• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
বছরে আক্রান্ত দেড় লাখের বেশি

দিশাহারা ক্যানসার রোগীর পরিবার


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ৮, ২০১৯, ১১:১৭ পিএম
দিশাহারা ক্যানসার রোগীর পরিবার

ঢাকা : বহুমুখী উপসর্গের এক রোগের নাম মরণব্যাধি ক্যানসার। যে রোগটিতে বেশিরভাগ রোগীরই মৃত্যু অবধারিত। রোগী যদি হয় নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের, তাহলে চিকিৎসা ব্যয়ে সর্বস্ব খোয়াতে হয় সে পরিবারটিকে।

দেশে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। ২০১৮ সালে দেশে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল দেড় লাখেরও বেশি। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার পরিসংখ্যান সূত্রের এই খবর।

বর্তমানে ক্যানসার রোগের চিকিৎসায় যে পরিমাণ চিকিৎসাকেন্দ্র আছে, তা রোগীর তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য। চিকিৎসা ব্যয়ও বেশিরভাগ রোগীর সামর্থ্যের বাইরে। এ জন্য অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়েছে।

রাজধানী ঢাকার ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের ৩০০ শয্যার হাসপাতালে রোগীদের পরিস্থিতি করুণ। এখানে দেখা যায়, বেশিরভাগ রোগীই নিম্ন আয়ের মানুষ। রোগীরা বলছেন, বেসরকারি হাসপাতালের চেয়ে সরকারি হাসপাতালে খরচ কম। কিন্তু দীর্ঘ সময় চিকিৎসা নিতে গিয়ে সর্বস্ব হারাতে হয় তাদের।

এক নারী রোগী বলেছেন, ‘সময়মতো ভর্তি হয়ে চিকিৎসা পাওয়া অনেক কঠিন। আমি ঢাকার বাইরে থেকে আসি। কিন্তু এখানে সময়মতো সিরিয়াল পাই না। ১০ দিন পর পর আসতে হয়। সময়মতো আসতে না পারলে চিকিৎসা পাই না। টাকাও অনেক খরচ হয়।’ জামালপুরের এই রোগী ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর প্রথম ধাপের অপারেশনেই তার পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর ধাপে ধাপে আরো খরচ বাড়ে। দুই বছরের মাথায় তার স্বামী স্ট্রোক করে মারা যান। এই নারী জানান, সংসার আর রোগীর খরচ সামলাতে না পেরে শুধু টেনশন করে উনি মারা গেলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিজামউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি ক্যানসার চিকিৎসা ও বাংলাদেশে এর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘চিকিৎসা ব্যয় পরিবারগুলোকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। দেশে একটা ক্যানসার ইনস্টিটিউট আছে। কেউ কেউ ক্যানসার চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরেও যান। কিন্তু সেটা দিয়ে কি আমরা বলতে পারি, জাতীয়ভাবে আমরা সমর্থ, মোটেও না।’

তিনি আরো বলেছেন, ‘প্রতিবছর অনেক মানুষ চিকিৎসা ব্যয়ের জন্য দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেক মানুষের ধারণা না থাকায়, চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন, নিজেও মারা যাচ্ছেন পরিবারকেও আর্থিকভাবে নিঃস্ব করে যাচ্ছেন। এই নিষ্ঠুর সত্যটা আমরা যতদিন না বুঝব, ততদিন ক্যানসার শব্দটা নিয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি হবেই।’

ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় একটি মাত্র সরকারি হাসপাতাল রয়েছে। আর বেসরকারি পর্যায়ে যেগুলো রয়েছে সেগুলো রোগীদের জন্য যথোপযুক্ত নয়।

জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের আরেক অধ্যাপক বলেন, যে হারে রোগী বাড়ছে, সে কারণে রোগীদের সেবা পেতেও সময় লাগছে। যদি দেড় লাখ রোগী আক্রান্ত হয়, এর তিন ভাগের এক ভাগ রোগীও ডায়াগনসিস হয়, তাহলে যে কয়টা হাসপাতাল আছে, তাতে ৫০ হাজার রোগীর চিকিৎসা দিতে ঢাকা শহর কী করে দেবে?’ অবশ্যই ‘লম্বা সময় লেগে যাবে। কেমোথেরাপি দিতে এক সপ্তাহ থেকে এক মাস বাইরে অন্এবং রেডিও থেরাপির সিরিয়াল পেতে চার পাঁচ মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায়। ঢাকার তত বিভাগীয় শহরে চিকিৎসাসেবা গড়ে তুলতে না পারলে মানুষের সাধ্যের মধ্যে চিকিৎসা করানো সম্ভব হবে কীভাবে?’

