• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর, ২০২৫, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
SonaliNews

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত নিউজ পোর্টাল

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস

শিক্ষকতায় দ্যুতি ছড়ানো গয়ানাথ সরকার এখন রাজমিস্ত্রীর জোগালি!


পাবনা প্রতিনিধি আগস্ট ১১, ২০২৫, ১০:৩৫ পিএম
শিক্ষকতায় দ্যুতি ছড়ানো গয়ানাথ সরকার এখন রাজমিস্ত্রীর জোগালি!

পাবনা: শিক্ষকতা করে কাটিয়েছেন জীবনের মধুময় সময়ের ৪৮টি বছর। অনেকেই তার কাছে প্রাইভেট পড়ে পৌঁছেছেন উচ্চতার শিখরে। 

মাস শেষে অনেক শিক্ষার্থী টাকা দিয়েছেন আবার কেউবা দিতে পারেনি। কিছুই বলেননি তিনি। রোজ ভোরে ভাঙাচোরা একটি সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়তেন, ফিরতেন গভীর রাতে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। সেই শিক্ষক এখন রাজমিস্ত্রি’র জোগালি’র কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। আশ্চর্যজনক হলেও এটাই সত্যি।

বলছি, পাবনার চাটমোহর উপজেলার বিলচলন ইউনিয়নের কুমারগাড়া গ্রামের প্রবীণ শিক্ষক গয়ানাথ সরকার এর কথা। একসময় যার হাতে ও পকেটে কলম থাকতো, সেই হাতে মানুষটি এখন রাজমিস্ত্রির সহকারী (জোগালি) হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। 

স্ত্রী ও তিন সন্তানের ভরণপোষণ এবং পড়ালেখার খরচ জোগাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। জীবনের এই করুণ বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে কোনোদিন তা হয়তো কখনো স্বপ্নেও ভাবেননি গয়নাথ সরকার।

গত শনিবার (০৯ আগস্ট) সকালে চাটমোহর পৌর শহরের সাহাপাড়া মহল্লায় একটি বাড়িতে কাজ করার সময় কথা হয় এই শিক্ষকের সাথে। 

তিনি জানান, ১৯৮৪ সালে এসএসসি পাশ করেন গয়ানাথ সরকার। কিন্তু পরিবারের দারিদ্রতার কারণে পড়ালেখা আর এগুতে পারেননি। শুরু করেন প্রাইভেট পড়ানো। পাশাপাশি দিনমজুরির কাজ করে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। ছোট বেলা থেকেই ইংরেজি ও অংকে পারদর্শী গয়ানাথ পরবর্তীতে শিক্ষকতা পেশায় মনোনিবেশ করেন।

দিনরাত ব্যাচ আকারে প্রাইভেট পড়াতে থাকেন গয়ানাথ সরকার। অল্প সময়ের মধ্যেই অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে তার শিক্ষকতার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। বাড়ি বাড়ি পড়ানো শুরু করেন। এরপার পৌর শহরের মধ্যে একটি কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে চাকরি পেয়ে যান। 

অল্প বেতন হলেও শুধুমাত্র সম্মানের আশায় এই পেশাকে আঁকড়ে ধরে থাকেন দিনের পর দিন। কিছুটা স্বচ্ছলতা এলে বিয়ে করেন গয়ানাথ সরকার। এরপর একে একে তিন সন্তানের জন্ম দেন এই স্কুল শিক্ষক।

দারিদ্রতার কারনে নিজের পড়ালেখা হয়নি বলে তিন সন্তানকে মানুষ করার ব্রত নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে থাকেন এই মানুষটি। বড় ছেলে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে, দ্বিতীয় ছেলে দশম শ্রেণিতে এবং একমাত্র মেয়ে ৭ম শ্রেণিতে পড়ে। 

প্রাইভেট পড়িয়ে এবং বে-সরকারি ওই কেজি স্কুলে চাকরি করে যে টাকা আয় করতেন তাতে করে ভালোই চলছিল গয়ানাথ সরকারের। বছরখানেক আগে বেতন বাড়াতে বলায় স্কুল থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে চাকরি ছেড়ে দেন তিনি।

এরপর প্রাইভেট পড়ানোতেই সীমাবদ্ধ থাকেন। কিন্তু এবার গয়ানাথের ভাগ্যে নেমে আসে অন্ধকার। পৌর শহরের বিভিন্ন স্কুলের যেসব ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাইভেট পড়াতেন গয়ানাথ সরকার, সেইসব স্কুল থেকে অভিভাবকদের বলা হয়, ‘স্কুলের শিক্ষকদের কাছে না পড়ালে নম্বর কম পেলে এই জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।’ এরপর থেকেই একে একে কমতে তাকে গয়ানাথের শিক্ষার্থীর সংখ্যা। 

একটা সময় পুরোপুরি বেকার হয়ে পড়েন প্রবীণ এই শিক্ষক। জেঁকে বসে দারিদ্রতা। একদিকে সংসার চালানো, অন্যদিকে সন্তানদের পড়ালেখার খরচ জোগাতে গিয়ে হিমশিম খাওয়া গয়ানাথ বেছে নেন রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ। দিনশেষে হাজিরা পান ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকার মতো।

গয়ানাথের মেধা ও কলমের ছোঁয়ায় কেউ হয়েছেন ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার আবার কেউ বা হয়েছেন সমাজের প্রতিষ্ঠিত মানুষ। কিন্তু কেউ খোঁজ রাখেন না তাদের প্রিয় স্যারের! যে মানুষটি একসময় মেধা ও কলমের ছোঁয়ায় ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনের ভিত গড়ে দিতেন সেই মানুষটি এখন মানুষের বসবাসের ভিত গড়ার কাজ করে কোনো মতে জীবিকা নির্বাহ করছেন। লজ্জা পেলেও জীবনের প্রয়োজনে চাটমোহরের এই প্রবীণ শিক্ষক এখন হয়েছেন রাজমিস্ত্রির জোগালি।

ইব্রাহিম হোসেন মোল্লা নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই অংকে দূর্বল ছিল। অনেক দূর থেকে প্রতিদিন গয়ানাথ স্যারের কাছে নিয়ে আসতাম। এখন আমার ছেলে কলেজে পড়ে। শুধু তাই নয়, অংকটাও এখন ভালো পারে। কিন্তু অবাক হচ্ছি দ্যুতি ছড়ানো একজন শিক্ষককে রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করতে দেখে!’

কান্নাজড়িত কন্ঠে এই গয়ানাথ সরকার বলেন, ‘শিক্ষাকালীন অবস্থাতেই আমি প্রাইভেট পড়ানো শুরু করি। দীর্ঘসময় ধরে শিক্ষকতা করে এসেছি। কিন্তু হঠাৎ করেই শিক্ষকতা পেশা থেকে ছিটকে যাব ভাবতে পারিনি। চেয়েছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সম্মানের সাথে বাঁচতে। কিন্তু আজ আমি নিরুপায় হয়ে রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করছি। এতে আমার খুব কষ্ট হলেও এটাই আমার নিয়তি বলে মেনে নিয়েছি।’

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুসা নাসের চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি আমি অবগত হয়েছি। আমি তার বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নেবো। তার সাথে কথা বলে তার প্রত্যাশা কি জেনে আমরা উপজেলা প্রশাসন তার পাশে কিভাবে দাঁড়ানো যায় সেই চেষ্টা করবো।’

এআর

Wordbridge School
Link copied!