ঢাকা : আখেরি চাহার শোম্বা— মুসলিম বিশ্বে অত্যন্ত মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়ে থাকে। ইসলামের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (স.)-এর জীবনে এ দিনটি বিশেষভাবে স্মরণীয়। দিনটিকে মুসলিম উম্মাহ খুশির দিন হিসেবে জানে এবং খুশির দিন হিসেবেই উদযাপন করে থাকে।
আখেরি চাহার শোম্বা কী?
আখেরি চাহার শোম্বা মূলত আরবি ও ফার্সি বাক্য। প্রথম শব্দ ‘আখেরি’ আরবি ও ফার্সিতে পাওয়া যায়। যার অর্থ হলো- শেষ। ফার্সি ‘চাহার’ শব্দের অর্থ হলো- সফর মাস এবং ফার্সি ‘শোম্বা’ শব্দের অর্থ হলো- বুধবার। অর্থাৎ ‘আখেরি চাহার শোম্বা’র অর্থ দাঁড়ায়- সফর মাসের শেষ বুধবার।
সফর মাসের শেষ বুধবার হজরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দীর্ঘ অসুস্থতার পর সাময়িক সুস্থ হয়ে ওঠার দিনকে স্মরণ করে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে ইবাদত ও উৎসব প্রচলিত তাই আখেরি চাহার শোম্বা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের মুসলিমরা রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি উদ্যোগে এ উৎসব-ইবাদত যথাযথ ধর্মীয় ভাবগম্ভীর্যের মাধ্যমে পালন করে থাকেন।
আখেরি চাহার শোম্বার স্বরূপ
রাসুল (সা.) ১১ হিজরির সফর মাসের শেষ দিকে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ বিষয়ে প্রচলিত রয়েছে যে এক ইহুদি কবিরাজ রাসুল (সা.)-এর চুল মোবারক নিয়ে জাদুটোনা করেছিল। ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সফর মাসের শেষ বুধবার তিনি কিছুটা সুস্থবোধ করে গোসল করেন এবং দুজন সাহাবির কাঁধে ভর করে মসজিদ-ই-নববীতে গিয়ে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করেন। ফলে সব মুসলমান খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান। সবাই সাধ্যমতো দান-সদকা করেন।
শুকরিয়ার নামাজ আদায় ও দোয়া করেন। কেউ কেউ দাস মুক্ত করে দেন। অবশ্য বিকেলেই তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁর সুস্থতায় আর উন্নতি হয়নি, তিনি আর গোসলও করেননি। পরে ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার ইন্তেকাল করেন।
তাই অনেকেই সফর মাসের আখেরি চাহার শোম্বা বা শেষ বুধবারকে ‘শুকরিয়া দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে। বিভিন্ন দরবার শরিফে খুব জাঁকজমকের সঙ্গে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। শোকরানা-নফল নামাজ আদায় করা হয়। রোগমুক্তির দোয়া করা হয়। দান-খয়রাত করা হয়।
সরকারিভাবে ঐচ্ছিক ছুটি পালন করা হয়। কিন্তু কোরআন, হাদিসের আলোকে আমরা মনে করি এগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন। অনুরূপ ভিত্তিহীন ওপরে উল্লিখিত ঘটনা । এর কয়েকটি কারণ আছে :
