• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সমকামী সৌদি রাজপুত্রের অন্দর মহলের খবর ফাঁস করলেন ফুটবলার


আন্তর্জাতিক ডেস্ক জুলাই ২৩, ২০১৯, ০৮:০২ পিএম
সমকামী সৌদি রাজপুত্রের অন্দর মহলের খবর ফাঁস করলেন ফুটবলার

ঢাকা: গ্র্যান্ড হোটেল, কান, ১৯৭৬ সাল। গ্রীষ্মের এক রাতে লিফটের ভেতর এক রাজপুত্র এবং দরিদ্র এক ফুটবলার। ধনী মানুষটি প্রিন্স আবদুল্লাহ বিন নাসের, সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ’র নাতি এবং রিয়াদের সাবেক গভর্নরের ছেলে। কল্পনারও অতীত ধন-সম্পদের মালিক তিনি।

আর গরিব মানুষটির নাম ইমন ও’কিফি। ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারের একজন ফুটবলার। ছাপাখানার শ্রমিকের ছেলে। ওল্ডহ্যাম শহরে ছোট একটি বাড়িতে থাকেন। এই দু’জন সেদিন কানের একটি ক্যাসিনো থেকে ফিরছেন। প্রিন্স আবদুল্লাহ জুয়া খেলায় হেরেছেন সে রাতে। সব সময়ই হারেন তিনি। অবশ্য তাতে তার কিছু যায় আসে না। এক রাতে কয়েক হাজার ডলার নষ্ট হওয়া নিয়ে কোনো সৌদি রাজপুত্রেরই কিছু যায় আসে না।

ইমন জুয়া খেলেন না। কিন্তু তিনি জিতেছিলেন সে রাতে। তার দু’বছর বছর আগেও তিনি ইংলিশ তৃতীয় ডিভিশন ফুটবল লীগের ক্লাব প্লিমাথ আরগেইলের রিজার্ভ খেলোয়াড় ছিলেন। বাড়ির বিদ্যুৎ বিলের টাকা জোগাড় করতেই হিমশিম খেতেন। কিন্তু এখন তিনি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ এক ধনী পরিবারের সঙ্গী হয়ে বিমানের প্রথম শ্রেণিতে চড়ে ইউরোপ ঘুরছেন। পাঁচ তারকা হোটেলে থাকছেন।

ওই রাতে কানের গ্র্যান্ড হোটেলের লিফটে প্রিন্স আবদুল্লাহ ইমনের চোখে চোখ রাখলেন। আব্দুল্লাহ বললেন, আমি তোমাকে একটা কথা জানাতে চাই, আমার মনে হয় আমি তোমাকে ভালোবাসি।

তিনি এতটাই কাছে ছিলেন যে রাজপুত্রের শ্বাস-প্রশ্বাসের গন্ধ পাচ্ছিলেন ইমন; সিগারেট এবং হুইস্কির গন্ধ। ইমন জানতে চান, আপনি কি আমাকে আপনার ভাই হিসেবে ভালোবাসেন?

‘না’, আব্দুল্লাহ বললেন, ‘ঠিক ভাইয়ের মতো নয়।’

তারপর কানের ওই হোটেলের লিফট থেকে শুরু হলো ইমোনের বিপত্তির ইতিহাস। ইমন, যার বয়স এখন ৬৫, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ব্রিটেনে বড় হয়েছেন। ম্যানচেস্টারের উত্তরে ব্ল্যাকলে এলাকায় ছোট একটি সরকারি বাড়িতে থাকতেন। তিন ভাই এবং দুই বোনের সাথে তাদের নানিও থাকতেন ওই বাড়িতে।

ছোট এক বাড়িতে এত লোক রাতে ঘুমাতো কোথায়? ম্যানচেস্টারের একটি হোটেলে বসে হাসিমুখে ইমন বলেন, সে কথা ভেবে আমি এখনো অবাক হই।

