ হয়েছে। ওই এলাকাতেই বসবাস নাঈমার। ভারত সরকার কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল এবং রাজ্যটিকে দ্বিখণ্ডিত করে দুইটি আলাদা অঞ্চল হিসেবে ঘোষণার পরদিন থেকেই ডাল হ্রদের তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা এলাকার অধিবাসীরা এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ দেখেছেন।

গত ২২ আগস্ট, ভোরবেলা। মায়ের সঙ্গে বাড়িতেই ছিলেন নাঈমা। হঠাৎ দেখতে পেলেন কয়েকটা ছেলে তাদের বাসার মূল দরজা টপকে পেছনের দিক দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যাচ্ছে। সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সি আর পি এফ) এর পুলিশ বাহিনী ধাওয়া করছিল তাদের। আর তা দেখে আতঙ্কিত হয়ে দ্রুত বাথরুমে লুকিয়ে পড়ে ২৬ বছর বয়সী নাঈমা।
খবর স্ক্রল ইন।

নিরাপত্তাবাহিনী অভিযান চালাতে পারে,এমনটা আঁচ করে হাবাক সানপোরা গ্রামের তরুণেরা তাদের পার্শ্ববর্তী এলাকায় যাওয়ার সব রাস্তা ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ করে দেয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, আগুন জ্বালিয়ে রাতের ঠাণ্ডা আবহাওয়া মোকাবিলার চেষ্টা করে প্রতিরোধকারীরা। এক পর্যায়ে সি আর পি এফ এর সেনারা জোর করে এলাকার ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা করেন।

স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, দুই পক্ষের মধ্যে প্রায় রাত দুইটা নাগাদ সংঘর্ষ শুরু হয় এবং সারারাত তা চলতে থাকে। এইসময় আশেপাশের গ্রামের সব মসজিদ থেকে প্রতিরোধকারী তরুণদের সহায়তার জন্য সেখানকার বাসিন্দাদের আহ্বান জানিয়ে মাইকিং করা হয়। শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনী সেখান থেকে কাউকে আটক কিংবা গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়নি।

তবে স্থানীয়দের দাবি, সংঘর্ষ চলাকালীন কমপক্ষে ২০ জন লোক আহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন ছররা গুলির আঘাতে। এর মধ্যে দুইজনের চোখ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধু রাস্তার মধ্যেই সংঘর্ষে জড়িয়ে থেমে থাকেনি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। বাড়িতে বাড়িতে গিয়েও তল্লাশি চালিয়েছে তারা।

নাঈমা তার ভাইদের উপার্জনের বাড়তি টাকা যোগ করতে চাদর বুনতেন। এলাকার সবচেয়ে সরু গলির একদম শেষ মাথায় এ পরিবারের একতলা ঘরটি অবস্থিত। সংঘর্ষের দিন রাতে নাঈমার দুই ভাইই তাদের গ্রেফতার ঠেকানোর জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। বাড়িতে নাঈমা তার ৭০ বছরের বৃদ্ধ মা, জানা বেগমের সাথে একা ছিলেন। ভোর প্রায় সাড়ে ছয়টা নাগাদ, তিনি যখন সি আর পি এফ এর সেনাদের দেখতে পেলেন, তখনি দৌড়ে গিয়ে বাথরুমে লুকিয়ে পড়লেন।

নাঈমা বলেন, ‘যখন সি আর পি এফ এর লোকেরা আমাদের বাড়ির আঙিনায় ঢুকে আমাদের জানালার কাঁচ ভাঙ্গা শুরু করল তখন আমি বাথরুমের ভেতরে ছিলাম।’ তিনি জানান, সে সময় ভীতির মধ্যে থাকার ধীরে ধীরে বাথরুমের বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন এবং কোনোরকমে মাকে সাথে নিয়ে আবার বাথরুমের ভিতরে ঢুকে পড়েন।

নাঈমা জানান, এরপরও তারা রক্ষা পাননি। সি আর পি এফ এর লোকেরা তাদের বাথরুমের দরজায় লাথি মারতে শুরু করে এবং তাদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করতে শুরু করে। তার ধারণা, সৈন্যরা হয়ত ভেবেছিল তারা তাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যদের লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলেন।

