• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এক বছর সাজার মামলায় ৩৫ বছর আদালতে চক্কর


নিউজ ডেস্ক মার্চ ৩, ২০২১, ০৬:৩৪ পিএম
এক বছর সাজার মামলায় ৩৫ বছর আদালতে চক্কর

ঢাকা: ১৯৮৬ সালের কথা। গাজীপুরের আহমদ আলীর ১০-১২ বছর বয়সী নাতির সঙ্গে পার্শ্ববর্তী নুর মোহাম্মদের পরিবারের সদস্যদের কথা কাটাকাটি। এর পর মারামারি। বিষয়টি গড়াল মামলা পর্যন্ত। এর পর নুর মোহাম্মদকে আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হয়েছে দীর্ঘ ৩৫ বছর। 

অথচ এক বছর সাজাপ্রাপ্ত নুরের এ মামলাটি ছিল আপসযোগ্য। আপস না হলেও বিচার শেষে সাজার আদেশ দিয়ে প্রবেশনে পাঠানোর বিধান রয়েছে, যা নুর মোহাম্মদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল।

আইনের ওই বিধান অনুসরণ করা হলে শর্তসাপেক্ষে প্রবেশনে বাড়িতে বসেই সাজা ভোগের সুযোগ পেতেন তিনি। সেক্ষেত্রে এত এত বছর আদালতের বারান্দায় অপেক্ষা করার প্রয়োজন ছিল না; যেতে হতো না কারাগারেও। কিন্তু বিচারিক আদালত এবং হাইকোর্ট বিভাগ আইনের ওই বিধান অনুসরণ করেননি। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন আপিল বিভাগ।

আপিল বিভাগের বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলীর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ নুর মোহাম্মদের আপিল নিষ্পত্তির রায়ে বলেছেন, “আমরা দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি, বিচারিক আদালতের বিচারক ও আপিল আদালতের বিচারক সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেছেন যে, আমাদের দেশে ‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’ নামে একটি আইন আছে এবং বর্তমান মামলার প্রেক্ষাপটে সেই আইনের ৫ ধারা প্রয়োগযোগ্য।
 
যখনই বিচারক ৩২৫ ধারার (গুরুতর আঘাতের) অপরাধে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করলেন তখনই উনার উচিত ছিল অধ্যাদেশটির ৫ ধারা বিবেচনা করা। মামলার বিষয়বস্তু থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এই ঘটনা ঘটেছিল দুই প্রতিবেশীর মধ্যে তুচ্ছ একটা ঘটনার জের ধরে। এইসব ক্ষেত্রে আসামিকে এক বছরের জন্য জেলে না পাঠিয়ে প্রবেশনে রাখা সমীচীন ছিল। এমনকি, যেহেতু দণ্ডবিধি ৩২৩ এবং ৩২৫ ধারা আপসযোগ্য আপরাধ এবং যেহেতু দুই পক্ষ হচ্ছে পরস্পর আত্মীয়/প্রতিবেশী কাজেই মামলাটি আপস মীমাংসা করা যুক্তিযুক্ত ছিল।”

আদালত এ রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলেছেন, এই ‘প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’-এর বিধানাবলী বিচারিক আদালত, আপিল আদালত এবং হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক প্রয়োগযোগ্য। অথচ পূর্বোক্ত আদালতগুলোর তিনটি রায় থেকে বোঝা যাচ্ছে না যে, বিচারকরা এ আইনের বিষয়ে আদৌ অবগত আছেন কিনা। যদি এ আইন প্রয়োগের বিষয়ে ধারণা থাকত তা হলে রায়ের মধ্যে বলা থাকত কেন এ আইন প্রয়োগ করা সমীচীন নয় এবং যদি এ আইন সঠিকভাবে বিচারিক আদালতে প্রয়োগ করা হতো তা হলে এ ধরনের মামলা আপিল বিভাগ পর্যন্ত আসত না। এ ধরনের মামলায় এ আইনটির প্রয়োগ না করা শুধু দুঃখজনকই নয় প্রচলিত আইনেরও পরিপন্থী।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৬০ সালের ‘দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিনেন্স’র অধীনে ছোটখাটো অপরাধে দণ্ডিতদের প্রবেশনে ঘরে থেকেই সাজা ভোগের সুযোগ রয়েছে। ১৯৬০ সালের এ অধ্যাদেশটি কার্যত কাগুজে আইন হিসেবে বহাল ছিল। এ অবস্থায় আইনটি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে ২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সারা দেশের বিচারকদের প্রতি আদেশ দিয়ে একটি সার্কুলার জারি করে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন।

