• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মেহমানদারির ফজিলত


নিজামুল ইসলাম নিজাম   ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২১, ০৭:০২ পিএম
মেহমানদারির ফজিলত

ঢাকা : অতিথিপরায়ণতা মানুষের একটি মহৎ গুণ। আর আখিরাতে যারা চিরস্থায়ীভাবে জান্নাতের অধিকারী হবে, তাদের একটি মহৎ বৈশিষ্ট্য হবে, তারা দুনিয়ায় অতিথিপরায়ণ হবে এবং দুর্বল, নিঃস্ব-অসহায়, অনাহারিদের নিঃস্বার্থভাবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে খাদ্য খাওয়াবে। কিন্তু আমরা অনেকেই দুর্বল, নিঃস্ব-অসহায়দের খাদ্যের ব্যবস্থা করে থাকি নিজেদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে অথবা সমাজে যশখ্যাতি অর্জনের লক্ষ্যে। আর এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, অনাহারীদের আহারের ব্যবস্থা করা যদি হয় নিজের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে, তবে শত শত অনাহারীকে খাদ্য দানে কোনোই ফায়দা হাসিল হবে না। এজন্য ক্ষুধার্তকে খাদ্য দিতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। নিজের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে নয়। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘(যারা জান্নাতি হবে) খাদ্যের প্রতি মহব্বত থাকা সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্ত, ইয়াতিম ও বন্দিকে খাবার দান করে। এবং তারা বলে, ‘শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদেরকে খাবার দান করি, আমরা তোমাদের কাছ থেকে কোনো প্রতিদান চাই না, চাই না কোনো কৃতজ্ঞতাও।’ (সুরা দাহর, আয়াত নং- ৮,৯ ) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র হাদিসে বলেছেন, ‘তোমরা দয়াময় রাহমানের ইবাদত কর, (মানুষকে) খাবার খাওয়াও এবং সালামের অধিক প্রচলন ঘটাও, তবেই নিরাপদে জান্নাতে যেতে পারবে।’ (তিরমিজি, হাদিস নং- ১৮৫৫) আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞেস করল, ইসলামে কোন জিনিসটি উত্তম? তিনি বললেন, ‘তুমি (অপরকে) খাদ্য খাওয়াবে এবং চেনা অচেনা সকলকে সালাম দিবে (এটাই ইসলামে উত্তম)।’ (বুখারি, হাদিস নং- ১২)

মেহমানদারি ইসলামের মধ্যে সর্বোত্তম নেক আমল বলা হয়েছে। তবু আমরা অনেকেই দুনিয়ার সাময়িক আর্থিক লোকসানের কথা ভেবে আখেরাতের চিরস্থায়ী লাভের কথা ভুলে গিয়ে মেহমানদারী করতে খুবই কৃপণতা ও কুণ্ঠতাবোধ করি। অথচ আল্লাহ যাদের কল্যাণ চান, তাদের ঘরে একজন মেহমান পাঠিয়ে দেন। সুতরাং যে ব্যক্তি চায় মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে, সে যেন মেহমানকে সমাদর করার মাধ্যমে সন্তুষ্ট রাখে। কেননা মেহমানের সন্তুষ্টি অর্জনই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নামান্তর। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর এবং আখিরাতের দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে।’ (বুখারি, হাদিস নং- ৬০১৮)

মেহমানকে দুভাবে সম্মানিত করতে হবে। সুন্দর রুচিশীল খাবার মেহমানের সামনে উপস্থাপন করার মাধ্যমে এবং মেহমানের সঙ্গে সুন্দর আচার-আচরণ ও ব্যবহারের মাধ্যমে। এই দুটির যেকোনো একটি অভাব হলে মেহমানদারির মর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই মেজবানের উচিত, মেহমানের হক্ব আদায় করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করা। মেজবানের ওপর মেহমানের হক্ব সম্পর্কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর এবং শেষ দিনের ওপর বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে তার প্রাপ্যের বিষয়ে। জিজ্ঞেস করা হলো, মেহমানের প্রাপ্য কী, হে আল্লাহর রাসুল? তিনি বললেন, ‘(মেহমানের প্রাপ্য হচ্ছে) একদিন একরাত ভালোভাবে মেহমানদারি করা আর তিন দিন হলে (সাধারণ) মেহমানদারি করা, আর তার চেয়েও অধিক হলে মেহমানের প্রতি দয়া করা।’ (বুখারি, হাদিস নং- ৬০১৯)