জাতিতে আইরিশ তার বাবা স্থানীয় সেন্ট ক্লেয়ার ক্যাথলিক ফুটবল টিম নামে একটি ফুটবল দল চালাতেন। ক্লাবের জার্সিগুলো ধুয়ে ‌ইস্ত্রি করতেন তার মা। খেলা শেষে বলগুলো কুড়িয়ে বাড়িতে এনে ধোয়ার দায়িত্ব ছিল ইমনের ।

বাড়ির পাশে পার্কে ফুটবল খেলতেন ইমন। একসময় নজর কেড়েছিলেন তিনি। এমনকি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ক্লাবের ইয়ুথ টিমে ডাক পেয়েছিলেন। এক ম্যাচে তার পা ভেঙে যায়। ফলে ওল্ড ট্রাফোর্ডের মাঠে ফ্লাড লাইটের নিচে ফুটবল খেলার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায় তার। পা ভালো হলে স্টেলিব্রিজ সেলটিক নামে একটি আধা-পেশাদার ক্লাবে নাম লেখান। তখন ওই ক্লাবের কোচ ছিলেন জর্জ স্মিথ, যিনি পরে আন্তর্জাতিক স্তরে কোচিং করিয়েছেন।

স্টেলিব্রিজ ছেড়ে জর্জ সৌদি আরবের সবচেয়ে ধনী এবং বড় ক্লাব আল হিলালের ম্যানেজার হিসেবে চাকরি নিলেন। জর্জ চলে যাওয়ার পর স্টেলিব্রিজ ছেড়ে তিনশ মাইল দূরে প্লিমাথে চলে যান ইমন।

কিন্তু প্লিমাথে যে বেতন তিনি পেতেন, তা দিয়ে বাড়ি ভাড়ার পয়সাও হতো না। এক বছর না যেতেই বাড়ি ফিরে গেলেন। একদিন আরবি ডাকটিকেট লাগানো একটি চিঠি পেলেন তিনি। চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন সৌদি আরব থেকে জর্জ স্মিথ।

এক মাসের ট্রায়ালের জন্য তিনি ইমনকে সৌদি আরবে আসতে লিখেছেন। ট্রায়ালে ভালো করলে এবং সৌদি আরবের গরম সহ্য করতে পারলে ক্লাবের প্রথম ইউরোপীয় খেলোয়াড় হিসেবে তিনি আল হিলালে যোগ দিতে পারবেন।

‘নভেম্বর মাস ছিল তখন। ম্যানেচেস্টারে তখন বরফ পড়ছিলে,’ স্মৃতিচারণ করছিলেন ইমন, ‘আমি ভাবলাম প্রস্তাবটি খারাপ নয়।’

কিন্তু শুধু যে আবহাওয়ার কারণেই তিনি প্রস্তাবটি লুফে নিয়েছিলেন তা নয়, পয়সা ছিল প্রধান বিবেচনা। ইমন তখন বিবাহিত, দুটি সন্তান। ভেবেছিলেন সৌদি আরবে গেলে হয়তো বাড়ির মর্টগেজটা দ্রুত শোধ করতে পারবেন।

লন্ডনে গিয়ে কায়রো, জেদ্দা হয়ে রিয়াদের প্লেন ধরলেন ইমন। জেদ্দায় নেমেই বুঝলেন তিনি ভিন্ন ধরনের একটি দেশে এসেছেন। তার হাতে ছিল ইংলিশ ট্যাবলয়েড সানডে এক্সপ্রেস। একজন সৌদি ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা তার পত্রিকাটি নিয়ে কাঁচি দিয়ে প্রতি পাতায় মেয়েদের ছবির মুখগুলো কেটে ফেললেন।

