• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিজ্ঞানমুখী জনবলের শূন্যতা তৈরি হচ্ছে


নিয়ন মতিয়ুল নভেম্বর ১১, ২০১৬, ০৭:০৪ পিএম
বিজ্ঞানমুখী জনবলের শূন্যতা তৈরি হচ্ছে

ঢাকা: মৌলবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে গুলিয়ে ফেলছি আমরা দিন দিন। বিজ্ঞানের মৌল জ্ঞান-অভিজ্ঞতা ছাড়াই প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারের দক্ষতাকেই অনেক ক্ষেত্রে ভাবা হচ্ছে বিজ্ঞানমুখিতা হিসেবে। আর এ কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে।

একইভাবে বিজ্ঞানে দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রও হতাশাজনকভাবে সীমিত হয়ে পড়ছে। সে কারণে বিজ্ঞানে মেধাবীদের অনিবার্যভাবে পাড়ি দিতে হচ্ছে উন্নতদেশগুলোতে। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রগুলোতে বিজ্ঞানমুখী জনবলের শূন্যতা তৈরি হচ্ছে।

এ পরিস্থিতি সত্ত্বেও বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নতি বদলে দিচ্ছে সমাজকে। চিরাচরিত অনেক ধারণাকেই পরিত্যাগ করতে হচ্ছে। কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসকে বিদায় জানাচ্ছে বিজ্ঞানে সচেতন জনগোষ্ঠী। সমাজের বৃহৎ একটি অংশ বিজ্ঞানমুখী হয়ে উঠছে।

বিজ্ঞান এখন শুধু আবিষ্কার আর উদ্ভাবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতিও চলে এসেছে এর আওতায়। মানুষের আবেগ অনুভূতিও এখন বিজ্ঞানের গবেষণার বিষয়। জীবনকে দিন দিন করে তুলছে সহজ-স্বাচ্ছন্দময়। দূরারোগ্য ব্যধিকে জয় করে চলছে। কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়িয়েছে বহুগুণ। মানুষকে আরো বেশি যৌক্তিকবোধসম্পন্ন করে তুলছে।

এদিকে, প্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নতিতে তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। এর ফলে দিন দিন ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। বলা হচ্ছে, পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। জনসংখ্যা বিস্ফোরণের যে ভয় পৃথিবীকে শাসিয়েছিল তাও কেটে যাচ্ছে। সম্পদের সীমাবদ্ধতার আশঙ্কাও কমে আসছে।

তবে বিজ্ঞানের এতো জয়-জয়কারের মধ্যেও কিন্তু অন্ধবিশ্বাস আর পশ্চাৎপদতা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল আর উন্নয়নকামী দেশগুলোতে বিজ্ঞান শিক্ষার বাস্তব চিত্র হতাশাজনক। বিজ্ঞান সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে পাঠ্যবইয়ের গতনুগতিক শিক্ষার মধ্যেই। যদিও বিজ্ঞানের পঠন-পাঠনের ধারাবাহিকতায় প্রযুক্তির চমৎকারিত্বে মুগ্ধ হওয়া আর প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারের নৈপুণ্যতায় এগিয়ে যাচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। সে কারণেই বিজ্ঞানের মৌল জ্ঞান-অভিজ্ঞতা ছাড়াই প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারের দক্ষতাকে বিজ্ঞানমুখিতা ধরে নিয়ে আত্মতুষ্ঠিতে আক্রান্ত হচ্ছি আমরা।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানমুখী শিক্ষাকাঠামো নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে নানা আলোচনা-গবেষণা। তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো পরিবর্তন বা উন্নতি হয়েছে বলে কোনো সমীক্ষা তথ্য প্রমাণ দিতে পারে না। বরং বিজ্ঞানশিক্ষা দীর্ঘদিন ধরেই আটকে আছে আমাদের বৈচিত্রহীন পাঠবইয়ের মধ্যে।

বিজ্ঞান শিক্ষা শেষে ক্যারিয়ার গড়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা না থাকায় হতাশ হয়ে পড়ছে তরুণ প্রজন্ম। বিশেষ করে মৌলবিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্রদের শিক্ষক হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না। বিধায় এসব বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে তরুণ শিক্ষার্থীরা। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে এমন করুণ পরিণতি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে কিন্তু ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। যা উন্নয়নশীল যে কোনো জাতির জন্য অশনিসংকেত।

বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশন ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকসের (ব্যানবেইস) পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৯০ সালে মাধ্যমিকে (এসএসসি) বিজ্ঞানের পরীক্ষার্থী ছিল মোট পরীক্ষার্থীর বিপরীতে ৪২ দশমিক ৮১ শতাংশ আর উচ্চ মাধ্যমিকে এটা ছিল ২৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। ছয় বছর পর (১৯৯৬) উচ্চমাধ্যমিকে এ সংখ্যা এসে দাঁড়ায় মাত্র ১৫ দশমিক ৩৩ শতাংশে। যদিও ২০১৩ সালে তা দাঁড়ায় শতকরা ১৭ দশমিক শূন্য ১ শতাংশে। আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক সম্মান পর্যায়ে এই সংখ্যা আরও ভয়াবহ।

অন্য এক হিসেবে দেখা যায়, ২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১১ বছরে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ১১ শতাংশ আর উচ্চমাধ্যমিকে এ সংখ্যা ৫ শতাংশ। বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের ক্রমহ্রাসমানতার এ হার অব্যাহত থেকেছে পরবর্তীতেও।

