• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির রূপরেখা : ঈষৎ বীক্ষণ


কুমার দীপ জানুয়ারি ১৮, ২০২১, ০১:৩৮ পিএম
আমাদের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির রূপরেখা : ঈষৎ বীক্ষণ

ঢাকা : আমার অশীতিপর মায়ের কাছে একাত্তর বা মুক্তিযুদ্ধের কথা জানতে চাইলে তিনি মাঝে-মধ্যে বলেন, সে একদিন গেছে, ঘাসের চালের ভাত রান্না করে, কচুশাক সেদ্ধ করে খা’য়েছে মানুষ। বুনো কচুশাক, তা-ও পাওয়া মিলতো না সবসময়; হেলেঞ্চা শাক, মাদারের পাতা... আরও কতো কী খা’য়ে মানুষের দিন গেছে!— দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার যোগ করেন— কাজ ছেলো না, খাবার ছেলো না, তার মধ্যি আবার খানেগো লোকেরা আইসে যারে-তারে ধুরে নে’ যা’তো, রাইত হলি বাড়ির পুরুষরা আগানে-বাগানে পালিয়ে পালিয়ে থাকতো!... ওরাম দিন যেন আর না-আসে মানুষের জীবনে।

মায়ের কথা ইতিহাসের সত্য। একাত্তরের আগেরও অনেক দুঃখময় জীবনের সাক্ষী আছেন আমার মায়ের বয়সি মানুষেরা। তাদের কথা সরিয়ে রেখে এই আমাদের মতো সত্তরের দশকে তথা মুক্তিযুদ্ধের পরে জন্মেছি যারা, তারাও যেটুকু দেখেছি, তার সাথে মেলালেও তো আজকের দিনের সাথে আকাশ-পাতাল ব্যবধান খুঁজে পাই। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে, আমি যখন শৈশব-কৈশোর অতিক্রম করছি; আমার জন্মগ্রাম ভুরুলিয়া ও তার আশপাশের কাশেমপুর-ব্রহ্মশাসন- নাগবাটি-দেউলদিয়া- কাঁচড়াহাটি-খানপুর- চালতেঘাটা-সিরাজপুর প্রভৃতি কয়েকটি গ্রাম, আমার মামার বাড়ি কাচিহারা এবং সেখানকার দু-একটি পাড়া এবং মায়ের আঁচল ধরে দেখা দুর্গাবাটি-মুন্সিগঞ্জসহ সুন্দরবনসংলগ্ন অন্যান্য দু-একটি আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি... এই ছিল আমার দেখার দৌড়। তো সেইসব গ্রামের একাধিক নারীকে দেখেছি, সকালে ধনী বাড়ি থেকে কিছু কাজের বিনিময়ে পান্তাভাত আনতে। সেই ভাতে, ভাতের চেয়ে জলই বেশি। ভাতটুকু ছোট্ট ছেলে-মেয়েকে দিয়ে জলটুকু নিজে চুমুক দিয়ে খেয়ে দিনের প্রথমার্ধ কাটাতো তারা। দুপুরে একমুঠো চাল ফোটাতো। কিছু শাক-পাতা জোগাড় করে রান্না করত। সন্ধ্যা নামতেই ঘনিয়ে আসত আঁধার। রাতের বেলায় সবার খাওয়া হতো কি না জানি না, সকালে উঠে আবার সেই একই দৃশ্য। আশ্বিন-কার্তিক মাসের দিনগুলো ছিল আরো অনাকাঙ্ক্ষিত রকমের কটু। অনাহারে-অর্ধাহারে থাকা গরিব পরিবারগুলো হাড় জিরজিরে মানুষে ভরে থাকত। পরিবারের সদস্যদের মুখে একমুঠো ভাত তুলে দেওয়ার জন্য কী সংগ্রাম চলত প্রায় কর্মহীন পরিবারকর্তাদের! ধারদেনা থেকে শুরু করে টুকটাক চুরি-ছ্যাঁচড়ামিও করতে বাধ্য হতো তারা। বর্ষা মৌসুমে জমি চাষ ও ধান রোয়া এবং হেমন্ত ও শীত মৌসুমে ধান কাটা, মহাজনের ঘরে তোলা ও মাড়াইয়ের দিনগুলোতেই যেটুকু স্বস্তি ফিরত ওদের জীবনে। বর্ষার দিনে অবশ্য গ্রামের পথগুলো আর পথ থাকত না, জল-কাদার ভাগাড়ে পরিণত হতো। রাতের অন্ধকারে গ্রামজুড়ে নেমে আসত ভৌতিক অতীন্দ্রিয়তা! অতিবর্ষণে গ্রামের কোনো কোনো মাটির ঘর ধসে পড়ত, দেয়ালচাপা পড়ে দু-একজন মারাও যেত; কেউ কেউ প্রতিবন্ধী। আর হ্যাঁ, ভূত থাক বা নাক, ভূতের আতঙ্ক ছিল অসীম, যে-কোনো অসুস্থতায় ঝাড়-ফুঁতে পারদর্শী মানুষদের কদর ছিল ঘরে ঘরে। পৌষ-মাঘের দিনগুলোতে খাবারের কিছুটা স্বস্তি মিললেও অভাবী মানুষগুলোর শীত নিবারণে চলত আরেক যুদ্ধ। খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাই ছিল যাদের সংগ্রাম, তাদের কাছে লেখাপড়া তো ছিল দূর পরাহতপ্রায়। আর এখন?