সৈন্যরা রান্নাঘরে ঢুকে পড়তে পারে এবং পরিবারের জন্য সংরক্ষিত খাবার নষ্ট করে ফেলতে পারে, এমন আশঙ্কায় নাঈমা দরজা খুলে দেন। তিনি জানান, তখন সি পি আর এফ এর লোকদের সঙ্গে তার তর্কাতর্কি হয় এবং তাদেরকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেন।
 
নাঈমার ভাষ্য অনুযায়ী, ‘তারপর তারা (সেনারা) আমাদের পিটানো শুরু করল। সি আর পি এফ এর একজন লোক আমার পিছনের দিকে একাধিকবার লাথি মেরেছে। যখন আমি চিৎকার করতে শুরু করলাম, লোকটি তখন তার বন্দুক বের করে এবং বন্দুকের পেছনের অংশ দিয়ে আমাকে মারার প্রস্তুতি নেয়, তখনি একজন স্থানীয় জম্মু এবং কাশ্মিরের পুলিশ কর্মকর্তা তাকে বাধা দেয় এবং বলে সে যেন আমাকে ছেড়ে দেয়।’

সৈন্যরা অবশেষে চলে যায়। নাঈমাকে সি আর পি এফ এর লোকেরা শুধু মারধর করেই যে ছেড়ে দিয়েছে তা ভেবে নাঈমার মা অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।

নাঈমার মা জানা বেগম বলেন, ‘যখন সৈন্যরা তাদের বাড়িতে প্রবেশ করে, তখন বাড়িতে শুধু তারা দুইজন নারী ছিলেন। ঈশ্বর ক্ষমা করুক, যদি তখন বাড়িতে আমার মেয়ে একা থাকত, তখন না জানি কী হতো! বাথরুমের ভেতরে একজন মানুষ যে কোনও ধরনের অবস্থাতেই থাকতে পারে। তারপরও তারা তাদের পায়ের বুট জুতা দিয়ে বাথরুমের দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করেছিল। তখন যেকোনো কিছু একটা ঘটে যেতে পারত।”

আগস্ট মাসের ৫ তারিখ থেকে কাশ্মিরে বসবাসকারীদের একটি বড় অংশকে এই নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হাতে শারীরিকভাবে নির্যাতিত হতে হয়েছে। এদের অনেকেই আবার তাদের থেঁতলে যাওয়া পিঠ এবং ভেঙ্গে যাওয়া পা দেখিয়েছে সাংবাদিকদের। ২২ আগস্টের ঘটনার দিন হাবাক সানপোরা এলাকায় আহত হওয়া নারীদের মধ্যে নাঈমা শুধু একা ছিল না। সেদিন সকালে নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা যখন ফাতিমা বানু নামক আরও একজন প্রতিবেশী মহিলার বাসায় ঢুকে পড়ে তখন তিনি বাসার বাইরে অবস্থান করছিলেন।

ফাতিমা বানুর স্বামী ফারুক আহমেদ জানান, “যখন সি আর পি এফ এর জওয়ানরা সরাসরি তার পা লক্ষ্য করে টিয়ার গ্যাসের একটি শেল ছুঁড়ে মারে তখন ফাতিমা বানু তার বাচ্চাদের ঘরের ভিতরে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছিল। বানুর সেই পায়ের মধ্যে পরবর্তীতে সার্জারি করার প্রয়োজন হয়েছিল এবং আমাকে প্রায় সাত হাজার টাকারও বেশি টাকা তার ওষুধ কিনতে ব্যয় হয়েছে।”

স্থানীয়দের জন্য এখন এইসব প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে গেছে। নিজেদের বাড়ির ভাঙ্গা জানালা এবং ভাঙ্গা দরজা নিয়ে এখন কেউ আর তেমন ভাবে হা-হুতাশ করে না। এমনকি এইরকম হানা আবারও ঘটার আশংকায় স্থানীয়রা এখন তাদের এইসকল ভাঙ্গা জানালা আর দরজা  নতুন করে ঠিক করে না।

কিন্তু জাম্মু এবং কাশ্মীরের সি আর পি এফ এর মুখপাত্র সঞ্জয় শর্মা সেদিন রাত্রে রেইডের মধ্য দিয়ে ঘটে যাওয়া এইসব ঘটনাগুলোকে অস্বীকার করেন। লুটপাট এবং নারীদের ওপর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ  অস্বীকার করে তিনি জানান এই ঘটনা কখনও রেইড ছিল না।

সোনালীনিউজ/এমএএইচ

Wordbridge School
Link copied!