এরপর থেকে ইমন পদে পদে টের পেয়েছেন যে তিনি ভিন্ন একটি সংস্কৃতির দেশে এসেছেন। রিয়াদে তাকে রিসিভ করতে বিমানবন্দরে রানওয়েতে অপেক্ষা করছিলেন জর্জ। বিশাল এক বুইক গাড়ির বনেটে বসে ছিলেন তিনি।

ম্যানচেস্টারে ফিস অ্যান্ড চিপস খাওয়াটাই যেখানে বড় ব্যাপার ছিল, সেখানে রিয়াদে এসে ইমন উঠলেন পাঁচ তারকা হোটেলে। খাবার-পানীয় সব ফ্রি। ২২ বছরের ইমন যেন রাতারাতি ভিন্ন এক জগতে এসে পড়লেন।

১৯৭৩ সালে বিশ্বের জ্বালানি তেলের সঙ্কটের কারণে সৌদি অর্থনীতি তখন ফুলে ফেঁপে উঠছিল। ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে সৌদি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হয়েছে তিন হাজার শতাংশ। ফলে ক্ষমতাবান মানুষদের পকেটে এসেছিল অবিশ্বাস্য পরিমাণ টাকা।

তেমনই এক ধনী ক্ষমতাবানের সাথে দেখা হলো ইমনের। রিয়াদের আল হিলালের ট্রেনিং গ্রাউন্ডে তার সাথে দেখা হলো প্রিন্স আবদুল্লাহ বিন নাসেরের।

ইমন তখনও ট্রায়ালে রয়েছেন। একটি প্রাকটিস ম্যাচ চলাকালে নীল রঙের এক বুইক গাড়িতে চড়ে মাঠে এলেন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট প্রিন্স আবদুল্লাহ।

‘জর্জ আমাকে বললেন ওই যে গাড়ি, ওই গাড়িতে আমাদের প্রেসিডেন্ট। তোমাকে ক্লাবে রাখা হবে কি হবে না, সেই সিদ্ধান্ত উনিই দেবেন। ভালো করে খেল।’

সে সময় রাইট উইং থেকে বলের পাস এলো। গোলের সামনেই ছিলেন ইমন। হেড করে বল জালে ঢুকিয়ে দিলেন। ‘গুলির মতো বলটি কোণা দিয়ে জালে ঢুকেছিল। সত্যিই গুলির মতো।’

পাঁচ মিনিট পর লেফট উইং থেকে আসা আরেকটি পাস থেকে আবারো গোল করলেন ইমন। ম্যাচের বিরতিতে কানের কাছে ফিসফিস করে জর্জ বললেন, টাকা নিয়ে তোমার মনে যা রয়েছে, তার শেষে একটি বাড়তি শূন্য বসিয়ে নিও।’

ম্যাচের পরপরই প্রিন্সের সাথে দেখা করতে গেলেন ইমন। তখনো গায়ে ঘামে ভেজা জার্সি, শর্টস। আবদুল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করলেন হোটেল ঠিক আছে কিনা। তিনি খুশি কিনা। ইমন উত্তর দিলেন সব ঠিক আছে। প্রিন্স তখন জর্জকে জিজ্ঞেস করলেন, ইমনের পারফরমেন্সে তিনি খুশি কিনা। জর্জ বললেন- হ্যাঁ।

‘তাহলে হোটেলে গিয়ে আপনার চাহিদা কি তা ঠিক করে ফেলেন,’ বললেন আবদুল্লাহ।

জর্জের সাথে বসে ইমন একটি তালিকা বানালেন : টাকা, গাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, ইংল্যান্ডে যাওয়ার ফ্লাইটের ভাড়া, বড় হওয়ার পর দুই ছেলের প্রাইভেট স্কুলের খরচ। পরের ট্রেনিংয়ের দিনে প্রিন্স এলে তালিকাটি তার হাতে তুলে দেন জর্জ। প্রিন্স দেখে বললেন, কোনো সমস্যা নেই।