অন্যদিকে হাসপাতালগুলোয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরও সঙ্কট রয়েছে প্রকট। যে কারণে বিশেষায়িত হাসপাতালও গড়ে উঠছে না। আবার একটি হাসপাতালেই ক্যানসারের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার ব্যবস্থা এখনো করা যায়নি। ফলে রোগীকে চিকিৎসার বিভিন্ন পর্যায়ে হাসপাতাল পাল্টাতে হয়।

এ ছাড়া ভয়ঙ্কর এই রোগের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া অনেকটা দুষ্কর হয়ে যায়। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার পরিসংখ্যান প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি ছিল। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২২ হাজার।

জানা যায়, বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো পরিসংখ্যান নেই। এ জন্য কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। বাস্তবসম্মত কোনো পরিসংখ্যান ছাড়া চিকিৎসাসেবার পরিকল্পনা করাও সম্ভব হচ্ছে না।

সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালে ক্যানসার প্রতিরোধে একটা নীতিমালা করা হলেও সেটি কতটা কার্যকর হচ্ছে, সে বিষয়েও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই কারো কাছে। সেই নীতিমালা অনুযায়ীও যেসব হচ্ছে, সেটা বলা যায় না। তবে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করে বলেন, পুরুষের তুলনায় নারীদের ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা কম ছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে নারীদের আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।

ক্যানসার সচেতনতা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও বিশিষ্ট ক্যানসার রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন স্তন ক্যানসারের রোগী বাড়তে থাকা প্রসঙ্গে বলেন, ‘নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও এখন স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে নারীদের তুলনায় পুরুষরা সাধারণত স্তন ক্যানসারে কম আক্রান্ত হচ্ছেন। নারীদের এ ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তাদের জীবনযাত্রার পরিবর্তন। তারা এখন অনেক বেশি পথেঘাটে ধুলাবালিতে কাজ করেন। আর সন্তানকে স্তন পানে অনীহা, অনিয়মিত খাবার ও চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়াও নারীদের স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার কারণ। অন্যান্য কারণেও হতে পারে স্তন ক্যানসার।’

তিনি বলেন, ‘কারো ওজন কমে যাওয়া, দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে খুসখুসে কাশি হওয়া, পায়খানার সঙ্গে রক্ত বের হওয়া, হঠাৎ গলা বসে যাওয়া ও মাঝেমধ্যে জ্বর আসা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। রোগীর প্রাথমিক পর্যায়ে রোগের প্রতি অবহেলাও রোগকে অনেক সময় জটিল করে তোলে।’

দেশে অন্যান্য ক্যানসারের সঙ্গে গত কয়েক বছর ধরে বাড়ছে মাথা ও গলার (হেড, নেক) ক্যানসারের আক্রান্তের সংখ্যা। এক জরিপে ক্যানসার রোগীদের প্রতি তিনজনের একজন মাথা ও গলার ক্যানসারে আক্রান্ত। মোট ক্যানসার রোগীর অন্তত ৩৫ শতাংশ ভুগছেন এ ক্যানসারে। রোগীর সংখ্যা অন্তত সোয়া পাঁচ লাখ। দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সার্জনদের নিয়ে গঠিত ‘সোসাইটি অব হেড নেক সার্জনসের’ সভাপতি ডা. বেলায়েত হোসেন সিদ্দিকী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এ জাতীয় ক্যানসার শরীরের জটিল অঙ্গে আবির্ভূত হয়। শুধু মাথা ও গলাই নয়, এ ক্যানসারের অন্তর্গত মুখ, মুখগহ্বর, নাক, শ্বাসনালি, সাইনাস ও খাদ্যনালির উপরিভাগসহ বিভিন্ন লালাগ্রন্থিও। দেশে রোগটির চিকিৎসাব্যবস্থা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল হলেও দুর্লভ নয়।’

তিনি বলেন, ‘এ ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার বিশেষ কারণ মাদক। অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবারও আরেকটি কারণ। পান, সুপারি, তামাক ও জর্দা বর্জন, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন বিশেষ করে অ্যালকোহল-জাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে। মাদক পরিহার করে পাশ্চাত্যের অনেক দেশে মাথা ও গলার ক্যানসারের হার কমানো সম্ভব হয়েছে।’

অন্যদিকে দেশের উচ্চবিত্তরা ক্যানসারে আক্রান্ত হলেই দেশের বাইরে যাচ্ছেন চিকিৎসা করতে। আর নিম্ন আয়ের মানুষ চিকিৎসা করছেন দেশেই। যার কারণে চিকিৎসকরা ধারণা করেন, নিম্নবিত্তরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।

ক্যানসার চিকিৎসকরা বলেন, দেশে পেলিয়েটিভ কেয়ারের ব্যবস্থা কোনো দিনই ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিভাগ হয়েছে, এটা নিয়ে অহঙ্কার করি, গর্ববোধ করি। কিন্তু এই বিশাল সমুদ্রে এটা এক ফোঁটা পানি ছাড়া আর কিছুই না।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!