• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
SonaliNews

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত নিউজ পোর্টাল

‘চোখের সামনে মাছগুলো ভেসে গেছে, আটকে রাখতে পারিনি’


জামাল উদ্দিন বাবলু, লক্ষ্মীপুর অক্টোবর ৩, ২০২৪, ০৬:২৬ পিএম
‘চোখের সামনে মাছগুলো ভেসে গেছে, আটকে রাখতে পারিনি’

লক্ষ্মীপুর: ‘চোখের সামনে সবগুলো মাছ বন্যার পানিতে ভেসে চলে গেছে। শুধু তাকিয়েই ছিলাম, কিছু করার ছিল না। দুই বছরের পুরোনো কিছু মাছ ছিল। স্রোতের সঙ্গে ঘেরের ছোট, মাঝারি ও বড় সব মাছ ভেসে গেল। এখন প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। পুকুরের পাশে সমতল জমিতেও প্রায় কোমর পরিমাণ পানি ছিল। চেষ্টা করেছি মাছ আটকানোর, কিন্তু পারিনি। আমার যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, সরকারি সুযোগ-সুবিধা না পেলে এ ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। চাষাবাদ করতে কখনো ঋণ নিতে হয়নি, তবে এবার নিতে হবে। এ বন্যায় আর্থিকভাবে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে আমার। ’ এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন মামুনুর রশিদ মামুন। তিনি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের পশ্চিম বটতলি গ্রাম নিবাসী এক মৎস চাষি।  গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা ও বন্যার পানিতে ভেসে গেছে তার মৎস ঘেরের ১৭ লাখ টাকার মাছ। এতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন এই উদ্যোক্তা।

মামুনুর রশিদ মামুন আরও জানান, পারিবারিকভাবেই তারা মৎস্য চাষের সঙ্গে জড়িত। তাদের উপার্জনের প্রধান উৎস হচ্ছে মাছ চাষ। পুঁজির সকল টাকা ১টি জলাশয় ও ৩টি পুকুরে মাছ চাষ করতে বিনিয়োগ করেছিলেন।  কিন্তু বন্যায় সেই ঘেরের সকল মাছ ভেসে চলে গেছে। তাদের ঘেরে রুই-কাতল, মৃগেল-তেলাপিয়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ছিল। 

মামুনুর রশিদের মতোই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন সদর উপজেলার লাহারকান্দি ইউনিয়নের আটিয়াতলি গ্রামের মৎস্য চাষি ইঞ্জিনিয়ার এটিএম হাসান মাহমুদ সোহাগ।  একসময় পেশায় শিক্ষক ছিলেন তিনি।  বছর তিনেক আগে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য শিক্ষগতা ছেড়ে ৫ একর জমিতে মাছের চাষ শুরু করেন সোহাগ।  এ ছাড়া আলাদা একটা পুকুরও আছে তার। পুকুরটিতে মাছের পোনা উৎপাদন করা হয়। পরে প্রজেক্টে এনে ফেলা হয়।  কিন্তু এবারের বন্যায় তার প্রায় ৩০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব বলে মনে করছেন তিনি।

 

জানতে চাইলে হাসান মাহমুদ সোহাগ সোনালীনিউজকে বলেন, বন্যায় প্রায় ৩০ লাখ টাকার মাছ ভেসে চলে গেছে। এরমধ্যে পাঁচ হাজার রুই, দুই হাজার মৃগেল ছিল। প্রত্যেকটি মাছ প্রায় এক কেজি ওজনের ছিল। আমি ছোট মাছ কখনো বিক্রি করিনি। সবসময় বড় মাছ বাজারজাত করি। রুই আর মৃগেলেই প্রায় ২৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া কাতল, পাংগাস, তেলাপিয়া, টেংরা, শিং ও কার্পজাতীয় মাছ ছিল। আমি মিশ্র মাছ চাষ করি। টানা বৃষ্টিতে প্রথমে প্রজেক্ট ডুবে মাছ চলে যায়। এরপরও কিছু মাছ ছিল। কিন্তু পরে বন্যাতে সবগুলো মাছ চলে গেছে। পানি দূষিত হওয়ায় যে কয়টি মাছ ছিল তাও মরে গেছে। ২ ধাপে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে তিনি এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন। এমতাবস্থায় সরকারের সহযোগিতা ছাড়া তার ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব। 