প্রতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে এ বাস্তবতাকেই বাংলাদেশে বিজ্ঞান শিক্ষার সামাজিক চিত্র হিসেবে ধরে নিই আমরা। তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, কর্মসংস্থানের পরিধি আর সুযোগ-সুবিধার পর্যাপ্ততা শিক্ষাক্ষেত্রে বিষয় বা বিভাগ নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। সমাজ এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে মৌলবিজ্ঞানে সমসাময়িক জ্ঞান আর দর্শনবোধকে অনিবার্য হিসেবে ধরে নেয়া হলেও বাস্তবতা ভিন্ন হয়ে যায়।

যদিও বিজ্ঞান শিক্ষাকে জনপ্রিয় করে তুলতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যে ধরনের পরিকল্পনা আর উদ্যোগ চোখে পড়ে তা যথেষ্ঠ নয়। সীমিত সংখ্যক শিক্ষার্থীকে এ পরিকল্পনায় আনা গেলেও বৃহৎ অংশই থেকে যায় বঞ্চিত। বলা প্রাসঙ্গিক যে, বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসারের প্রধান অন্তরায় কিন্তু বিজ্ঞান শিক্ষক আর পরিকাঠামোগত প্রতিকূলতা। পাশাপাশি বিজ্ঞান বিষয়ক বইয়ের অভাবও বাধাগ্রস্ত করছে বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসারে।

বলা প্রয়োজন, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতির পেছনে উন্মুক্ত চিন্তার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাস বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হওয়ায় উন্মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি আলোচনায় আসে। অনগ্রসর সমাজে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার পদ্ধতি নিয়েও তাই নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

বলতে কি, উন্নয়নশীল দেশের অনগ্রসর সমাজই শুধু নয়, উন্নত দেশের সচেতন অনেক নাগরিকই কিন্তু প্রযুক্তিকে গুলিয়ে ফেলেন বিজ্ঞানের সঙ্গে। এর ফলে বিজ্ঞানের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন তারা। যদিও প্রযুক্তি যে হারে সমাজে প্রভাব ফেলছে তাতে মৌলবিজ্ঞান চর্চা দিন দিন সীমিত হচ্ছে।

আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমছে। একই হারে বাড়ছে তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রের শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এতে পরিসংখ্যানগতভাবে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে হলেও সমাজ পরিবর্তনে কোনো প্রভাব ফেলছে না।

আধুনিক বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি সম্পর্কে অনাগ্রহী তরুণরা ধীরে ধীরে বিজ্ঞানবিমুখ হতে থাকে। তারা যৌক্তিকবোধ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। উন্মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে পারে না। এ কারণে প্রচলিত বিশ্বাস আর কুসংস্কার তাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজকে এগিয়ে নেয়ায় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গঠনমূলক কাজে কোনোরকম অবদান রাখার প্রয়াস পায় না তারা।

অপরদিকে, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিবিমুখ সমাজ থেকে উঠে আসা তরুণরা উচ্চশিক্ষার গণ্ডি পেরুলেও মৌলবিজ্ঞান কিংবা প্রযুক্তির অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যকে জীবনে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়। এ কারণেই বিজ্ঞান হয়ে ওঠে তাদের কাছে নিরস-ক্লান্তিকর বিষয়। সামাজিক উদ্যোগের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের এ ক্লান্তি দূর করতে প্রয়োজন বিজ্ঞান বিষয়ক প্রচুর প্রকাশনা। দেশে বিজ্ঞানভিত্তিক সামাজিক আর প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠন গড়ার প্রবণতা আগের আগের চেয়ে বেড়েছে, সন্দেহ নেই। তবে প্রকাশনা নিয়ে অতৃপ্তি থেকেই গেছে। কল্পবিজ্ঞান আর মৌলবিজ্ঞান তো এক নয়। বাণিজ্যিক কারণেই মৌলবিজ্ঞান বিষয়ক প্রকাশনা হ্রাস পেয়েছে। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে  বিজ্ঞানের দর্শনভিত্তিক পুস্তক প্রকাশের ক্ষেত্রে তাই রয়েছে সীমাবদ্ধতা।

এর ওপর আছে সামাজিক মূল্যবোধের বিষয়টি। অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতামুক্ত সমাজ গঠনে সাধারণ শিক্ষার ভূমিকাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। আর বিজ্ঞান শিক্ষা উন্নত সমাজ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে বলেই মনে করা হয়। কিন্তু আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় মূল্যবোধের ওপর সার্বিক আর সর্বজনীন প্রভাব ফেলতে পারছে না কোনোটাই। সাম্প্রতিক সামাজিক আর রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের কিছু ঘটনা আর তরুণদের জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষাধারী যেসব তরুণ অর্জিত মূল্যবোধের ক্ষেত্রে হতাশাজনক দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে তারা বিজ্ঞানের সৌন্দর্য থেকে অনেক দূরে থেকে গেছে। এ বিষয় শিক্ষাবিদদের তো বটেই, সামাজিক-রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও উদ্বেগ বাড়িয়েছে বহুগুণ।

এসব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সাধারণ শিক্ষার ক্রমবর্ধমান প্রসারে সাম্প্রতিক সরকারি উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হলেও বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে কার্যকর নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা খুবই জরুরি। এ খাতে বরাদ্দ যেমন বাড়ানো প্রয়োজন তেমনি বিজ্ঞান গবেষণায় শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে হবে আরো বেশি মাত্রায়। পাশাপাশি তরুণ নাগরিকদের বিজ্ঞানমনস্ক হিসেবে গড়ে তুলতে সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও জরুরি। বিজ্ঞানের জ্ঞান সমাজে যে অশান্তি ডেকে আনে না বরং সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে- এ বিশ্বাসের মধ্যে লুকিয়ে আছে বিজ্ঞানের সৌন্দর্য।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, সোনালীনিউজডটকম (www.sonalnews.com)

সোনালীনিউজ/এমএন

Wordbridge School
Link copied!