• ঢাকা
  • সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
SonaliNews

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত নিউজ পোর্টাল

মাংসের দাম বাড়ানোর নেপথ্যে তিন সিন্ডিকেট!


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ১৪, ২০১৭, ০৯:০৯ পিএম
মাংসের দাম বাড়ানোর নেপথ্যে তিন সিন্ডিকেট!

ঢাকা: গরুর মাংসের স্বাদ প্রায় ভুলতেই বসেছে দেশের সাধারণ মানুষ। গত কয়েক বছরে নাগালের বাইরে যেতে যেতে এখন প্রায় পাত ছাড়া। কোরবানির ঈদ ছাড়া এই মাংস জোটানো এখন অনেকটাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিকল্প হিসেবে খাসির মাংস তো পাত ছাড়া আরো আগেই।

শেষ ভরসা-ব্রয়লার মুরগির মাংসের বাজারও নিয়ন্ত্রণহীন। ফলে সবচেয়ে প্রিয় গরুর মাংসের জন্য এখন ঘরে ঘরে চলছে এক ধরনের হাপিত্যেস। না পারছে মাংস কিনতে; না পারছে এ থেকে পাওয়া প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে। এমনকি বিভিন্ন হোটেল ও ফাস্টফুডের দোকান থেকে প্রায় উধাও হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা গরুর মাংস থেকে তৈরি নানা উপাদেয় মুখরোচক খাবারও।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্য বৃদ্ধিই গরুর মাংসের এ অবস্থার মূল কারণ। গত বছরও দেশের বাজারে গরুর মাংসের জাতীয় গড় দাম ছিল কেজিপ্রতি ৩৮০ টাকা, আগের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে ৩৩০ টাকা এবং ২০১৪ সালে ২৭৫ টাকা। এখন সেই মাংস কিনতে গুনতে হচ্ছে কেজিপ্রতি ৪৮০ থেকে ৫২০ টাকা। আর গত ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে মাংস ব্যবসায়ীদের ছয় দিনের ধর্মঘট শেষে এক লাফে সেই মাংসের দাম বেড়ে যায় কেজিপ্রতি ৫০ টাকা।

নিম্ন আয়ের ক্রেতারা বলছেন, গরুর মাংসের বদলে তারা কিছুটা কম দামে গরুর মাথার মাংস কিনতেন। অথচ সেই মাংসও এখন বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৩২০ টাকা; যা গত বছরও ছিল ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা। গরুর ভুঁড়ির দাম বেড়ে হয়েছে কেজিপ্রতি ২০০-২২০ টাকা, যা ছিল ৮০-১০০ টাকা। এমনকি ছয় মাস আগের ১২০-১৫০ টাকার একটি মগজ এখন কিনতে হচ্ছে ২০০ টাকায়।

এমনকি মাংস ব্যবসায়ীদের ধর্মঘটের দোহাই দিয়ে বেড়েছে অন্যান্য মাংসের দামও। খাসির মাংসের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ১০০ টাকা। ৮০০ টাকার নিচে এ মাংস কেনা যাচ্ছে না। ছাগল ও ভেড়ার মাংস বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা দরে; যা আগে কেজিপ্রতি ৫০-১০০ টাকা কম ছিল।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, গত এক বছরে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ২৪ শতাংশ এবং ২৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে খাসির মাংস। ব্রয়লার মুরগির দাম অপরির্তিত থাকলেও দেশি মুরগির দাম বেড়েছে ৮ শতাংশ পর্যন্ত।

কিন্তু কেন বাড়ছে দফায় দফায় গরুর মাংসের দাম-জানতে চাইলে বিশেষজ্ঞরা বলেন, মূলত গরুর মাংসের দাম বাড়তে থাকে ভারতে নরেন্দ্র মোদি সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ২০১৫ সালের এপ্রিলের পর থেকেই। দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং সে দেশের সীমান্তরক্ষীদের উদ্দেশে বাংলাদেশে গরু ঢোকা পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে বলেন। এরপর থেকেই ধাপে ধাপে মাংসের দাম বেড়েছে। বৃদ্ধির এ কারণ ভারত থেকে গরুর সরবরাহ কমে যাওয়া।

এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি গোলাম মর্তুজা বলেন, আমাদের দেশে যে পরিমাণ গরু জবাই হওয়ার দরকার, তার তিনভাগের একভাগও হয় না। শুধু ঢাকা শহরেই প্রতিদিন আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার গরুর প্রয়োজন। সেখানে মাত্র ৮০০-১০০০ গরু জবাই হচ্ছে। ফলে মাংস সংকট রয়েছে। কোনো কোনো ব্যবসায়ী সে সুযোগটাও নিতে পারে। তবে দাম বাড়ার আরো কিছু কারণ রয়েছে। গরু কিনতে গরু প্রতি ইজারা ছিল ৫০ টাকা। এখন ইজারাদাররা গরু প্রতি নিচ্ছে ৪০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত। ফলে মাংসের দাম না বাড়ালে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