আমার গ্রাম কিংবা আরো অনেক গ্রাম মিলিয়ে এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না— যাদের অনাহারে বা অর্ধাহারে দিন কাটছে। যারা কোনোদিন নিজের কেনা একটা শাড়ি কিংবা লুঙ্গি পরেছে কি না সন্দেহ, তাদের সন্তানরা এখন কেবল একাধিক পোশাকই পরিধান করে না, নববর্ষ-ঈদ-পূজাসহ বিভিন্ন উৎসবে পছন্দের পোশাকের সন্ধানে দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়ায়। মাঘের শীতও তাদেরকে বিশেষ কাবু করতে পারে না। মাটির দেয়ালের ঘর আর ধানের নাড়ার ছাউনিযুক্ত ঘরই যাদের একমাত্র অবলম্বন ছিল, তাদের অনেকেই এখন ইটের দেয়াল ও টিনের ছাউনিতে থাকে, কেউ কেউ ছাদযুক্ত পাকা ঘরের বাসিন্দা। যাদের ঘরে একটা রেডিও ছিল না, তারা এখন এলইডি বা স্মার্ট টেলিভিশনে স্যাটেলাইট চ্যানেল দ্যাখে। শারীরিকভাবে পৌঁছানো কিংবা কারো দ্বারা পত্র লিখে-পড়ে নেওয়া ব্যতীত কারো সাথে যোগাযোগের কোনো মাধ্যমই ছিল না যাদের, তাদের সন্তানরা এখন স্মার্টফোন হাতে রাত জাগে। অসুস্থ হলে তাবিজ-কবজ-কবিরাজই যাদের সর্বোচ্চ গন্তব্য ছিল, তারাও এখন উচ্চ ডিগ্রিধারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। শিক্ষার কথা কী বলব- এখন অন্তত প্রাইমারি স্কুলে যায় না বা যায়নি এমন শিশু নেই বললেই চলে। বেশিদিন আগের কথা নয়, নব্বইয়ের দশকে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখছি, আমাদের এক আত্মীয়া বলেছিল— ‘কী দরকার বাবা, অতদূরি নেকাপড়া কত্তি যাবার, মা’র ছাবাল, মা’র কাছেই থাইকে যা-হয় পড়ো।’ এখন প্রায় প্রত্যেক পরিবার থেকে দু-একজন ছেলেমেয়ে দেশের বড়ো শহরে, কেউ কেউ দেশের বাইরেও পড়ালেখা করছে। আমাদের শৈশবে যে পথে যেতে আষাঢ়-শ্রাবণে হাঁটুকাদায় আটকে গেছি, কোমর পানিতে ডুবেছি; সে পথ এখন কালো কার্পেটে ঢাকা, হামেশাই ইঞ্জিনের গাড়ি চলে। বাঁশের সাঁকোতে কিংবা সাঁতরে পার হয়েছি যেসব খাল, খেয়া নৌকার জন্যে বসিয়ে রেখেছে যে নদী... সেগুলো এখন ব্রিজ বুকে নিয়ে পথিকের জন্য তৈরি থাকে দিন-রাত। যে-গ্রাম কোনোদিন কেরোসিন বাতির অধিক কিছু ভাবেনি, সন্ধ্যা হলেই অন্ধকারের গহ্বরে তলিয়ে থেকেছে; সে-গ্রাম এখন বিজলির আলোয় ঝলমল করে মধ্যরাত অবধি। যারা নিজেদের অধিকার-কর্তব্য সম্পর্কে কিছুই জানত না, তারা এখন প্রায় ঘরে বসেই অনলাইনে বহুবিধ সুবিধা গ্রহণ করে, অন্যকে সেবা দেয়; সমস্ত পৃথিবীটাই তাদের ছোট্ট করতলে বন্দি।

২.