দেশে ইমনের তখন আয় ছিল সপ্তাহে ৪০ পাউন্ড, সেই সাথে ফুটবল খেলে পেতেন ১৫ পাউন্ড। আল হিলালে তার সাপ্তাহিক আয় দাঁড়ালো ১৪০ পাউন্ড, যা এখনকার এক হাজার একশ পাউন্ডের সমান। কোনো কর নেই, বিল নেই, বাসা-ভাড়া নেই।

চুক্তি চূড়ান্ত করে ইমন ফিরে গেলেন ম্যানচেস্টারে। পরিবার নিয়ে ফিরলেন রিয়াদে। প্রথমে উঠলেন একটি হোটেলে। ‘অনেক বিল হতো, কিন্তু তা নিয়ে কখনই কোনো প্রশ্ন ওঠেনি।’

ইমনের স্ত্রী রিয়াদে ফার্স্ট ন্যাশনাল সিটি ব্যাংকে চাকরি নিলেন। সপ্তাহে দু’দিন প্রশিক্ষণের বাইরে ইমনের সময় কাটতো বাচ্চাদের নিয়ে আয়েশে। তাদের নিয়ে প্রতিদিনই সুইমিংপুলে কাটাতেন।

প্রথম দিন থেকেই আবদুল্লাহ ইমনকে পছন্দ করেছেন। তাকে একটি গাড়ি কিনে দিলেন প্রিন্স। একটি সিলভার রংয়ের পনটিয়াক ভেনচুরা। প্রায়ই ইমনকে চায়ের দাওয়াত দিতেন। একসাথে বড় স্ক্রিনের টিভিতে ফুটবল খেলা দেখতেন। নিজের পরিবার নিয়ে কথা বলতেন প্রিন্স।

অসম বন্ধুত্ব। কিন্তু সৌদি রাজ পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠতাকে ইমন উপভোগ করতেন। তিনি দেখলেন রাজপরিবারের হয়েও সৌদিরা খুবই সাদাসিধে মানসিকতার মানুষ।

ফুটবল মাঠেও সময় ভালোই যাচ্ছিলো। কিংস কাপের সেমিফাইনালে পৌঁছে যায় ক্লাব। মৌসুম শেষে ছুটি কাটাতে ইংল্যান্ডে গেলেন ইমন। যাওয়ার আগে আবদুল্লাহ ইমনের বাড়ির ফোন নম্বর চাইলেন। ‘আমিও ইংল্যান্ডে যাবো, দেখা হবে আমাদের।’

তিন সপ্তাহ পর, আবদুল্লাহ ইমনের মায়ের বাড়িতে ফোন করেন। ফোন তুলেছিলেন তার মা। ইমন ফোন ব্যাক করলেন। প্রিন্স ছিলেন লন্ডনে হ্যারডসের কাছে কার্লটন টাওয়ার হোটেলে। দুদিন পর তার সাথে দেখা করতে ইমন লন্ডনে গেলেন। ট্রেন স্টেশনে তার জন্য বিলাসবহুল গাড়ি অপেক্ষা করছিলো।

লন্ডনে সৌদি টাকা উড়তে দেখছিলেন ইমন। প্রিন্স সেসিল গি’র ছয়টি স্যুট কিনলেন। তার একজন সহকারীর জুতার প্রয়োজন হলে প্রিন্স ইমোনকে ২০০ পাউন্ড দিয়ে দোকানে পাঠালেন।

‘এ যেন অন্য এক জগত।’

আব্দুল্লাহ ইমনকে বললেন, তার ইউরোপ সফরে সে সঙ্গী হবে কি-না। প্রথমে প্যারিস, তারপর কান, রোম, কায়রো হয়ে রিয়াদে ফেরত। এই সফরে আবদুল্লার স্ত্রী কিছু আসবাব কিনতে চান, আর প্রিন্স চান ইউরোপের কাসিনোতে পয়সা ওড়াতে।