ওই সার্কুলারে বলা হয়, ‘বর্তমানে দেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার প্রায় সর্ব ক্ষেত্রেই দণ্ডিত অপরাধীদের সাজা ভোগের নিমিত্তে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। এতে দেশের কারাগারগুলোর সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়াসহ দেশের একটি প্রচলিত আইনের বিধানকে সরাসরি অবজ্ঞা করা হচ্ছে। ফলে কারাগারের পরিবেশসহ সমাজে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হতে চলেছে।’ এ ছাড়া এতে বলা হয়, ‘ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় সব ক্ষেত্রেই সাজা আরোপ করা আইন সমর্থন করে না। কেননা সাজা প্রদানের অন্যতম উদ্দেশ্য সংশোধনমূলক; প্রতিহিংসামূলক নয়।’

ওই অধ্যাদেশের ৪ ধারায় বলা আছে, ‘আগে দণ্ডিত হয়নি এমন কোনো অপরাধী অনধিক দুবছরের কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে আদালত অপরাধীর বয়স, স্বভাব-চরিত্র, প্রাক-পরিচয়, শারীরিক বা মানসিক অবস্থা এবং অপরাধের ধরন বা অপরাধ সংঘটনে শাস্তি লাঘবকারী পরিস্থিতি বিবেচনাপূর্বক যদি মনে করেন যে, দণ্ড প্রদান অসমীচীন এবং প্রবেশনের আদেশ প্রদান করা যথাযথ নয়, তা হলে আদালত কারণ লিপিবদ্ধ করে সতর্ক করে অপরাধীকে অব্যাহতি দিতে পারেন বা উপযুক্ত মনে করলে আদেশে বিবৃত সময় হতে অনধিক এক বছর সময়ের জন্য কোনো অপরাধ না করার এবং সদাচরণে থাকার শর্তে জামিনদারসহ বা জামিনদার ছাড়া মুচলেকা প্রদানে বিমুক্ত হওয়ার আদেশ দিতে পারেন।’

এ ছাড়া অধ্যাদেশটির ৫ ধারায় বলা আছে, ‘মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত কোনো অপরাধসহ দণ্ডবিধির অন্য কিছু ব্যতিক্রমধর্মী অপরাধ ব্যতীত অন্য সব অপরাধে দণ্ডিত পুরুষ অপরাধী এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধ ব্যতীত অন্য সব অপরাধে দণ্ডিত নারী অপরাধের ক্ষেত্রে আদালত তাৎক্ষণিকভাবে সাজা আরোপ না করে উপযুক্ত ক্ষেত্রে এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত একজন প্রবেশন অফিসারের তত্ত্বাবধানে থাকার নির্দেশ প্রদান করতে পারেন। ওই ধারায় উল্লিখিত দণ্ডবিধির শাস্তিযোগ্য অপরাধ ব্যতীত অন্য সব শাস্তিযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে এই আইনের বিধান প্রয়োগযোগ্য।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনের এই বিধান প্রয়োগ হলে, অনেক দণ্ডিত অপরাধী শর্তসাপেক্ষে জেলের ঘানি না টেনে মুক্ত জীবনযাপন করার সুযোগ পাবেন। দোষী সাব্যস্ত হলেই দণ্ড পেতে বা জেলের ভাত খেতে হবে না। সুপ্রিমকোর্টের ওই সার্কুলার জারির পর থেকে অধস্তন আদালতের কিছু কিছু বিচারক ইতোমধ্যে অধ্যাদেশটির বিধানের প্রয়োগ করছে। ইতোমধ্যে হাইকোর্ট বিভাগও গত বছর এ অধ্যাদেশের বিধান অনুসরণ করে একজন আসামিকে প্রবেশনে পাঠিয়েছেন। কিন্তু আসামি নুর মোহাম্মদের মামলায় এ আইনের বিধানের প্রয়োগ না হওয়ায় আপিল বিভাগ দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেছেন, ‘১৯৬০ সালের ওই অধ্যাদেশে প্রবেশনে পাঠানোর যে বিধান রয়েছে সেটা প্রতিটি মামলায় অনুসরণ করা উচিত। এটা করলে একদিকে যেমন কারাগারের ওপর চাপ কমবে। অন্যদিকে ছোট-খাটো অপরাধের আসামিরা প্রবেশনে থেকে সংশোধনের সুযোগ পাবে।’

নুর মোহাম্মদের মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৬ সালের ১৪ জুলাই সন্ধ্যায় মামলাটির বাদী আহমদ আলীর নাতি আবদুল বাকির সঙ্গে মামলার একজন আসামি আবদুল মতিনের কথা কাটাকাটি হয়। ওই দিনই সন্ধ্যায় এ ব্যাপারে সালিশ হয় এবং মতিনকে সালিশে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ফলে আসামীপক্ষ প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দেয় এবং পরের দিন অর্থাৎ ১৫ জুলাই সকালে আসামি মতিনের ভাই আসামি নুর মোহাম্মদ বাদীর ছেলে আবদুল জব্বারকে আক্রমণ করে এবং একটি ফলার চ্যাপ্টা অংশ দিয়ে মাথায় আঘাত করে একাধিক রক্তাক্ত জখম করে এবং তার বাঁ হাতের কবজি ভেঙে দেয়। এ ব্যাপারে জয়দেবপুর থানায় করা মামলায় ৬ জনকে আসামি করা হয়।

এ মামলার বিচার শেষে গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ১৯৯৪ সালের ৩১ জানুয়ারি আসামি নুর মোহাম্মদকে দণ্ডবিধি ৩২৫ ধারার (গুরুতর আঘাতের) অপরাধের জন্য এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৩২৩ ধারার (আহত করা) অপরাধের জন্য দুই হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। অন্য আসামিদের দণ্ডবিধি ৩২৩ ধারার অপরাধের জন্য ২৫০০ টাকা করে জরিমানা প্রদান করেন। এ আদেশে সংক্ষুব্ধ হয়ে আসামিপক্ষ প্রথমে অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে আপিল করেন। ২০০৫ সালের ৭ জুলাই গাজীপুরের ১ম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত ওই আপিল খারিজ করে এবং বিচারিক আদালতের রায় ও আদেশ বহাল থাকে, যার বিরুদ্ধে আসামিরা হাইকোর্টে ফৌজদারি রিভিশন আবেদন দায়ের করেন।

হাইকোর্ট বিভাগও ২০১৭ সালের ২ মার্চ আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ করে দেন। ফলে সাজা ও জরিমানার রায় বহাল থাকে। এবার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামি নুর মোহাম্মদ আপিল বিভাগে আপিল করেন। যে আপিলের ওপর গত ২১ জানুয়ারি শুনানি করেন বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলীর নেতৃত্বাধীন দুই বিচারপতির বেঞ্চ। আপিল শুনানি শেষে আপিল বিভাগ নুর মোহাম্মদের লিভ টু আপিল নিষ্পত্তি করে রায় দেন। রায়ে আপিল বিভাগ বলেন, দরখাস্তকারী নুর মোহাম্মদ একত্রিশ দিন কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। যতদিন কারাদণ্ড ভোগ করেছেন ততদিনই তার দণ্ড হিসেবে গণ্য হবে। এ ছাড়া তার জরিমানা বহাল থাকবে। গতকাল আপিল বিভাগের ওই রায়ের অনুলিপি প্রকাশিত হয়।

সূত্র-আমাদের সময়

সোনালীনিউজ/আইএ

Wordbridge School
Link copied!