• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাবার কথা মনে করে নিভৃতে কাঁদেন শহীদ পরিবারের তিন কন্যা


নিজস্ব প্রতিবেদক ডিসেম্বর ১৪, ২০১৯, ০৪:০০ পিএম
বাবার কথা মনে করে নিভৃতে কাঁদেন শহীদ পরিবারের তিন কন্যা

ঢাকা : আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ যুদ্ধিজীবী দিবস।  এদিন এলে তাদের বাবার কথা মনে করিয়ে দেয়। বাবার শূন্যতায় দিনভর তাদের কষ্টের মধ্যদিয়েই সময় অতিবাহিত হয়। বাবাকে না পাওয়ায় নিভৃতে কাঁদেন শহীদ পরিবারের তিন কন্যা। সে তিন কন্যা হচ্ছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী, ড. শহীদুল্লাহ কায়সারের মেয়ে শমী কায়সার ও সুরকার আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ। তাদের দাবি পলাতক রাজাকারদের দেশে এনে ফাঁসি কার্যকর করা।

বাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী বলেন, মায়ের মুখে শুনেছি, তখন শিশু আমি, কিছুই বুঝে উঠার ক্ষমতা হয়নি আমার। মাত্র দুই বছর বয়সে বাবাকে হারান। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিকেলে আল-বদর বাহিনী চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরীকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। তিনদিন পর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে ডা. আবদুল আলীমের ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ পাওয়া যায়। তার সারা শরীরে ছিল গুলি ও নির্যাতনের চিহ্ন।

নুজহাত চৌধুরী বলেন, আমার কাছে বাবার স্মৃতি ধূসর। মা ও পরিবারের সদস্যদের কাছে বাবা সম্পর্কে জেনেছেন। বাবার সেই নির্মম হত্যাকাণ্ড এখনও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। নীরবে নিভৃতে বাবার শুন্যতায় চোখের পানি মুছে নেই। 

ডা. নুজহাত চৌধুরী বাবার কথা স্মরণ করে বলেন, আমার বাবা ডা. আলীম চৌধুরী ছিলেন চিকিৎসক ও বুদ্ধিজীবী। বাবাকেও সেদিন রেহাই দেওয়া হয়নি, হত্যা করা হয়েছিল তাকে। শুধু এই দিনেই না বাবার কথা মনে হলে সব সময় কাঁন্না আসে। শনিবার (১৪ ডিসেম্বর ) সকালে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা জানাতে এসে বাবার কথা স্মরণ করে এভাবে বলেন শহীদ বুদ্ধিজীবীর এ সন্তান। বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী পলাতক রাজাকার চৌধুরী মইনউদ্দিন ও আশরাফকে দেশে এনে বিচার করার দাবি জানান তিনি।
   
এদিকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারের মেয়ে শমী কায়সায়। বাবা শহীদুল্লাহ কায়সারের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আসলে বাবার বিশেষ স্মৃতি আমার নেই। কেননা আমি তখন ছোট, কোনো কিছু বুঝে ওঠার বয়স তখনও হয়নি। যে কারণে অনেক কিছু আমার মনেও নেই। খুব আক্ষেপ লাগে, আফসোস হয়- তখন যদি একটু বড় থাকতাম! তাহলে বাবাকে নিয়ে এখন অনেক স্মৃতি শেয়ার করা যেত। কিন্তু তা আর হবার নয়। মায়ের কাছে যা শুনেছি এতটুকুই।

শমী কায়সার ব্যাথিত হৃদয়ে আরো বলেন, বাবার ব্যবহৃত কোনো কিছু দেখলে আজও বাবাকে ভীষণভাবে মিস করি। বাবার কথা মনে পড়লেই তার ব্যবহৃত জিনিসগুলো উল্টেপাল্টে দেখি। তার কয়েকটি অপ্রকাশিত ডায়েরি আছে আমার কাছে। সেগুলোর পাতায় চোখ বুলাই। ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টি। তারপরও অক্ষরগুলো পড়ার চেষ্টা করি। বুঝতে চেষ্টা করি, বাবার ভাবনা, প্রতিদিনের দিনলিপি, জীবন দর্শন বলতে গিয়ে শমী কায়সার আবেগআপ্লুত হয়ে পড়েন। বাবার শুন্যতা যে কি, তা এখন বুঝি। মনে পড়লে নিভৃতে কাঁদি।
 
