• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সিনহা হত্যা মামলা ধামাচাপার চেষ্টা


নিজস্ব প্রতিবেদক আগস্ট ১১, ২০২০, ১০:৪৯ এএম
সিনহা হত্যা মামলা ধামাচাপার চেষ্টা

ঢাকা : কক্সবাজারে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান গুলিতে নিহত হওয়ার পর ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। এজন্য তিনি সাবেক এক এসপির পরামর্শ নেন। তাদের দুজনের ফোনালাপ ইতোমধ্যে তদন্ত সংস্থার হাতে এসেছে।

সোমবার (১০ আগস্ট) দুপুরে এ বিষয়ে কথা হয় র‌্যাবের সদর দপ্তরের আইন ও গণমাধ্যম বিভাগের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘ওই হত্যাকাণ্ডের পর বিভিন্ন ফোনালাপ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। এগুলো যাচাই করা হচ্ছে। সেখানে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটলে তা দেখে ব্যবস্থা নেবেন তদন্ত কর্মকর্তা।’

সাবেক এসপির সঙ্গে প্রদীপ কুমার দাশের ফোনালাপ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘তদন্তের অংশ হিসেবে ওই ফোনালাপ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এতে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। পরবর্তীতে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্ত কর্মকর্তাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।’

৩১ জুলাই অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডে পর প্রদীপ আইনি সহায়তা নেওয়ার জন্য সাবেক এসপি আল্লাহ বকশ চৌধুরীর কাছে ফোন করেন।

সিনহা সাবেক সেনা কর্মকর্তা, এ তথ্য জেনে প্রদীপকে দুশ্চিন্তা না করার পরামর্শ দেন আল্লাহ বকশ চৌধুরী। ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার কৌশলও প্রদীপকে শিখিয়ে দেন ওই সাবেক এসপি। প্রয়োজনে পৃথক দুটি মামলা করারও পরামর্শ দেন তিনি।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা সন্দেহ করছেন, সাবেক ওই এসপির পরামর্শ নিয়েই পৃথক দুটি মামলা করেন প্রদীপ। এসব মামলায় সিনহার দুই সহকর্মী সিফাত ও শিপ্রাকে আসামি করা হয়। এ মামলা দুটি তদন্ত করবে র‌্যাব। আল্লাহ বকশ চৌধুরীর বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায়। প্রদীপের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল।

প্রদীপ কুমার দাশের সঙ্গে ফোনালাপের কথা স্বীকার করে আল্লাহ বকশ চৌধুরী জানিয়েছেন, প্রদীপ তাকে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন। এ কারণে তিনি ওই ধরনের পরামর্শ দেন। প্রকৃত ঘটনা জানলে লিয়াকতকে আসামি করে মামলা করার পরামর্শ দিতেন তিনি।

এর আগে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ, বাহারছড়া পুলিশ চেকপোস্টের ইনচার্জ লিকায়ত ও কক্সবাজারের বতর্মান এসপি এ বি এম মাসুদ হোসেনের ফোনালাপ ফাঁস হয়। এসব ফোনালাপ নিয়ে কাজ শুরু করেছে তদন্ত সংস্থা।

গত ৩১ জুলাই (শুক্রবার) রাতে টেকনাফের বাহারছড়া চেকপোস্টে তল্লাশির সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।

আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ড চেয়েছে র‌্যাব : পুলিশের গুলিতে নিহত সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহার হত্যা মামলায় চার আসামির ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেছে র‌্যাব। আগামী ১২ আগস্ট এই আদেশের শুনানি অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে। এরইমধ্যে এ ৪ আসামিকে ২ দিনব্যাপী জেল গেইটে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করেছে তদন্তকারী র‌্যাব কর্মকর্তা।

সোমবার (১০ আগস্ট) র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানিয়েছেন, যে ৪ জন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আদালতে নতুন করে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। আদালতের পুলিশ পরিদর্শক প্রদীপ কুমার দাশ জানান, রিমান্ডের আবেদনটি জমা দেয়া হয়েছে। আগামী ১২ আগস্ট আবেদনটির ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

এদিকে গত ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ বাহারছড়া চেকপোস্টে তল্লাশির সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় হত্যা ও মাদক আইনে এবং রামু থানায় মাদক আইনে পৃথক ৩টি মামলা দায়ের করে। এ মামলায় নিহত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের সঙ্গে থাকা শাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা রানী দেব নাথকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।

এছাড়া ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ইন্সপেক্টর লিয়াকত, ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ৬ আগস্ট বরখাস্ত ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতসহ ৭ আসামি কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। মামলার শুনানিতে র‌্যাবের পক্ষে প্রত্যেক আসামির ১০ দিন করে রিমান্ডের আবেদন করে।

আদালত ইন্সপেক্টর লিয়াকত, ওসি প্রদীপ এবং এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতকে ৭ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বাকি ৪ জনকে ২ দিন কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন। বাকি ২ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। ৪ জনকে কারাফটকে ২ দিন জিজ্ঞাসাবাদ সম্পন্ন করে র‌্যাব।

তবে ওসি প্রদীপ, ইন্সপেক্টর লিয়াকত এবং এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতকে র‌্যাবের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের কথা রয়েছে। বর্তমানে তারা কারাগারে আছেন।

পুলিশের দায়ের করা রামু থানার মামলায় সিনহার সহযোগী স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী শিপ্রা রানী দেবনাথ রবিবার জামিনে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছে। অপরদিকে টেকনাফ থানায় দায়ের করা ২টি মামলায় মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের সঙ্গে থাকা শাহেদুল ইসলাম সিফাত গতকাল জামিনে কারামুক্তি পান।

বিচার চেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন সিনহার মা: ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ খানের মা নাসিমা আক্তার। বললেন, বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আমি এখন পর্যন্ত সন্তুষ্ট।

প্রধানমন্ত্রী, সেনাবাহিনী প্রধান, নৌ-বাহিনী প্রধানসহ আরও অনেকে আমাদের খোঁজ নিয়েছেন। আমরা চাই যারা এরসঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। এসময় ছেলেকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তার কণ্ঠ বারবার ধরে আসছিল।

সোমবার (১০ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর উত্তরায় মেজর (অব.) সিনহার বাড়িতে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলার সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।

সাবেক এই সেনা কর্মকর্তাকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের পরিবার। দেশজুড়ে আলোচিত এই ঘটনায় ইতিমধ্যে টেকনাফের ওসি, যার গুলিতে নিহত হয়েছেন সিনহা সেই এসআই লিয়াকতসহ বেশ কয়েকজন রিমান্ডে আছেন।

সিনহার মা সাংবাদিকদের বলেন, কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী ছিল আমার ছেলে। দেশকে নিয়ে অনেক ভাবতো। ছেলে আমাকে বলতো, আমরা যদি দেশে ভালো কিছু রেখে যাই তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সেটা অনুসরণ করবে।

তিনি আরও বলেন, সিনহা সবসময় ক্রিয়েটিভ কাজ করতে চাইত, সবসময় সারপ্রাইজ দিতে চাইত কাজের মাধ্যমে। ও বলতো, আমি আমার মনের খোরাকের জন্য কাজ করি; যাতে মানুষ উপকৃত হয়। একটা ডকুমেন্টরি করছি এখনো বলার মতো কিছু হয়নি, যখন হবে তখন বলব। সিনহার মায়ের সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাবেক মেজর সিনহা মো. রাশেদ।

দুই বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া রাশেদ ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য গত প্রায় একমাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় ছিলেন। ওই কাজেই তার সঙ্গে ছিলেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী সিফাত ও শিপ্রা।

সিনহাকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে : রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (রাওয়া) চেয়ারম্যান মেজর (অব.) খন্দকার নুরুল আফসার বলেছেন, সিনহা হত্যার বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে এ পর্যন্ত আমরা দেখেছি সরকারের মনোভাব পজিটিভ।

আমরা আবেদন করব, যাতে সিনহা হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত না হয়। ইতোমধ্যে প্রমাণিত (অলরেডি প্রুভড) পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও তথ্য-প্রমাণে প্রতীয়মান যে, সিনহাকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যা যেন আর না হয়।

সোমবার (১০ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর উত্তরায় মেজর (অব.) সিনহার মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে রাওয়া চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।