ইমন রাজী হলেন। এক সপ্তাহ পর লিমুজনে চড়ে গেলেন হিথরো বিমানবন্দরে, সৌদি রাজপুত্রের সাথে ইউরোপ সফরের জন্য। ততদিনে ইমনের সাথে আবদুল্লার অনেকটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিলো।

‘আমাদের বোঝাপড়া ছিল দারুণ। সবসময় হাসি ঠাট্টা হতো। অনেক মানুষ যে তার পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে, তা নিয়ে প্রিন্স বিরক্ত থাকতেন। প্যারিসের চার্লস দ্য গল বিমানবন্দরে প্রিন্সকে অভ্যর্থনা জানাতে এলেন সৌদি রাষ্ট্রদূত।’

বিমানবন্দরে যখন সৌদি রাষ্ট্রদূতের সাথে কথা বলছিলেন হাতের একটি ব্যাগ রাখতে দিয়েছিলেন ইমনকে। এক ঘণ্টা পর হোটেল রুমে ফোন করে ব্যাগটি চাইলেন তিনি। রাজপুত্রের হোটেল রুমে গেলে ব্যাগ খুলে তিনি ইমনকে দেখালেন ব্যাগের মধ্যে স্তরে স্তরে সাজানো ফরাসি মুদ্রা-ফ্রাঁ।

‘অথচ বিমানবন্দরে আমি কিন্তু কফি আনতে গিয়ে এই ব্যাগটি চেয়ারে রেখে গিয়েছিলাম। বোঝেন অবস্থা।’

সে রাতে প্যারিসের সেইন নদীতে নৌবিহার এবং সেই সাথে ডিনার সারলেন তারা। দুদিন পর রওয়ানা হলেন কানে। কানে পৌঁছে তারা দুজন একরাতে গেলেন ক্যাসিনোতে। ফেরার পথে হোটেলের লিফটে রাজপুত্র আবদুল্লার ওই প্রস্তাব, ইমন আমি তোমাকে ভালোবাসি।

ইমন বললেন, ওই কথা শোনার পর তার মনে হয়েছিল লিফটটি খুব যেন ছোটো, অপ্রশস্ত। ‘লিফটের দরজা খুলতে ১৫ সেকেন্ড লেগেছিল। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল যেন এক মাস। ভয়ঙ্কর এক শীতলতা এসে ভর করলো।’

ইমন তার মনোভাব বুঝিয়ে দিলেন, তিনি সমকামী নন, তিনি শুধু ফুটবল খেলতে চান। অন্য কিছু নয়। তারপর পুরো পরিবেশটাই যেন বদলে গেল। সফর সূচিও বদলে গেল। তিনদিনের বদলে রোমে তারা থাকলেন একদিন। তারপর কায়রোতে না থেমে সোজা রিয়াদে।

পরিবেশটা যেন বরফের মতো হয়ে গেল। ইমন বিব্রত হলেও ভীত হননি। আবদুল্লাহ তাকে বলেছিলেন, তাদের সম্পর্ক এখন শুধু ক্লাব প্রেসিডেন্ট এবং একজন খেলোয়াড়ের মতো হবে। ইমন তার কথা বিশ্বাস করেছিলেন।

‘এক মুহূর্তের জন্যও আমার মনে হয়নি আমি কোনো বিপদে পড়ে গেছি। আমি ভাবছিলাম আমার সাথে চুক্তি হয়েছে, সুতরাং সবকিছুই স্বাভাবিক থাকবে।’

কিন্তু রিয়াদে ফিরে পরিস্থিতি বদলে গেল। সমকামিতা সৌদি আরবে নিষিদ্ধ। কিন্তু রাজপরিবারের ক্ষমতা অপরিসীম। ফলে রিয়াদে ফিরে ইমন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন, যদি প্রিন্স চাপ সৃষ্টি করে।

