ঢাকা : ভারত-পাকিস্তান ভাগের পরপরই তারা বসবাস করতে শুরু করেন করাচির শহরতলিতে। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পরও করাচির ঠিকানা বদলাননি ওই বাঙালিরা। কিন্তু এত বছরেও পাকিস্তানের নাগরিকত্ব তারা পাননি, এখনো তাদের দেখা হয় বিশ্বাসঘাতকের চোখে।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করাচি শহরের কেন্দ্র থেকে ইব্রাহিম হায়দেরি এলাকায় যেতে গাড়িতে লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। একসময় এ জায়গাটি ছিল ছিমছাম একটি জেলেপল্লী, তবে বর্তমানে এটি হয়ে উঠেছে করাচির নোংরা ঘিঞ্জি এক জনপদ, যেখানকার সিংহভাগ বাসিন্দা বাঙালি।
রাস্তা ধরে সাগরের দিকে যেতে থাকলে, পরিবেশ, গন্ধ, দৃশ্য, শব্দ সবই বদলে যেতে থাকে। যেখানে-সেখানে নোংরা পানি জমে আছে। তার ওপর ভাসছে আবর্জনা। আর রাস্তার দুপাশে বস্তির মতো সার সার ঘর। বিভিন্ন সময়ে গরিব দুস্থ মানুষজন এখানে এসে জীবন যাপনের চেষ্টা করেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে বাঙালিরাও।
১৫ লাখের মতো বাঙালি করাচির এই শহরতলিতে থাকে। এদের অধিকাংশই ভারত ভাগের পর থেকেই বংশপরম্পরায় এখানে রয়েছে। ’৭১ সালে পাকিস্তান ভাগের পর তাদের অনেকেই অবশ্য করাচি শহরে চলে যায়। কিন্তু এই লাখ লাখ বাঙালিকে পাকিস্তান এখনো তাদের নাগরিক হিসেবে মর্যাদা দেয়নি। এই বঞ্চনার সঙ্গে যতটা না রয়েছে জাতিসত্তার সম্পর্ক, তার চেয়ে বেশি রয়েছে পাকিস্তানের জটিল ইতিহাসের।
এলাকায় পাকিস্তানি বেঙ্গলি অ্যাকশন কমিটির সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করছেন জয়নুল আবেদিন। উচ্চাভিলাষী, তৎপর এই যুবক পাকিস্তানের রাজনীতিতেও ঢুকতে চান। সালোয়ার-কামিজ এবং কোটি পরা জয়নুল আবেদিনকে সাধারণ একজন পাকিস্তানির মতোই লাগে। তবে মুখের চেহারায় বাঙালির ছাপ।
বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘বাঙালিদের সিংহভাগই বয়সে তরুণ। এরা সব পাকিস্তানে তৃতীয় প্রজন্মের বাঙালি।’ কেমন আছেন তারা? জয়নুল আবেদিন বললেন, ‘আমরা খারাপ ছিলাম না একসময়। জাতীয় পরিচয়পত্র জোগাড় করতে কর্মকর্তাদের কিছু ঘুষ দিতে হতো। তাছাড়া ঠিকঠাকই চলেছে।’ তবে করাচিতে সন্ত্রাস এবং জঙ্গি তৎপরতা বাড়তে থাকায় জীবনযাপনের সেই স্বস্তি দিন দিন চলে যাচ্ছে। ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র জোগাড় করা পাকিস্তানের বাঙালিদের জন্য এখন প্রায় অসম্ভব।
আমারা ইউসুফ নামে বাঙালি কলোনির এক নারী তার ঘরের ভেতরে একটি স্কুল চালান। দুই বছর আগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, পরিচয়পত্র না থাকায় কোনো কলেজে ভর্তি হতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘আমি কি পাকিস্তানি নই? আমার জন্ম এখানে। আমার বাবা-মার জন্মও এখানে। তারপরও কেন তারা আমাদের বাঙালি বলে ডাকে। কেন পরিচয়পত্র দেয় না? ভাবলে খুবই কষ্ট লাগে, কিন্তু কী করার আছে আমাদের?’
আমারা মনে করেন, পাকিস্তানে বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর কোনো ভবিষ্যৎ নেই, কারণ তারা শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নাগরিকত্বের প্রশ্নে প্রতিবছর হাজার হাজার বাঙালি তরুণ-তরুণী কলেজ থেকে ঝরে পড়ছে। ফলে ছোটখাটো কাজে লেগে যাচ্ছে তারা। এরা হয় রাস্তার পাশে সবজি বেচছে, না হয় চায়ের দোকানে বা মুদি দোকানে কাজ করছে।
নিজের ঘরের সামনে ছোট এক উঠোনে কার্পেট বুনছিলেন নাসিমা। তার ঘরের অবস্থা জরাজীর্ণ, নোংরা। বয়সের তুলনায় বয়স্ক, ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তাকে। জানালেন একটি কার্পেট শেষ করতে চার থেকে ছয় সপ্তাহ লাগে। তা বেঁচে আয় হয় ৬০০ রুপি।
তিনি বলেন, ‘আইডি কার্ড না থাকায় আমার ভাই কোনো চাকরি পায় না, আমার বাবা পেনশন পায় না। এই কার্পেট বোনা ছাড়া উপায় কী?’ পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে নাসিমার বাবা, ভাই এলাকার বাইরে খুব একটা বেরোয় না। ফলে কলোনির ভেতরেই যেসব ছোটখাটো ফ্যাক্টরি আছে, সেখানে নামমাত্র পয়সায় খাটতে হয় অধিকাংশ বাঙালিকে।
পাকিস্তানে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান আসাদ ইকবাল বাট বিবিসিকে বলেন, ‘একজন অবাঙালি শ্রমিক যেখানে মাসে ১২-১৩ হাজার রুপি মজুরি পায়, একজন বাঙালি পায় তার অর্ধেক। বাঙালি মেয়েরা ফ্যাক্টরি, বাসাবাড়িতে কাজ করে। শুধু যে পয়সা কম তা নয়, যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে তারা।’
বাঙালি নেতা জয়নুল আবেদিন মনে করেন, সস্তা শ্রমের সুবিধার জন্য পাকিস্তানে কেউ চায় না বাঙালিরা দেশ ছেড়ে চলে যাক, কিন্তু বৈধতার জন্য কেউ তাদের জন্য কিছু করছেও না। মানবাধিকার কমিশনের আসাদ বাট বলেন, ‘সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর পাকিস্তানে বাঙালিরা ঘৃণার শিকার হয়ে পড়ে। তাদেরকে ছোট চোখে দেখা শুরু হয়, বিশ্বাসঘাতক হিসেবে দেখা শুরু হয়। রাখঢাক না রেখেই বৈষম্য শুরু হয়।’
বাঙালিরা নাগরিক নয়, সুতরাং তাদের ভোট নেই। ফলে, রাজনীতিকরা তাদের নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু জয়নুল আবেদিন হাল ছাড়তে রাজি নন, ‘যাই হোক না কেন আমরা এ দেশ ছেড়ে যাব না। আমরা এখানেই থাকব, এখানেই মরব।’
সোনালীনিউজ/এমটিআই







