সোহাগ আরও বলেন, পুকুর চাষাবাদের উপযোগী করতে পানিতে ১৮ হাজার টাকার কীটনাশক ছিটিয়েছি। এরপর উঁকুনের ওষুধ দিয়ে পানি শোধন করতে হবে। প্রথমবার দিয়েছি। ১ সপ্তাহ পরে আবার উঁকুনের ওষুধ দিতে হবে। পুনরায় মাছ চাষ করতে আরও ১৫ দিন সময় লাগবে। মাছ চাষই আমার উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম। কৃষি ব্যাংকে ৩ লাখ টাকা ও যুব উন্নয়নে ২ লাখ টাকার ঋণ রয়েছে। এ ছাড়া খাদ্যের দোকানে বাকি আছে প্রায় ৬ লাখ টাকা। এ টাকা পরিশোধ নিয়েই আমি চিন্তায় আছি। সব টাকা প্রজেক্টে খরচ হয়েছে। মাছ ভেসে গিয়ে সব শেষ হয়ে গেছে। ঘুরে দাঁড়ানোর মতো কোনো সুযোগ দেখছি না। হতাশার মধ্য দিয়ে দিন যাচ্ছে, কি করবো তা বুঝে উঠতে পারছি না।

একই অবস্থা লাহারকান্দি ইউনিয়নের চাঁদখালী গ্রামের গাজী মোহাম্মাদ বেলাল ও তার ভাইয়ের।  দুই ভাই মিলে যৌথভাবে ১১ একর জমিতে পুকুর কেটে মিশ্র মাছ চাষ করেছিলেন তারা। এটিই তাদের প্রধান পেশা।  কিন্তু এবারের বন্যায় তাদের প্রায় ২০ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। তাদের কাছে পর্যাপ্ত জাল ছিল। জাল দিয়ে মাছ আটকানোর চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। অনেক বেশি পানি ও স্রোতের কারণে সব মাছ চলে গেছে। 

গাজী মোহাম্মদ বেলাল সোনালীনিউজকে বলেন, বন্যায় আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে আমরা শঙ্কিত। সরকারিভাবে আমাদের কোনো সহযোগিতা করলে ঘুরে দাঁড়াতে আমাদের সহজ হবে। রুই, কাতল, মৃগেল ও কার্পজাতীয় প্রায় ৩০ লাখ টাকার মাছ ছিল। অনুমান করছি এখন কিছু মাছ আছে। আগে খাবার দিলে যে পরিমাণ মাছ লাফালাফি করতো। এখন তেমনটা দেখা যায় না। ভেসে যাওয়া মাছের মধ্যে ২ কেজি ওজনের তেলাপিয়া, দেড় থেকে ২ কেজি ওজনের পাঙ্গাস-রুই ছিল। পুকুরের বাইরেও প্রায় তিন-চার ফুট উচ্চতার পানি ছিল। প্রায় ১ মাস ধরে পানিতে ডুবেছিল খামার।

[

তিনি আরও বলেন, আমরা ফাল্গুনে মাছ ছেড়েছি। ভাদ্র মাসে বন্যা হয়। মাছের খাবারেই প্রায় ২০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। মাছ যখন বড় হয়েছে, বিক্রির উপযোগী হয়েছে, তখনই বন্যায় সব চলে গেছে। এতে আমরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। যদি বন্যা মাছ ফেলার শুরুতে হতো। তাহলে খাবারে কম খরচ হতো, মাছও ছোট ছিল। এতে ক্ষতিও কম হতো। সরকারিভাবে একটি তালিকা নিয়েছে। কোনো সহযোগিতা পেলে আমরা উপকৃত হবো। 

লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা ও বন্যার পানিতে চাষকৃত ১৮ হাজার খামারির ৪০ হাজার ১২৫টি মাছের পুকুর-জলাশয়ের মাছ ভেসে গেছে। এতে প্রায় ২৪০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে জেলার মৎস্য চাষিদের।

এবিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন সোনালীনিউজকে বলেন, বন্যায় প্রায় ১৮ হাজার খামারির ৪০ হাজার ১২৫টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এতে মাছ চাষিদের প্রায় ২৪০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত চাষীদের তালিকা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ২০ লাখ টাকার পোনা মাছের বরাদ্দ পেয়েছি। সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের মাঝে বিতরণ করা হবে।

 

প্রসঙ্গত, গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পানিবন্দি হয়ে আছে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ, চরশাহী, দিঘলী, মান্দারী, দত্তপাড়া, বাঙ্গাখাঁ, চন্দ্রগঞ্জসহ জেলার বিভিন্ন এলাকা। প্রথম দিকের বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে পানিতে ডুবে যায় পুকুর-জলাশয় ক্ষেত-খামার, গ্রামীণ রাস্তাসহ মানুষের বসতঘর। এরমধ্যে নোয়াখালী থেকে বন্যার পানি ঢুকে পড়ে লক্ষ্মীপুরে। এতে পানির উচ্চতা দ্বিগুণ আকার ধারণ করে। পুনরায় ডুবে যায় পুকুর-জলাশয়, রাস্তা-ঘাট, বসতঘর ও ফসলি জমিগুলো। এখনো বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে রয়েছে। কোথাও কোথাও দুই মাস ধরেই পানিতে তলিয়ে আছে বিস্তীর্ণ জনপদ।

এসএস

Wordbridge School
Link copied!