তিনি জর্জকে সব কথা খুলে বললেন। জর্জের কাছ থেকে ভরসা চাইলেন, কিন্তু পেলেন না। ‘তুমি একটা গাধা। তুমি মনে করছো ওরা থেমে যাবে।’

জর্জ স্মিথের বয়স এখন ৮৪। এখনো ফুটবলের দিকে নজর রাখেন। তিনি কি এখনো ইমনকে মনে রেখেছেন। ‘অবশ্যই,’ রচডেল থেকে টেলিফোনে তিনি উত্তর দিলেন। ‘আমিই তো তাকে ফুটবলার বানিয়েছিলাম।’

আবদুল্লাহর সাথে ইমনের মাখামাখি নিয়ে তিনি কিছুটা অস্বস্তি-আতঙ্কে ছিলেন।

‘আমার মনে হতো তারা খুব বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ছে। আমার এই মনোভাবের কথা প্রেসিডেন্টও জানতেন।’

কানের ঘটনা শোনার পর জর্জ ইমনকে দ্রুত সৌদি আরব ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। ‘আমি বুঝতে পারছিলাম সে বিপদে পড়ে গেছে। যে কোনো কিছু ঘটতে পারে।’

কেমন সেটা?

‘সৃষ্টিকর্তা জানেন। কোনো দুর্ঘটনা বা অন্য কিছু। রাজপরিবারের ইচ্ছা অমান্য করা মহা অপরাধ।’

ভয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গেলেন ইমন। দেশের খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ক্ষমতাবান একজন ব্যক্তির গোপন কথা তিনি জেনে ফেলেছিলেন। জর্জের বাড়ির সোফায় সারারাত তার নির্ঘুম কাটলো। ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

কিন্তু একটি সমস্যা এসে হাজির হলো। সৌদি আরব ছাড়তে হলে তার নিয়োগকর্তার লিখিত অনুমতি লাগে। হঠাৎ ইমনের মনে হলো সে যেন সোনার খাঁচায় বন্দি হয়ে পড়েছে। পরদিন ইমন মিথ্যা বলার সিদ্ধান্ত নিল।

প্রিন্স আব্দুল্লাহকে গিয়ে সে বললো তার বাবা অসুস্থ। দ্রুত তাকে ইংল্যান্ড যেতে হবে। আব্দুল্লাহ শুনলেন, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত দিলেন না। বললেন, কাল কথা হবে।

পরদিন ফুটবল ক্লাবে আবদুল্লাহর সাথে দেখা করতে গেলেন ইমন। দরজা বন্ধ করে দিলেন প্রিন্স। কর্মচারীদের বললেন তাদের যেন বিরক্ত না করা হয়।

তারপর ইমনকে জিজ্ঞেস করলেন, ফ্রান্সে যা হয়েছিল তার জন্যই কি তুমি দেশে যেতে চাইছো? আমি বিশ্বাস করি না তুমি আর ফিরে আসবে।’

ইমন যখন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, আব্দুল্লাহ একটি কাগজ এবং কলম নিয়ে আরবিতে কিছু লিখলেন। একটি চুক্তিপত্র। ইমন দেশে যেতে পারবেন, কিন্তু মাত্র এক সপ্তাহের জন্য। শুধু তাকে এই চুক্তিতে সই করতে হবে।

ইমন আরবি পড়তে পারলেন না। ফলে তিনি সই করলেন না। তবে সাথে সাথে একটি বুদ্ধি তার মাথায় এলো।

‘আপনি আমাকে সই করতে বলছেন?’ ইমোন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আরবিতে লেখা এই চুক্তিপত্রে আমাকে বিশ্বাস করতে হবে। কিন্তু আপনি কি আমাকে বিশ্বাস করেন? ঠিক আছে তাতে সমস্যা নেই।’

ইমন কলম হাতে নিলেন এবং সই করতে উদ্যত হলেন। শেষ মুহূর্তে আব্দুল্লাহ কলম ছিনিয়ে নিলেন, কাগজটি ছিঁড়ে ফেললেন। তারপর বললেন, ‘আমি তোমার ফ্লাইটের ব্যবস্থা করছি।’ ধোঁকা কাজে দিয়েছিল।

পরদিন অল্প কিছু কাপড়-চোপড় নিয়ে ইমন বিমানবন্দরে গেলেন যাতে আব্দুল্লাহ সন্দেহে না করেন যে তিনি একেবারে চলে যাচ্ছেন।

তিনি কি তখনো ভয়ে ছিলেন?

