• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে ভোগান্তি চরমে


বিশেষ প্রতিনিধি সেপ্টেম্বর ১০, ২০২১, ০৭:২৭ পিএম
ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে ভোগান্তি চরমে

ঢাকা : ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে পুরো প্রক্রিয়াটিই সংশ্লিষ্টরা এমনভাবে সাজিয়ে রেখেছে যে সেবাপ্রত্যাশীদের বাধ্য হয় দালালের শরণাপন্ন হতে হয়। এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে দৌড়ঝাঁপ; কোন কক্ষে যেতে হবে তারও নেই কোনো দিকনির্দেশনা। পদে পদে দীর্ঘ অপেক্ষা আর ভোগান্তি।

ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য লার্নার কার্ড করে ৩ মাস অপেক্ষার পর মৌখিক, লিখিত আর ফিল্ড টেস্ট দিতে জোয়ার সাহারা বিআরটিসি বাস ডিপোতে আসেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন।

জানালেন, পরীক্ষা দেওয়ার শুরুতেই তাকে পড়তে হয়েছে বিড়ম্বনায়। পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তার নামটি তালিকায় আছে কি না সেটি জানতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে তাকে।

বিআরটিসি বাস ডিপোর গেটের বাইরে একটি গাছে ছোট্ট একটি বোর্ডে টানানো হয় সেদিনকার পরীক্ষার্থীদের তালিকা। শত শত পরীক্ষার্থী ঠেলাঠেলি করে খুঁজে পেতে চেষ্টা করেন নিজের নামটি। অনেক কষ্টে নাম খুঁজে পাওয়ার পর প্রবেশ করতে দেওয়া হয় ভেতরে। সেখানে যাওয়ার পর আবারও দীর্ঘ লাইন।

দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর একটি ডেস্কের সামনে পৌঁছালে সেখানে লার্নার কার্ডে লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার সিরিয়াল দেওয়া হয়। এরপর আবারও অপেক্ষার পালা। আরো সময় অপেক্ষার পর সুযোগ আসে লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার।

পরীক্ষা দেওয়ার পর আবারও দীর্ঘ অপেক্ষা ফলাফলের জন্য। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের অপেক্ষা করতে হবে মৌখিক পরীক্ষার জন্য। সেখানেও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা আর লাইনে দাঁড়ানোর বিড়ম্বনা। মৌখিক পরীক্ষা দেওয়ার পর আবারও অপেক্ষা ফিল্ড টেস্টের জন্য।

ফিল্ড টেস্টের জন্য গাড়ি ভাড়া বাবদ গুনতে হয় টাকা। কেউ ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে গেলেও তা ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না। সব পরীক্ষা শেষে আবারও অপেক্ষা ফলাফলের। যারা পাস করবে তাদের কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে ফিঙ্গারসহ বায়োমেট্রিক টেস্ট দেওয়ার জন্য। তবে কবে নাগাদ এই টেস্ট হবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ জানানো হয় না।

অনুমানিক দেড়-দুই মাস পর সংশ্লিষ্ট বিআরটিএ অফিসে গিয়ে জেনে আসতে হবে কবে নাগাদ ফিঙ্গার দেওয়া যাবে। একাধিকবার যাওয়ার পর পাওয়া যাবে ফিঙ্গার ও ছবি দেওয়ার সুযোগ। ফিঙ্গার ও ছবি দেওয়ার জন্যও দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর কাটাতে হয়।

এর আগে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য জমা দিতে হবে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা। পূরণ করতে হবে ফরম এবং সেইসাথে জমা দিতে হবে আনুষঙ্গিক কাগজপত্র। টাকা ও ফরম জমা দেওয়ার ক্ষেত্রেও আছে দীর্ঘ লাইন আর প্রতীক্ষা।

সব ক্ষেত্রেই ফরম জমা দেওয়ার বিপরীতে তা ফেরত পেতে করতে হয় অপেক্ষা। এভাবে প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে ক্লান্ত-বিরক্ত হয়ে ওঠেন সেবাগ্রহীতারা। আর প্রতিটি ধাপেই দেখা পাওয়া যায় দালালদের। সেবা গ্রহীতাদের কখনো কখনো নিজেদেরকেই কাগজপত্র নিয়ে ছুটোছুটি করতে হয় কাউন্টার থেকে কাউন্টার আর বিভিন্ন কক্ষে। পদে পদে এতসব বিড়ম্বনা এড়াতে অনেকেই তাই শরণাপন্ন হন দালালের।