আমাদের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির প্রধান দৃশ্যগুলো যখন ছুঁয়ে যেতে চাচ্ছি, তখন পদ্মা সেতুর ৪১তম, তথা শেষ স্প্যানটি বসানোর আনন্দে উদ্বেলিত হচ্ছে দেশ। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বিশালাকৃতির এই স্থাপনাটি আমাদের আর্থিক সক্ষমতার এক অনন্য স্মারক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে যে অবিশ্বাস্যপ্রায় একটি স্বপ্নের সূচনা হয়েছিল, ২০২০-এর বিজয়ের মাসে এসে সেই স্বপ্নের পূর্ণতা পেল বলা যায়। এই অসাধ্য সাধন সম্ভবের পেছনে সবচেয়ে বড় দৃঢ়তা যার, তিনি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে বাংলাদেশের মানুষের জন্য পদ্মা সেতু যে অসামান্য একটি উপহার!

এবার আমাদের সার্বিক অগ্রগতির কাগুজে পরিসংখ্যানের সামনে-পেছনে একটু যদি তাকাই, দৃশ্যগুলো আরেকটু প্রামাণ্য ভিত্তি পেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের পরের বছর, তথা ১৯৭২-এ বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ১০৯ মার্কিন ডলারের মতো; কোনো কোনো তথ্যে তা ১০০ ডলারের নিচে। ১৯৭৩ সালে বিশ্বব্যাংকের একটি পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১২৯ ডলার বলে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২০-এর প্রতিবেদন অনুসারে এই আয় ১৯০৯ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্ট অনুসারে বর্তমানে তা ২০৬৪ ডলারে পৌঁছেছে। স্বাধীনতার বছরে যেখানে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত, সেখানে বর্তমানে মাত্র ২১.৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২০)। চরম দারিদ্র্যসীমায় রয়েছে ১১.৩  শতাংশ মানুষ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছর, বর্তমানে তা ৭২ দশমিক ৬ বছর হয়েছে। স্বাধীনতার সময় আমাদের সাক্ষরতার হার ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ, বর্তমানে এই হার ৭৪ দশমিক ৭-এ পৌঁছেছে। খাদ্যের অভাব আর ব্যাপক খাদ্য আমদানির দেশ থেকে বর্তমানে খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ হয়ে উঠেছে। এরকম আরো অনেক পরিসংখ্যান, যেমন— শিশু মৃত্যুহার হ্রাস, প্রসূতি মায়ের মৃত্যুহার কমানো, স্থ্থূল মৃত্যু ও জন্মহার নিয়ন্ত্রণ, শিশুর শিক্ষাগ্রহণের হার বাড়ানো, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার অগ্রগতি, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি ইত্যাদি সব সূচকেই বাংলাদেশের অগ্রগতি উল্লেখ করার মতো। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে দেশের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, সেই পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে মাথাপিছু আয় এবং জীবন-যাপনের একাধিক সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে কয়েক বছর আগেই, অতিসম্প্রতি আইএমএফ জানিয়েছে মাথাপিছু আয়ে ভারতকেও টপকাতে পারে বাংলাদেশ। স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গড় হিসেবেও ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। শুধু বাংলাদেশ সরকারের হিসাবেই নয়- আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য ও বিশ্লেষণ অনুসারেই বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুতহারে বর্ধনশীল একটি শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ। ইউনিসেফ, ইউনেস্কোসহ আরো একাধিক সংস্থাই বাংলাদেশের শিশুশিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে ইতিবাচক ধারণা প্রকাশ করেছে। সব মিলিয়ে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি বিশেষভাবে উল্লেখ করবার মতো। কথিত তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ থেকে মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার মহাসড়কে বাংলাদেশ এখন সবেগে ধাবমান।

লেখক : কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!