‘অবশ্যই। কারণ হঠাৎ যদি আব্দুল্লাহ বলে বসেন তুমি যেতে পারবে না। বিমান আকাশে ওড়ার পরও আমি ভয় পাচ্ছিলাম।’ লন্ডনে বিমান নামার পর হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।

তবে ইংল্যান্ডে ক্যারিয়ার শুরুটা কঠিন ছিল। ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনে রেজিস্ট্রি করতে সৌদি আরবের ছাড়পত্রের প্রয়োজন ছিলো।

কিছু ছাড়পত্রের বদলে রিয়াদ থেকে তিনি একটি ফ্যাক্স পেলেন। ক্ষতিপূরণ দাবির একটি তালিকা :

– চুক্তি ভঙ্গের দায়ে নয় হাজার সৌদি রিয়াল (বর্তমানে আট হাজার পাউন্ডের সম-পরিমাণ)

– রিয়াদে তার অ্যাপার্টমেন্টের শীতাতপ যন্ত্র মেরামতের খরচ দেড় হাজার রিয়াল

– আব্দুল্লাহর কাছ থেকে ধার নেওয়া তিনশ পাউন্ড

– এক মাসের বেতন ফেরত

তালিকার এক এবং চার নম্বরটি মানতে রাজী ছিলেন ইমন। কিন্তু তিনি নিশ্চিত হলেন যে বাকি দাবিগুলো ছিল আবদুল্লাহর প্রতিশোধ। বললেন, শীতাতপ যন্ত্র একদম ঠিক ছিল এবং তিনি কখনই আবদুল্লাহর কাছ থেকে এক পয়সাও ধার করেননি।

ইমন এফএর সাথে কথা বললেন। এরপর ২২ নভেম্বর ১৯৭৬ এ তিনি লন্ডন থেকে একটি টেলিগ্রাম পেলেন। ‘জরুরী দরকার, প্লিজ রিং।’ নীচে সৌদি ফুটবলের নতুন প্রধান জিমি হিলের নাম।

১৯৭৬ সালে জিমি হিল ছিলেন ইংলিশ ফুটবলের অন্যতম বিখ্যাত ব্যক্তি। ১৯৭০ সাল থেকে তিনি বিবিসির প্রধান ফুটবল অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন। ইমন তাকে ফোন করলেন। ইমনের বাবা ট্রেড ইউনিয়ন করতেন। তিনি বললেন, কানে কী হয়েছিল তা তিনি ফিফা এবং পুরো বিশ্বকে বলবেন।

দুই সপ্তাহ পর একটি বৈঠকের আয়োজন করা হলো ইমন, জর্জের একজন বন্ধু এবং আল হিলাল ক্লাবের একজন প্রতিনিধির মধ্যে। বৈঠকে আল হিলালের প্রতিনিধি কিছুটা ব্যাঙ্গ করে ইমনকে বললেন, আপনি সৌদি আরবে থাকলে আপনার কি এমন হতো?