একটু থেমে নিজেকে সামলে নিয়ে শমী কায়সার পুনরায় বলতে থাকেন, বাবার ব্যবহৃত যে কোনো কিছু স্পর্শ করলেই আমার মনে হয়, বাবাকেই স্পর্শ করছি। তখই দেশ, দেশপ্রেম, ভালোবাসা, স্নেহ, ত্যাগ-তিতিক্ষা, জীবনের চড়াই-উতরাইয়ের কথাগুলো মনে পড়ে। বাবা ছাড়া জীবনে বেড়ে ওঠার প্রতিটি প্রেক্ষাপট আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে বাবার জীবন থেকেই আমি প্রেরণা পাই।

শমী কায়সার বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সঠিক তালিকা করতে হবে। একই সঙ্গে রাজাকারদের সঠিক তালিকাও করতে হবে। আমরা যারা শহীদ পরিবারের সন্তান এবং মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চেতনায় বিশ্বাসী আমাদের সংঘবদ্ধ হতে হবে। পলাতক রাজাকারদের দেশে এনে রায় কার্যকরের দাবি জানান তিনি। 
 
অপরদিকে শ্রদ্ধা জানাতে আসা বাংলা গানের কিংবদন্তি সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ। তিনি বলেন, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটির সুর আমার বাবারই করা। মুক্তিযুদ্ধে আলতাফ মাহমুদের রয়েছে অমূল্য অবদান। শাওন মাহমুদ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, তখন আমার বয়স ৩ বছর। এরপর তো আসলে আমরা মুক্তিযুদ্ধ থেকে বের হতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছি। সব সময় বাবাকে খুঁজতে গিয়েছি, তিনি কোথায় আছেন? ছোটবেলা কখনো আমাকে বলা হতো না, বাবা আর ফিরবেন না। আমাকে বুঝ দেয়ার জন্য মিথ্যা আশ্বাস দেয়া হতো, সব সময় বলা হতো বাবা ফিরবেন। সুতরাং এসব বিষয় বহন করতে করতে বড় হয়েছি এবং জেনেছি বাবা আর আসবেন না। কিন্তু এখনো মনে হয় না, বাবা বেঁচে নেই কিংবা বাবাকে দেখিনি। মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। এদিনে বাবাকে অনেক মিস করি। বাবার শূন্যতায় মন কাঁদে। কিন্তু মনে কষ্ট এখানেই, যে রাজাকাররা এখনো মাথা চাড়া দিয়ে কথা বলছে। বিদেশে লুকিয়ে থেকে উস্কানি দিচ্ছে। তাদের দ্রুত দেশে এনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দাবি করছি। 

শাওন আরো বলেন, ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আলতাফ মাহমুদকে ঢাকার আউটার সার্কুলার রোডের বাসা থেকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তীকালে তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এদিকে আজ সকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বধ্যভুমিতে শ্রদ্ধা জানাতে এসে সাংবাদিকদের বলেছেন, আইনগত বাধার কারণে বিভিন্ন দেশে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুসহ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকাদের বিষয়ে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। আমরা বোধহয় তাড়াতাড়িই ফিরিয়ে আনতে পারবো তাদের।

ওবায়দুল কাদের বলেন, বুদ্ধিজীবীসহ বঙ্গবন্ধুর খুনিদেরও দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে যে দেশে তারা পালিয়ে আছে সেদেশের আইনগত বাধা আছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তকে আনা ওই দেশের আইনে অ্যালাউ করেনা। সে কারণেই রশিদ, ডালিমসহ আরো অনেককে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। এছাড়া বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে বিচারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা হয়েছে। 

সোনালীনিউজ/এএস 

Wordbridge School

জাতীয় বিভাগের আরো খবর

Link copied!