তিনি দাবি উত্থাপন করে বলেন, আমরা চাই মেজর (অব.) সিনহার হত্যাকাÐের ঘটনায় কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাসুদ হোসেনকে যেন অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার করা হয়।

রাওয়া চেয়ারম্যান মেজর (অব.) খন্দকার নুরুল আফসার বলেন, সিনহার ঘটনায় যারা কাস্টডিতে ছিলেন তাদের জামিন হয়েছে। আমরা অত্যন্ত খুশি, আলহামদুলিল্লাহ। সিনহা হত্যায় যে পুলিশ সদস্যরা জড়িত ছিল তাদের অস্ত্রগুলো যেন জব্দ করা হয়। হয়তো তদন্তের খাতিরে এটা করতেই হবে। যাদের ওপর তদন্তভার অর্পণ করা হয়েছে তারা অত্যন্ত দক্ষ। আমরা আশা করব তারা ট্রান্সপারেন্সি (স্বচ্ছতা) রক্ষা করবেন। কোনো পক্ষাবলম্বন করবেন না।

তিনি বলেন, সিনহা হত্যার বিচার যদি দ্রুত নিষ্পত্তি হয় তাহলে হয়তো সিনহা বা সিনহার মতো ভুক্তভোগীর আত্মা শান্তি পাবে।

রাওয়া চেয়ারম্যান বলেন, ১৪০টা যে মার্ডার করেছে এই ওসি প্রদীপ। আজ দেখেন আমরা সিনহা হত্যার ব্যাপারে সোচ্চার হতে পেরেছি। কিন্তু ওই যে দেখেন ওই সেই লোকগুলোর পরিবার তো মুখ খুলতে পারছে না। তাদের সাথে কোনো সংস্থা নেই, অবসরপ্রাপ্ত কল্যাণ সংস্থা নেই। মিডিয়াই পাশে দাঁড়িয়েছে, লিখেছে। আমরা চাই একটা একটা করে সব ঘটনার বিচার করা হোক। এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং যে প্রদীপ করেছে সেগুলোর বিচার হোক।

তিনি বলেন, এটা তো বলার অপেক্ষায় রাখে না, এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিংয়ের কারণে যদি বাংলাদেশ ডিস্টার্ব হয়ে যায়! পুলিশ বাহিনী যাতে পুনর্গঠিত করে, পুলিশকে নিয়ন্ত্রণে যে সিস্টেম দেয়া আছে ডিসির আওতায় সেটা যেন থাকে এবং ডিসির ভিজিট করার কথা, দিকনির্দেশনা বিধিগুলো থাকার কথা সেটা যেন পালন করে। যদি সুপারভিশন ঠিক থাকে তাহলে তখন একটা পুলিশও উদ্ধত হতে পারে না। একটা রঙ কনফিডেন্স গ্রো করেছে, কারণ তার কোনো বিচার হয়নি। সে একটার পর একটা আকাম-কুকাম করে গেছে সেটা নজরে আসেনি। কী কারণে আসেনি, আমরা তা ঠিক বুঝতে পারছি না। আমরা চাই এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটুক, আর কোনো মায়ের বুক খালি না হোক, এসব ঘটনা নিয়ে আর কোনো কথাবার্তা হোক।

খন্দকার নুরুল আফসার বলেন, এ পর্যন্ত সিনহা হত্যা মামলা যেভাবে দ্রুততার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে, এত দ্রুততার সাথে আর কোনো মামলায় আসামিকে কাস্টডিতে নেয়া, অ্যাকশনে যাওয়া হয়নি। আমরা আশাবাদী, সরকার অত্যন্ত সিরিয়াস এ ব্যাপারে, প্রধানমন্ত্রী, আমাদের সেনাপ্রধান অত্যন্ত সোচ্চার।

সেনাবাহিনীও অনুসন্ধান (ইনকোয়ারি) করছে, সর্বক্ষণ মনিটরিং করছে। আমরা রাওয়ার পক্ষ থেকে জুডিশিয়াল ইনভেস্টিগেশন মনিটরিং সেল করেছি, আরেকটা করেছি মিডিয়া মনিটরিং সেল।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!