‘বিষয়টি যখন আপনার পরিবার নিয়ে, তখন তো ঝুঁকি নেওয়া যায় না,’ শক্ত জবাব দিলেন ইমন। অনেক তর্ক হয়েছিল ওই বৈঠকে। এক সপ্তাহ পর ইমনকে ছাড়পত্র দিলো সৌদি এফএ।

তবে ইংল্যান্ডে ফেরার পর আবারো অর্থকষ্ট শুরু হলো ইমনের। বেতনের টাকা পড়ে ছিল সৌদি ব্যাংক আ্যাকাউন্টে। তা তুলতে পারেননি। বাড়ি বেচতে হলো তাকে। ম্যানচেস্টার ইভনিং পত্রিকায় কাজ নিলেন। পরে সেমি-প্রফেশনাল ক্লাব মসলিতে খেলা শুরু করেন।

১৯৭৯ সালে ইমন ২৫ হাজার পাউন্ডে এভার্টন ক্লাবে যোগ দেন। ইংলিশ ফুটবলের শীর্ষ লীগে খেলার সুযোগ হয় তার। এভার্টনের হয়ে প্রথম ডিভিশনে তিনি ২৫টি ম্যাচ খেলেন। পরে উইগ্যান অ্যাথলেটিক্সে যোগ দেন।

এরপর আইরিশ রিপাবলিক জাতীয় দলের হয়েও পাঁচটি ম্যাচ খেলেন ইমন। সৌদি আরব থেকে চলে আসার পর ফুটবলার হিসেবে তার এই সাফল্যের জন্য আবদুল্লাহকে মনে মনে ক্ষমা করে দিয়েছেন ইমন।

‘কানের লিফটের মধ্যে ওই ঘটনা যদি না ঘটতো, তাহলে হয়তো আমি সৌদি আরবেই থেকে যেতাম। কখনই আমার এভার্টনের জন্য খেলা হতো না। আয়ারল্যান্ডের জন্য খেলা হতো না।’

প্রিন্স আব্দুল্লাহ ১৯৮১ পর্যন্ত আল হিলালের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ইমন চলে আসার পর তিনি আরো অনেক বিদেশি ফুটবলার কিনে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়ী দলের রিভেলিনো খেলেছেন আল হিলালে। ওই ক্লাব এখন এশিয়ার অন্যতম সেরা ক্লাব।

ইমনের এই গল্প নিয়ে সৌদি সরকারের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিকেশন বা আল হিলাল ফুটবল ক্লাব কেউই কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করে।

প্রিন্স আব্দুল্লাহ সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। কারণ তার মতো এমন শত শত রাজপুত্র সৌদি আরবে রয়েছেন। সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে সৌদের ৪৫ জন ছেলে ছিল। তাদের একজনের সন্তান ছিলেন আব্দুল্লাহ।

আল হিলাল ক্লাবের ওয়েবসাইট থেকে অবশ্য জানা যায় আব্দুল্লাহ বেঁচে নেই। মধ্যপ্রাচ্যের এক সাংবাদিক জানিয়েছেন, ২০০৭ সালে তিনি মারা যান। আরবি উইকিপিডিয়ায় তার সম্পর্কে চারশ শব্দের একটি বর্ণনা রয়েছে, আবদুল্লাহর তিনজন স্ত্রী এবং সাত সন্তান ছিল।

ইমন ও’কিফি আয়ারল্যান্ডের কর্ক সিটি ক্লাবের ম্যানেজারের দায়িত্ব শেষ করে ইংল্যান্ডের চেশায়ার কাউন্সিলে কাজ করেছেন। পরে পর্তুগালে কাটিয়েছেন কিছুদিন। এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছেন ম্যানচেস্টারে। ২০১৭ সালে তার ক্যান্সারের চিকিৎসা হয়। সেরে উঠছেন এখন।

সৌদি রাজপুত্রকে নিজে ভয়ঙ্কর সেই অভিজ্ঞতার কথা নিয়ে তিনি ৪০ বছর ধরে খুব একটা মুখ খোলেননি। কিন্তু এখন তিনি চান সৌদি ওই ক্লাবের সেই সময়কার সহকর্মীরা জানুক কেন তিনি হঠাৎ না বলে কয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

সোনালীনিউজ/এইচএন

Wordbridge School
Link copied!