• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

৫৫ বছরের ছোট্ট জীবনের ১৩ বছরই কেটেছে জেলে


সোনালীনিউজ ডেস্ক মার্চ ১৮, ২০২১, ০৯:৩৩ এএম
৫৫ বছরের ছোট্ট জীবনের ১৩ বছরই কেটেছে জেলে

ঢাকা: জাতির পিতা এবং বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের রূপকার প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। অনেক ব্যথা-বেদনা, জেল-জুলুম, অশ্রু ও রক্তের আখরে লেখা তার ইতিহাস। ৫৫ বছরের ছোট্ট জীবনের ১৩ বছরই কেটেছে জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। বার বার নিপীড়ন সত্ত্বেও জেল থেকে বেরিয়েই গেয়েছেন বাঙালির মুক্তির গান।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। টুঙ্গিপাড়ার বনেদি শেখ পরিবারের শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের কোল আলোকিত করেছিলেন। কে জানতো এই ‘খোকাই’ আলোকিত করবে বিশ্ব, তারুণ্যের দ্বীপশিখা জ্বালিয়ে হবে স্বাধীন জাতি রাষ্ট্রের জনক! হ্যাঁ, শিশু বয়স থেকেই খোকার মাঝে সেটি ফুটে উঠেছিল খুব সুন্দরভাবেই।

চতুর্থ শ্রেণির পাঠ চুকিয়ে জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। স্বদেশি আন্দোলনের সভায় যোগদান করতেন। তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘তখন স্বদেশি আন্দোলনের যুগ। স্বদেশি আন্দোলন গোপালগঞ্জ-মাদারীপুরের ঘরে ঘরে। আমার মনে হতো মাদারীপুরে সুভাষ বোসের দলই শক্তিশালী ছিল। পনের-ষোল বছরের ছেলেদের স্বদেশিরা দলে ভেড়াত। আমাকে রোজ সভায় বসে থাকতে দেখে আমার উপর কিছু যুবকের নজর পড়লো। ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হলো। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম। এই সভায় যোগদান করতে মাঝে মাঝে গোপালগঞ্জ-মাদারীপুর যাওয়া আসা করতাম। আর স্বদেশি আন্দোলনের লোকদের সঙ্গেই মেলামেশা করতাম।’

শুধু রাজনীতিই নয়, ছোটবেলা থেকেই ছাত্র ও জনসেবায় শেখ মুজিব ছিলেন অগ্রগামী। তার গৃহশিক্ষকের হাত ধরে তিনি এতে সম্পৃক্ত হন। তার ভাষায়, ‘মাস্টার সাহেব গোপালগঞ্জে একটা ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন, যার দ্বারা গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। মুষ্টির ভিক্ষার চাল উঠাতেন সকল মুসলমান বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রবিবার আমরা থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাউল উঠিয়ে আনতাম এবং এই চাল বিক্রি করে তিনি গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার ও অন্যান্য খরচ দিতেন। ঘুরে ঘুরে জায়গিরও ঠিক করে দিতেন। আমাকেই অনেক কাজ করতে হতো তার সঙ্গে। হাঠাৎ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। তখন আমি এই সেবা সমিতির ভার নেই এবং অনেক দিন পরিচালনা করি।’

সমাজসেবার এই কাজে বেশ অ্যাগ্রেসিভ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কেউ চাল না দিলে তাদের উপর জোর চালাতেন। তিনি লিখেন, ‘যদি কোনো মুসলমান চাউল না দিত, আমার দলবল নিয়ে তার উপর জোর করতাম। দরকার হলে তার বাড়িতে রাতে ইট মারা হতো। এজন্য আমার আব্বার কাছে অনেক শাস্তি পেতে হতো। আমার আব্বা আমাকে বাধা দিতেন না।’

হ্যাঁ এই বন্ধুবৎসল ও জনদরদী মনোভাবই কাল হলো শেখ মুজিবের। ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জ হিন্দু মহাসভার সভাপতি সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে সহপাঠী বন্ধু আবদুল মালেককে মারপিট করা হলে শেখ মুজিবুর রহমান সেই বাড়িতে গিয়ে ধাওয়া করেন। সেখানে হাতাহাতির ঘটনা ঘটলে হিন্দু মহাসভার নেতাদের করা মামলায় শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। যদিও সাত দিন জেলে থাকার পর মীমাংসার মাধ্যমে মামলা তুলে নেয়া হলে শেখ মুজিব মুক্তি পান।

সেই থেকে শুরু হয় তার জেলজীবন। তাতে কি থেমে যাবেন? না আরও দুই-তিনগুণ তেজে সত্যের পক্ষে জ্বলে ওঠেন। আর মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। এর মধ্যে ৪ হাজার ৬৭৫ দিন কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে। শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবনের প্রায় ১৩ বছর কারাগারে ছিলেন।

বিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সাত দিন কারাভোগ ছাড়াও ১৯৪১ সালে অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগের ফরিদপুর জেলা শাখার সহ-সভাপতি থাকা অবস্থায় বক্তব্য প্রদান এবং গোলযোগের সময় সভাস্থলে অবস্থান করায় শেখ মুজিবুর রহমানকে দুইবার সাময়িকভাবে গ্রেফতার করা হয়।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শেখ মুজিব ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত পাঁচদিন কারাগারে ছিলেন। একই বছর ১১ সেপ্টেম্বর আটক হয়ে মুক্তি পান ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি। এ দফায় তিনি ১৩২ দিন কারাভোগ করেন। এরপর ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল আবারও তাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় ও ২৮ জুন মুক্তি পান। একই বছরের ২৫ অক্টোবর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৩ দিন এবং ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি টানা ৭৮৭ দিন কারাগারে ছিলেন।

১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করার পরও শেখ মুজিবকে ২০৬ দিন কারাভোগ করতে হয়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির পর ১১ অক্টোবর শেখ মুজিব আবার গ্রেফতার হন। এ সময়ে টানা ১ হাজার ১৫৩ দিন তাকে কারাগারে কাটাতে হয়। এরপর ১৯৬২ সালের ৬ জানুয়ারি আবারও গ্রেফতার হয়ে মুক্তি পান ওই বছরের ১৮ জুন। এ দফায় তিনি কারাভোগ করেন ১৫৮ দিন। এরপর ১৯৬৪ ও ১৯৬৫ সালে বিভিন্ন মেয়াদে তিনি ৬৬৫ দিন কারাগারে ছিলেন। ছয় দফা প্রস্তাব দেয়ার পর তিনি যেখানে সমাবেশ করতে গেছেন, সেখানেই গ্রেফতার হয়েছেন। ওই সময়ে তিনি ৩২টি জনসভা করে বিভিন্ন মেয়াদে ৯০ দিন কারাভোগ করেন। এরপর ১৯৬৬ সালের ৮ মে আবারও গ্রেফতার হয়ে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তি পান। এ সময় তিনি ১ হাজার ২১ দিন কারাগারে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পরপরই পাকিস্তান সরকার তাকে গ্রেফতার করে। এ দফায় তিনি কারাগারে ছিলেন ২৮৮ দিন।

এভাবেই বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে নিবেদিত করেন। তার এই নিবেদন তাকে বসিয়ে দেয় ‘বঙ্গবন্ধু’র আসনে। নেতৃত্ব দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র। হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির জনক।

বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন নিয়ে লেখা স্মৃতি নিয়েই প্রকাশ হয় ৩৩২ পৃষ্ঠার এক বই। নিজে সেটির নাম দেন ‘থালা বাটি কম্বল, জেলখানার সম্বল।’ ছোট মেয়ে শেখ রেহানা এটির নাম দিয়েছেন ‘কারাগারের রোজনামচা’। এর ভূমিকা লিখেছেন বড় মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সেখানে উল্লেখ করেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ও স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঙালি মর্যাদা পেয়েছে যে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, সেই সংগ্রামে অনেক ব্যথা-বেদনা, অশ্রু ও রক্তের ইতিহাস রয়েছে। মহান ত্যাগের মধ্য দিয়ে মহৎ অর্জন করে দিয়ে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’

বঙ্গবন্ধু নিজের কারাস্মৃতি এভাবেই ‘কারাগারের রোজনামচা’য় তুলে ধরেন, ‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বৎসরের ছেলেটা এসে বলে আব্বা বালি চলো। কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম, ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ও কী বুঝতে চায়! কী করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’

আদরে সন্তান পরিবার-পরিজনের আবেগ-মায়া-মমতার চেয়ে দেশ, মাটি ও মাতৃকার জন্য বঙ্গবন্ধু নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তার ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতার বিষয়ে কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো ১৯৭৩ সালের জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনে বলেন- ‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে আমি মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো।’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউজউইক পত্রিকা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘রাজনীতির কবি’ বলে আখ্যায়িত করে লেখেন, ‘তিনি লাখ লাখ মানুষকে আকর্ষণ করতে পারেন, সমাবেশে এবং আবেগময় বাগ্মিতায় তরঙ্গের পর তরঙ্গে তাদের সম্মোহিত করে রাখতে পারেন। তিনি রাজনীতির কবি।’

ব্যক্তিগত জীবনে বিশ্বশান্তি পরিষদ থেকে জুলিও ক্যুরি শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৩ সালের ২৩ মে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় শান্তি ও নিরাপত্তা সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন বিশ্বশান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র তার হাতে এই পুরস্কার তুলে দেন। এটি বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক পদক।

২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০২০ সালের ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থার (ইউনেস্কো) নির্বাহী পরিষদের ২১০তম অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে দ্বিবার্ষিক ‘ইউনেস্কো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ইন দ্য ফিল্ড অব ক্রিয়েটিভ ইকোনমি’ (সৃজনশীল অর্থনীতি খাতে ইউনেস্কো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক পুরস্কার) প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০২১ সালের নভেম্বরে ইউনেস্কোর ৪১তম সাধারণ অধিবেশনকাল থেকে পুরস্কারটি প্রদান করা হবে।

সোনালীনিউজ/এইচএন

Wordbridge School
Link copied!