তিনি আরো বলেন, এখন যে দামে বিক্রি হচ্ছে, তাতেও মাংস ব্যবসায়ীদের লোকসান হয়। লোকসানের কারণে বাজারের ৫০ শতাংশ মাংসের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি গরুর মাংসের দাম বাড়ার জন্য গরুর দাম বাড়া ও সংকট, গাবতলী গরুর হাটে অবৈধ হারে খাজনা আদায়, চাঁদাবাজি ও চামড়ার দাম কমে যাওয়াকে দায়ী করেন।

তবে সমিতির এই কর্মকর্তার সম্পূর্ণ কথা মানতে নারাজ প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হক। তিনি বলেন, ভারতীয় গরু ছাড়াই মাংসের চাহিদা মেটানো সম্ভব। মানুষের ধারণা ছিল, ভারত থেকে গরু না এলে কোরবানি হবে না। কিন্তু আমরা গত দুবার ভারত থেকে গরু আমদানি ছাড়াই কোরবানি সম্পন্ন করেছি। দেশের গরু পরিপক্ব হতে ছয়-সাত বছর লাগলেও এখন তা দুই বছরের মধ্যেই নামিয়ে আনতে ব্রাজিলের প্রযুক্তি আনা হচ্ছে।

মন্ত্রী আরো বলেন, দেশে দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়েছে। এর মধ্যে অতীতের চেয়ে মাংস ৩ গুণ বেশি উৎপাদন হচ্ছে। তবে চাহিদার তুলনায় এখনো এর উৎপাদন কম। মাংসের ৭০ লাখ মেট্রিক টন চাহিদার বিপরীতে জোগান ৬১ লাখ মেট্রিক টন। মাংসের জোগান বাড়াতে ব্রাজিল থেকে উন্নত প্রজাতির গরু এনে প্রজননের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। মন্ত্রী মূল্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীদের কারসাজিকেও দায়ী করেন।

এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সিটি করপোরেশন যেভাবে দাম নির্ধারণ করে, সেটি অযৌক্তিক। গত রোজার পরে আর দাম নির্ধারণ করা হয়নি। এমনকি রোজাতে যে দাম বেধে দেয়া হয়েছিল, বিক্রেতারা সে দামের অনেক বেশিতে বিক্রি করেছেন। দেশের অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ও হালনাগাদ বাজার বিশ্লেষণ করে দাম নির্ধারণ করতে হবে।

বাজার ঘুরে ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে গরুর মাংসের দাম কমছে না। এই কারসাজির সঙ্গে গরুর মাংস ব্যবসায়ী এবং গরু আমদানিকারক ও বিক্রেতারা জড়িত। সংশ্লিষ্টরা বলেন, গরু, মহিষ, ছাগলসহ গবাদিপশুর দাম বেড়েছে ঠিকই; কিন্তু মাংসের দাম বেড়েছে সে অনুপাতে অনেক বেশি। এটি হয়েছে বাজারের অস্থিরতার কারণে।

আগে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া আমদানির পরিমাণ ছিল মোট চাহিদার ৫৫ শতাংশ এবং তা আনতে কোনো বাধা ছিল না। ভারতের পাঁচটি প্রদেশ-আসাম, সিন্ধু, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, পশ্চিমবঙ্গে গরু-মহিষ লালন-পালনই বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য। তখন কমিশন ছিল ২ হাজার টাকা। বিজিবি ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ধীরে ধীরে কমিশন দাঁড়িয়েছে ৩০-৪০ হাজার টাকা গরুপ্রতি।

ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরিত না হওয়ায় ৪ হাজার টাকার গরু চামড়া বিক্রি হচ্ছে ৬০০-৮০০ টাকায়। ছাগলের চামড়া বিক্রি হচ্ছে ২০-৩০ টাকায়। হুন্ডির মাধ্যমে যারা টাকা পাচার করেন, তাদের কমিশন ৫-৬ হাজার টাকা। গাবতলী গরুর হাটের ইজারাদার ৫০ টাকার চেক আদায় করছেন ২-৫ হাজার টাকা। ১০ হাজার টাকায় একটি গরু ক্রয়ের পরে গাবতলী গরু হাট পর্যন্ত মূল্য দাঁড়ায় ৬১-৬২ হাজার টাকায়। সেই সঙ্গে রয়েছে মাংস ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফা। ফলে দাম বেড়ে যাচ্ছে মাংসের।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এমএইচএম

Wordbridge School
Link copied!