১. রাসুল (সা.)-এর ওপর এক ইহুদি জাদু করেছিল। এটা ছিল হোদায়বিয়ার সন্ধির পরে সপ্তম হিজরির মহররম মাসের প্রথম দিকের ঘটনা। এই জাদুর প্রভাব কত দিন ছিল, সে সম্পর্কে দুটি বর্ণনা রয়েছে। এক বর্ণনায় ছয় মাসের কথা এসেছে, অন্য বর্ণনায় এসেছে ৪০ দিনের কথা। তবে যাই হোক, সুস্থতার তারিখ কোনোভাবেই ১১ হিজরির সফর মাসের ‘আখেরি চাহার শোম্বা’ বা ‘শেষ বুধবার’ হতে পারে না। (ফাতহুল বারি : ১০/২৩৭, আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া : ২/১৫৪, শরহুজ জুরকানি : ৯/৪৪৬-৪৪৭)
২. রাসুল (সা.)-এর সুস্থতার জন্য যে সাত কুয়া থেকে সাত মশক পানি আনা হয়েছিল এবং সুস্থতার জন্য তাঁর দেহ মোবারককে ধৌত করা হয়েছিল, তা কি বুধবারের ঘটনা না বৃহস্পতিবারের? ইবনে হাজার ও ইবনে কাসির একে বৃহস্পতিবারের ঘটনা বলেছেন। (ফাতহুল বারি : ৭/৭৪৮, কিতাবুল মাগাজি : ৪৪৪২, বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/১৯৩, সীরাতুন নবী, শিবলী নোমানী : ২/১১৩)
৩. এ তথ্যও সঠিক নয় যে বুধবারের পর রাসুল (সা.) আর গোসল করেননি। কেননা এরপর এক রাতে এশার নামাজের আগে গোসল করার কথা সহিহ হাদিসে স্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। (মুসলিম, হাদিস : ৪১৮, বুখারি, হাদিস : ৬৮১)। আর এ কথাও ঠিক নয় যে বুধবারের পর সুস্থতায় কোনোরূপ উন্নতি হয়নি। বরং এরপর আরেক দিন সুস্থবোধ করেছিলেন এবং জোহরের নামাজে শরিক হয়েছিলেন। (বুখারি , হাদিস : ৬৬৪, ৬৮০, ৬৮১, মুসলিম, হাদিস : ৪১৮) এমনকি সোমবার সকালেও সুস্থবোধ করেছিলেন। যার কারণে হজরত আবু বকর (রা.) অনুমতি নিয়ে নিজ ঘরে চলে গিয়েছিলেন। (সিরাতে ইবনে ইসহাক পৃ. ৭১১-৭১২, আর রাওজাতুল উলুফ : ৭/৫৪৭-৫৪৮)
৪. রাসুল (সা.)-এর সুস্থতার কারণে খুশি হওয়া কিংবা তাঁর সুস্থতার সংবাদ পড়ে আনন্দিত হওয়া প্রত্যেক মুমিনের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এ কথা দাবি করা প্রমাণহীন যে সাহাবায়ে কেরাম কিংবা পরবর্তী যুগের মনীষীরা সে খুশি প্রকাশের জন্য উপরোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন কিংবা একে উদযাপনের দিবস ঘোষণা করেছেন। এ দাবির সপক্ষে দুর্বলতম কোনো দলিলও বিদ্যমান নেই।
৫. রাসুল (সা.)-এর ওপর অনেক মসিবত এসেছে। আল্লাহ তাআলা তাঁকে নাজাত দিয়েছেন। তায়েফ ও ওহুদে আহত হয়েছেন। আল্লাহ তাঁকে সুস্থ করেছেন। একবার ঘোড়া থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছেন, যার কারণে মসজিদে যেতে পারেননি। আল্লাহ তাঁকে সুস্থ করেছেন। তাঁর সুস্থতা লাভের এসব আনন্দের স্মৃতিগুলোতে দিবস উদযাপনের কোনো নিয়ম আছে? তাহলে আখেরি চাহার শোম্বা যার কোনো ভিত্তি নেই, তা কিভাবে উদযাপনের বিষয় হতে পারে!
৬. কোনো দিনকে বিশেষ ফজিলতের দিবস মনে করা কিংবা বিশেষ কোনো আমল তাতে বিধিবদ্ধ রয়েছে বলে বিশ্বাস করা কিংবা তাকে ধর্মীয় দিবস হিসেবে উদযাপন করা শরিয়তের বিধানের অন্তর্ভুক্ত। অতএব, এগুলো ইসলামী শরিয়তের দলিল ছাড়া শুধু মনগড়া যুক্তির ভিত্তিতে তা সাব্যস্ত করা যায় না। এটি শরিয়তের একটি অবিসংবাদিত মূলনীতি। সুতরাং উপরোক্ত তথ্য ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশুদ্ধ হলেও এ দিবসকে ঘিরে ওই সব রসম-রেওয়াজ জারি করার কোনো বৈধতা সাব্যস্ত হয় না।
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :