• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সুদিন ফিরছে শীতলপাটি তৈরির কারিগরদের


ঝালকাঠি প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪, ০৭:০৯ পিএম
সুদিন ফিরছে শীতলপাটি তৈরির কারিগরদের

ছবি প্রতিনিধি

ঝালকাঠি: বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ঝালকাঠির শীতলপাটি। নলছিটি উপজেলার পাটি শিল্পীদের সুদিন ফিরতে শুরু করেছে। অনেক কারিগর পেয়েছেন সরকারি প্রশিক্ষণ। তাই পুনরায় তারা কাজে ফিরতে শুরু করেছেন মুখ ফিরিয়ে নেয়া পাটি শিল্প তৈরির কারিগররা।

বর্তমানে শীতলপাটি তৈরির পাশাপাশি নতুন নতুন উপকরণ তৈরি করে নিজেদের আয় বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন কারিগররা। উপজেলায় এই পেশার সাথে প্রায় এক হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত আছেন। এটা শুধু তাদের পেশা না তারা একটি ঐতিহ্যবাহী পণ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে যুক্ত আছেন। দেরিতে হলেও সরকারি প্রশিক্ষণ পেয়ে আবারও স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন পাটি শিল্পীরা। শীতলপাটি ঝালকাঠির ব্র্যান্ডিং পণ্যের তালিকাভুক্ত একটি পণ্য সারাদেশের মানুষের কাছে পছন্দনীয় ঐতিহ্যবাহী। শীতলপাটির একসময় রমরমা অবস্থা থাকলেও উচ্চ শ্রমমূল্য, প্লাস্টিক পণ্যের সহজলভ্যতার কারণে বিক্রি কমতে থাকায় বাধ্য হয়ে এই পেশার সাথে জড়িত লোকজন অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন।

ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার মোল্লারহাট ইউনিয়নের কামদেবপুর ও গোপালপুর গ্রামে অবস্থিত পাটিকর পাড়ায় একটা সময় দুই হাজারেরও অধিক মানুষ এই পেশায় জড়িত ছিল। তাদের হাতে তৈরি পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী শীতলপাটি দেশের গণ্ডি পেড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হতো। তবে কালের পরিক্রমায় আধুনিক পণ্যের ভিড়ে শীতলপাটির চাহিদা কমে যাওয়ায় ধীরে ধীরে শতশত বছরের পুরোনো পেশা অনেকেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

আকার ভেদে একটি পাটি বুনতে একজনের ৫-৬ দিন লাগে। মজুরি পান ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। এক একটি পাটি বিক্রি হয় ২ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এদিকে এই উৎপাদিত পাটি ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হচ্ছে।

প্রবীণ পাটি কারিগর বিবেকানন্দ বলেন, আনুমানিক পাঁচশত বছর আগে বা তার বেশি সময় থেকে এই এলাকার লোকজন এই পেশার সাথে জড়িত। বর্তমানে ২শত পরিবার ও তাদের সদস্যরা এই পেশার সাথে জড়িত আছেন। যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি নারী পাটিকর রয়েছেন। আগে আরও বেশি ছিল তবে নানা রকম সমস্যার কারণে অনেক পরিবার এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা শীতলপাটি তৈরি উপাদান পাইত্রা গাছ জমি থেকে কেটে সেটা প্রসেস করেন। তারপর মহিলা সদস্যরা তা দিয়ে শীতলপাটি তৈরি (বুনন) করেন।

তিনি আরও বলেন, সরকার যদি আমাদের বিনা সুদে ঋণ দিতো তাহলে আমাদের জন্য খুব ভালো হতো। কারণ শীতলপাটি তৈরির যে উপকরণ পাইত্রা গাছ সেটা প্রক্রিয়াজাত করার জন্য বড় বড় ড্রামের দরকার হয় এবং কাটার জন্য ধারালো ও ভারী বটি তৈরি করতে হয়। এছাড়া আমাদের জমিতে পাইত্রা গাছ লাগানো থাকে সেখানে তো অন্য কোনো কৃষি ফসল লাগাতে পারি না। সেটা পুষিয়ে নিতে বিনাসুদে আমরা ঋণ পেলে আমাদের উপকার হতো এবং পুরোনো ঐতিহ্যবাহী পণ্য শীতলপাটি সগর্বে টিকে থাকতো।

পাটিকর মালতী রানি বলেন, বংশপরস্পরায় এই পেশার সাথে জড়িত আছি। বিয়ের আগে বাবার বাড়িতে বসে আর এখন বিয়ের পরে স্বামীর বাড়িতে বসে পাটি তৈরি করি। আমার শ্বাশুড়ির বয়স ষাট বছরের বেশি তারপরও তিনি এখনো শীতলপাটি বুনন করতে পারেন। বর্তমানে আমাদের সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। কারণ শীতলপাটির সেই আগের মতো আর চাহিদা নেই। আমাদের সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তাই আমরা শীতলপাটি তৈরির পাশাপাশি টিস্যু বক্স, কলমদানি, লেডিস ব্যাগ ইত্যাদি তৈরি করি। এর মাধ্যমে আমাদের বাড়তি আয় হচ্ছে। এছাড়া প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শীতলপাটি তৈরি নতুন কিছু ডিজাইন শেখানো হয়েছে যেগুলো তৈরি করতে পারলে আমাদের পাটির চাহিদা বাড়বে। তাই এখন আমরা আর্থিক সচ্ছল হওয়ার চেষ্টা করছি। সবমিলিয়ে যদি আমাদের বিক্রি ভালো হয় তাহলে আবারও পূনর আমাদের সুদিন ফিরে আসবে।

ব্যবসায়ী সন্দিপ চন্দ্র বলেন, এখানের পাটিশিল্পিদের তৈরি বিভিন্ন ধরনের শীতলপাটি সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে আমি বিক্রি করি। যার মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন বড় বড় শপিং মলও রয়েছে। তারা সেগুলো দেশের বাহিরেও বিক্রি করে থাকেন। প্রতিমাসে এখানে গড়ে প্রায় ১৫-২০ লাখ টাকার শীতলপাটি তৈরি হয়। এখন তারা শীতলপাটি তৈরির পাশাপাশি অন্যান্য কিছু উপকরণ তৈরি করছেন সেগুলোর বেশ চাহিদা আছে এবং বিক্রিও ভালো হচ্ছে। সরকার আরও একটু সুনজর দিলে শীতলপাটি তার হারানো গৌরব সম্পূর্ণরূপে ফিরে পাবে এবং পাটিশিল্পিরাও তাদের পেশাকে আরও ভালোভাবে আঁকড়ে ধরবেন। প্রচারের মাধ্যমে যদি বিদেশে বিক্রি বাড়ানো যায় তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে শীতলপাটির ভালো ভূমিকা থাকবে।

এসএমই ফাউন্ডেশন এর উপব্যবস্থাপক অসীম কুমার হালদার বলেন, এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পণ্যের বহুমুখী করণের জন্য এখানকার পাটিকরদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। যাতে তারা এই পণ্যগুলো বিদেশেও রপ্তানি করতে পারে। ব্রান্ডিং পন্য হিসেবে শীতলপাটির বিষয়ে জেলা প্রশাসন সচেতন রয়েছে।

নলছিটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, সরকার সকল ঐতিহ্যবাহী পণ্যের প্রচার ও প্রসারে কাজ করে যাচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় নলছিটি উপজেলার ৬০জন পাটি শিল্পীকে এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে পাটি শিল্পের মানোন্নয়নে করণীয় শীর্ষক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তাদের যে কোন প্রয়োজনে উপজেলা প্রশাসন পাশে আছে।

ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক ফারাহ্ গুল নিঝুম বলেন, ঝালকাঠির শীতল পাটি একটি ‘ব্র্যান্ড পণ্য’। পাটি প্রসারে পাটিকরদের প্রশিক্ষণসহ নানা রকম সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। পাটি শিল্প থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন রকমের জিনিসপত্র বিদেশে রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। আর এটি করা গেলে এখানকার পাটিকরদের ভাগ্যের চাকা ঘুরবে। সরকার পাটিকরদের উন্নয়নে কাজ করবে বলে প্রত্যাশা সবার। ঝালকাঠির ‘ব্র্যান্ড পণ্য’ শীতল পাটিকে তুলে ধরতে সরকারিভাবেই বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

ওয়াইএ

Wordbridge School
Link copied!