মিরপুর বিআরটিএতে দেখা যায় নির্দিষ্ট কর্মীর বদলে কাগজপত্র আনা-নেওয়া করেন আনসার সদস্যরা। কাগজপত্রগুলো কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন তারও কোন উত্তর নেই। সাধারণ নিয়ম আগে আবেদন করলে আগে সেবা পাবেন। অভিযোগ আছে টাকা না দিলে সেই নিয়মও থাকছে না।

লাইসেন্স প্রত্যাশীরা জানান, সিরিয়াল পেছনে, সেইগুলো আগে নিয়ে যেয়ে ঢোকাচ্ছে কিন্তু তারা ৬ ঘণ্টা ধরে এখানে অপেক্ষা করছেন। অন্য আরেকজন জানান, সিরিয়াল যাই থাক না কেন ৫শ টাকা দিলে আগে যাওয়া যায়। বিআরটিএতে অবস্থিত ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে এসব অনিয়ম।

বিআরটিএ উত্তরার দিয়াবাড়ি কিংবা কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া কার্যালয়ের অবস্থাও একই রকম। সবখানেই অভিযোগের শেষ নেই। বছরের পর বছর ঘুরছেন সেবা প্রত্যাশীরা।

তারা জানান, দালালের মাধ্যমে কাজ করলে দ্রুত কাজ হয়ে যাবে। কিন্তু নিজে গেলে কাজ হয় না। যার কাছেই যাই তিনি বলেন, আমরা কিছু জানি না। এরকম করে ঘুরায়, তাই দালাল ছাড়া কোন কাজ স্বাভাবিকভাবে হয় না।

এদিকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সকল পরীক্ষায় উত্তীর্নের পরও পাওয়া যাচ্ছে না ডিজিটাল বা স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স। কাগজের অস্থায়ী লাইসেন্স দিয়ে বছরাধিক সময় ধরে চলতে হচ্ছে চালকদের। নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে বিআরটিএ থেকে নবায়ন করতে হচ্ছে অস্থায়ী লাইসেন্স।

জানা যায়, টেন্ডার জটিলতার কারণে এতদিন স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রিন্টে বিলম্ব হচ্ছিল। তবে সম্প্রতি তার সমাধান হয়েছে। ঢাকার বাইরে কয়েকটি জেলায় স্মার্ট কার্ড ডেলিভারি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শামসুল কবির এ প্রসঙ্গে বলেন, আগামী নভেম্বর থেকে স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স বিতরন কাজ শুরু হবে। তবে সেবা গ্রহীতাদের হয়রানী কিংবা দালালদের দৌরাত্নের বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন,আগে এরকম অভিযোগ থাকলেও এখন তা নেই। সবকিছু কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, পরিবহন সেক্টরের সব ক্ষেত্রেই অনিয়ম আর হয়রানি। বিআরটিএ’র দুর্নীতিতো সবারই জানা।

তিনি বলেন,সরকার যেখানে ব্যপক কমসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারছে না সেখানে কিছু মানুষ স্বকর্মসংস্থানের প্রয়োজনে ড্রাইভিংকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার চেষ্টা করছেন। আর এ ক্ষেত্রেও যদি সংশ্লিষ্টরা প্রতিবন্ধকতা তৈরী করেন তা খুবই দু:খজনক।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ বলেন, দেশে গাড়ির তুলনায় চালকের স্বল্পতা রয়েছে। অনেকে গাড়ি চালাতে পারলেও লাইসেন্স না থাকার কারণে তাদেরকে আমার চাকরি দিতে পারছি না। ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেকে জাল ড্রাইভিং লাইসেন্সে গাড়ি চালাচ্ছেন। অনেকের গাড়ি চালনায় দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও লাইসেন্সের অভাবে গাড়ি চালাতে পারছেন না। তিনি লাইসেন্স প্রাপ্তির দীর্ঘ সূত্রিতা হ্রাস করে বরং চালকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দেন।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, করোনার কারণে দীর্ঘ সময় বিদেশ যাওয়া বন্ধের পর এখন আবারও সবকিছু স্বাভাবিক হতে চলেছে। বিদেশগামী অনেকের ড্রাইভিং লাইসেন্সের প্রয়োজন হচ্ছে। তাই দ্রুততম সময়েংর মধ্যে ড্রাইভিংলাইসেন্স দিতে তিনি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন।

তবে এর আগে আরেকটি অনুষ্ঠানে তিনি স্বীকার করেন, বিআরটিএ’র সেবা পেতে এখনো ভোগান্তি রয়েছে। এখনো দালালদের দৌরাত্ন্য রয়েছে। বিআরটিএর কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সঙ্গে দালালদের সখ্য ও যোগাযোগ রয়েছে। তবে প্রযুক্তির ব্যবহারে তা কমে আসছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!