• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিমানের ৬০ শতাংশ কর্মী চুক্তিভিত্তিক!


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৭, ১০:০৩ পিএম
বিমানের ৬০ শতাংশ কর্মী চুক্তিভিত্তিক!

ঢাকা: রিয়াদুল সীমান্ত (ছদ্মনাম)। আড়াই বছর আগে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কেবিন ক্রু হিসেবে চুক্তিভিত্তিক (ক্যাজুয়াল) চাকরি নেন। চাকরি স্থায়ী হওয়ার কথা ছিল যোগদানের ৯০ দিন পরই। কিন্তু আড়াই বছরেও সেই ‘৯০ দিন’ শেষ হয়নি তার। প্রতি ৮৯ দিন পর পর তাকে নতুন করে চুক্তি করতে হয় বিমান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। এটি যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। শুধু সীমান্ত নন, তার মতো একইভাবে কাজ করে চলেছেন আরো শত শত বিমানকর্মী। স্থায়ী চাকরি যেন তাদের কাছে ‘সোনার হরিণ’।

ভুক্তভোগী তিন কেবিন ক্রু নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন, তাদের প্রত্যেকের কথায় বঞ্চনা আর বৈষম্যের দীর্ঘশ্বাস। তারা বলেন, সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে যে আশা নিয়ে রোমাঞ্চকর ও চ্যালেঞ্জিং ‘কেবিন ক্রু’ পেশা বেছে নিয়েছিলেন, তা আজ তাদের কাছে উল্টো হতাশা। তাদের কাছে এটি এখন পেশা নয়, যেন দাসত্ব। প্রতিনিয়তই চাকরি হারানোর শঙ্কা। নানাভাবে নির্যাতিত এই কর্মীরা দিনের পর দিন তা মুখ বুজে সহ্য করে চলেছেন। ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে রাখা হয়, যে কারণে বিমানের এ অধ্যায়টি গোপনই থেকে যায়। বিমান-সংশ্লিষ্ট অনেকেই এ অজানা অধ্যায়কে বলছেন ‘ব্ল্যাক স্পট’।

রোববার (২৬ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে কথা হয় এক কেবিন ক্রুর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘অনেক আশা নিয়ে এ চাকরি বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু এটিই এখন অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক ফ্লাইটে ডিউটি শেষে বিশ্রাম না দিয়েই তুলে দেয়া হচ্ছে আরেক লম্বা ফ্লাইটে। কোনো পারিশ্রমিক নেই, নেই সাপ্তাহিক ছুটিও। কারণ আমরা ক্যাজুয়াল (চুক্তিভিত্তিক) চাকরিজীবী।

তিনি আরো বলেন, দিন-রাত খাটুনিতে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলে কাটা হয় বেতন। ছুটি চাইলে শুনতে হয় অশ্রাব্য গালাগাল, ছাঁটাইয়ের হুমকি। কখনো কখনো গায়েও হাত তোলা হয়। ছুটির অভাবে অবিবাহিতরা বিয়ে করতে পারছেন না। আর বিবাহিতরা যেতে পারছেন না পরিবারের কাছে। খাবার থেকে শুরু করে পোশাক সবকিছুতেই আমরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছি।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চরম নির্যাতন আর বৈষম্যের শিকার তরুণ কেবিন ক্রুদের অনেকে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। সম্প্রতি বেশ কয়েকজন ক্রু বিদেশি এয়ারলাইনসে চাকরি নিয়ে চলে গেছেন। আরো অনেকেই চাকরি ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কেবিন ক্রুরা এভাবে চাকরি ছেড়ে দিলে বিমানের যাত্রীসেবা হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রতিনিয়ত চাকরি হারানোর শঙ্কায় তাই অনেকেই অন্য এয়ারলাইনসে চাকরির জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। শুধু কেবিন ক্রু নয়, বিমানের ৬০ শতাংশ কর্মীর নিয়োগই চুক্তিভিত্তিক। অথচ তাদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি উপেক্ষিত চরমভাবে।

এসব বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন (অব.) এম মোসাদ্দেক আহমেদ বলেন, ‘বিমানের অনেক বিভাগেই ক্যাজুয়াল (চুক্তিভিত্তিক) এমপ্লয়ি রয়েছেন। তবে তাদের স্থায়ীকরণের বিষয়ে এখন পর্যন্ত অফিসিয়ালি কোনো সিদ্ধান্ত নেই। এর জন্য আগে অর্গানোগ্রাম তৈরি করতে হবে।’ বৈষম্যের কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, ‘কারো প্রতি কোনো বৈষম্য হয় না বিমানে। তবে ক্যাজুয়াল কেবিন ক্রুদের কাছ থেকে কোনো আবেদন বা অভিযোগ পাওয়া গেলে তা তদন্ত করে দেখা হবে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিমানের ফ্লাইট সার্ভিস উপবিভাগে কেবিন ক্রু স্বল্পতার জন্য যোগ্য লোক নিয়োগে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবেদন চাওয়া হয়। উদ্যমী ও উচ্চশিক্ষিত ১৬৮ তরুণ-তরুণী ওই পদে অস্থায়ী হিসেবে নিয়োগ পান। পরে তাদের বিমান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তিন মাসের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এরপর তারা দেশি-বিদেশি ফ্লাইটে নিয়মানুবর্তিতা, কর্মদক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।

ওই ১৬৮ জনের সঙ্গে মাত্র ৮৯ দিনের অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগের চুক্তি করা হয়েছিল। কিন্তু চাকরি স্থায়ী না করে বারবার বাড়ানো হয়েছে চুক্তির মেয়াদ। তারা চাকরি শুরু করেছিলেন ১৫ হাজার টাকা বেতনে। প্রায় আড়াই বছরে চুক্তির মেয়াদ বারবার বাড়ানো হলেও বেতন বাড়েনি এক টাকাও। অথচ একই পদে স্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্তদের সঙ্গে তারা সমানতালে কাজ করছেন। কিন্তু বেতন তাদের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ। ডিউটি সময়েরও কোনো বালাই নেই। বিমানের কয়েকজন অস্থায়ী কেবিন ক্রু জানান, তাদের অনেকেরই শেষ হয়ে গেছে সরকারি চাকরির বয়স।

কেবিন ক্রু সূত্রে জানা যায়, বিমানে কেবিন ক্রু পদে যারা স্থায়ীভাবে নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের সর্বনিম্ন বেতন ৪৫ হাজার টাকা। এরপর বছর বছর তাদের ইনক্রিমেন্ট যোগ হয়। সেই হিসেবে কারো কারো বেতন অনেক বেশি। শ্রম আইন অনুযায়ী, কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না অস্থায়ীরা। তাদের ক্ষেত্রে নৈমিত্তিক, বার্ষিক, অসুস্থতাজনিত ও মাতৃত্বকালীন ছুটিও নেই। কোনো কারণে দায়িত্ব পালন না করলে অনুপস্থিত দেখিয়ে দৈনিক ৭০০ টাকা বেতন কাটা হয়। অতিরিক্ত সময় বা বাড়তি কাজ করলেও তার পারিশ্রমিক দেয়া হয় না। বিশেষত হজ মৌসুমে তাদের সাপ্তাহিক ছুটিও বন্ধ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

সূত্র জানায়, স্থায়ী কর্মীরা ৬৫ ঘণ্টা টানা ফ্লাইটে থাকলেই খাবারের বিল পান ১২০০ ডলার। অতিরিক্ত হলে প্রতি ঘণ্টার জন্য আরো ১৮ ডলার সম্মানী পান। কিন্তু অস্থায়ীদের ক্ষেত্রে এসব সুবিধা মেলে না। তাদের শুধু নির্ধারিত ৮০০ ডলার দেয়া হয়। পান না যাতায়াত ও স্বাস্থ্যভাতা। স্থায়ী কর্মীদের পোশাক ভাতা বাবদ প্রায় ৩০ হাজার টাকা (পুরুষ) ও নারীদের ছয়টি শাড়ির মূল্য হিসেবে ৪৫ হাজার টাকা দেয়া হয়। অস্থায়ী পুরুষ ক্রুদের দেয়া হয় মাত্র পাঁচ হাজার টাকা ও নারীদের ১৫ হাজার টাকা। ডিউটি রোস্টারে অস্থায়ীদের সাপ্তাহিক ছুটির দিন লেখা থাকলেও তাদের স্ট্যান্ডবাই হিসেবে রাখা হয়। প্রয়োজনে তাদের ফ্লাইটে হাজির থাকতে হয়। এর জন্য ভাতাও দেয়া হয় না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিমানে শুধু কেবিন ক্রু নয়, নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন পাইলট, ড্রাইভার ও নিরাপত্তাকর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিভাগের ক্যাজুয়াল কর্মীরা। বিমানে ক্যাজুয়াল চাকরি পেতেই লাখ লাখ টাকা ঘুষ আর বড় বড় লবিংয়ের প্রয়োজন হয়। যারা চাকরি পেয়ে যান তারা ‘সৌভাগ্যবান’। এভাবেই চলছে বিমান। লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি নেয়া ব্যক্তিটি ‘কাঙ্খিত উপার্জনের’ আশায় খুব সহজেই জড়িয়ে যান নানা অপরাধে। এভাবেই বিমানের প্রায় প্রতিটি বিভাগের কর্মীদের মধ্যে অপরাধ বেড়েছে।

সোনা চোরাচালান থেকে জমির দালালি, মোবাইল ফোনসেট চুরি থেকে বিমান লিজের কমিশন বাণিজ্য—সব ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। এতে করে দেশ-বিদেশে বিতর্কিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী একমাত্র আকাশ পরিবহন সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। সম্প্রতি দুবাইয়ের শপিং মলে মোবাইল ফোনসেট চুরির অপরাধে কারাগারে যেতে হয় বিমানের এক পাইলটকে। ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত হওয়া ওই পাইলটকে ধরতে বিমানের আরেক পাইলটকে আটকে রেখেছিল দুবাই পুলিশ। সোনা চোরাচালানে অভিযুক্ত আরেক পাইলট দেশের কারাগারে বন্দি দুই বছর ধরে। জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে বিদেশি এয়ারলাইনসে মাসের পর মাস চাকরি করার মতো ঘটনাও ঘটিয়েছেন বিমানের দুই পাইলট। অঢেল সম্পদের মালিক বনে যাওয়া বেশ কয়েকজন পাইলটের বিরুদ্ধে তদন্তও করছে দুদক।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিমানের অন্তত ২৪ জন পাইলটের বিরুদ্ধে এমন নানা অভিযোগ রয়েছে। তারা দেশ-বিদেশে একের পর এক অপরাধে জড়ালেও পাইলটদের সংগঠন বাংলাদেশ পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) চাপে কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। সাময়িক গ্রাউন্ডেড থাকার পর ফের কাজে যোগ দেন অভিযুক্ত পাইলটরা। বাপার সভাপতি নিজেও অভিযুক্ত জমির দালালিতে। এ ছাড়া দেশি পাইলট বসিয়ে রেখে বিদেশি পাইলট নিয়োগ করে কমিশন বাণিজ্যও করছে বাপা। পাইলটদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা উঠলেই তারা ধর্মঘটের হুমকি দেন। কিছুদিন আগেও তাদের ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়েছিল বিমান।

বিমানের একটি সূত্র জানায়, পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশই একমাত্র উদাহরণ যে দেশে বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত নিরাপত্তাকর্মীরা ‘ভাড়াটে’। বিভিন্ন সংস্থা থেকে চুক্তির মাধ্যমে নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দেয়া হয়। আবার বিমানের যত গাড়ি তার সব চালকও চুক্তিভিত্তিক। এতে করে চরম নিরাপত্তা ‘ঝুঁকিতে’ রয়েছে বিমান।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিমানকর্মী বলেন, ডিউটি শেষে যে চালক আমাদের বাসায় পৌঁছে দিচ্ছেন তারা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে কাজ করছেন। এসব চালক আমাদের বাসা-বাড়ি চিনে নিচ্ছেন। এটাকে ‘ঝুঁকি’ হিসেবেই ভাবছেন তিনি।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এমএইচএম

Wordbridge School
Link copied!