সোনালি যুগের সোনার মানুষ সাহাবায়ে কেরাম কীভাবে মেহমানদের সমাদর করতেন এবং কীভাবে মেহমানের হক আদায় করতেন, সে ব্যাপারে একটি চমৎকার ঘটনা হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হইতে বর্ণিত আছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, এক লোক নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে আসল। অতঃপর রাসুল (সা.) তাঁর স্ত্রীদের কাছে (খাদ্যের জন্য) একজন লোক পাঠালেন। তাঁরা জানালেন, আমাদের কাছে পানি ছাড়া কিছুই নেই। তখন রাসুল (সা.) বললেন, কে আছো যে এই ব্যক্তিকে মেহমান হিসেবে নিয়ে নিজের সাথে খাওয়াতে পার? তখন এক আনসারী সাহাবি

বললেন, ‘আমি আছি ইয়া রাসুলুল্লাহ’! এ বলে তিনি মেহমানকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে গেলেন এবং স্ত্রীকে বললেন, নবীজির মেহমানকে যথাযথ সম্মান কর। স্ত্রী বললেন, বাচ্চাদের খাবার ছাড়া আমাদের ঘরে অন্য কিছুই নেই। আনসারী সাহাবি বললেন, তুমি আহার প্রস্তুত কর এবং বাতি জ্বালাও এবং বা’চারা খাবার চাইলে তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। সে বাতি জ্বালালো, বাচ্চাদের ঘুম পাড়ালো এবং সামান্য খাবার যা তৈরী ছিল তা মেহমানের সামনে উপস্থিত করল। বাতি ঠিক করার বাহানা করে স্ত্রী উঠে গিয়ে বাতিটি নিভিয়ে দিলেন। তারপর তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনই অন্ধকারের মধ্যে আহার করার মতো শব্দ করতে লাগলেন এবং মেহমানকে বোঝাতে লাগলেন যে, তারাও সঙ্গে খাচ্ছেন। (মেহমানকে সন্তুষ্ট রাখতে) তাঁরা উভয়েই সারা রাত অভুক্ত অবস্থায় কাটালেন। ভোরে যখন তিনি রাসুল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গেলেন, তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ্ তোমাদের গতরাতের কাণ্ড দেখে খুশি হয়েছেন এবং এই আয়াত নাজিল করেছেন।’ ‘তারা অভাবগ্রস্ত সত্ত্বেও নিজেদের ওপর অন্যদের অগ্রগণ্য করে থাকে। আর যাদের অন্তরের কৃপণতা হতে মুক্ত রাখা হয়েছে, তারাই সফলপ্রাপ্ত।’ (বুখারি, হাদিস নং- ৩৭৯৮)

মেহমানের জন্য কয়েকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো; মেহমান যেন খাদ্যের অযাচিত ভুল-ত্রুটি ধরার পিছনে না পড়ে মেজবানের প্রশংসায় সর্বদায় পঞ্চমুখ থাকে। মেজবানের সাধ্যের অতিরিক্ত কোনো কিছু পাওয়ার আশা না করে। সর্বশেষ মেহমানের উচিত মেজবানকে শুনিয়ে শুনিয়ে যেন মন খুলে এই বলে দোয়া বলে, ‘হে আল্লাহ! যে আমার খাবারের ব্যবস্থা করল তুমি তার খাদ্যের ব্যবস্থা কর। আর যে আমাকে পান করালো তুমিও তাকে পান করাইও।’ (মুসলিম, হাদিস নং- ৫২৫৭)

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া

Wordbridge School
Link copied!