ঢাকা : অতিক্ষুদ্র কিন্তু অতিশয় শক্তিধর দুটি প্রাণী উইপোকা ও ঘুণপোকা। দৈহিক গড়নে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বড় বড় প্রাণীর ভিড়ে এরা একেবারেই নগণ্য। আকৃতিতে এরা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হলেও শক্তিতে কম যায় না। বিশেষত এদের দাঁত এতটাই ক্ষুরধার যে, যেকোনো কঠিন বস্তুকে এরা ধীরে ধীরে ফোকলা করে দিতে পারে। উইপোকার বাস মাটির নিচে হলেও এরা উড়তেও জানে। গ্রামাঞ্চলে এদের আবাসস্থল দেখা যায়। বাঁশের ঝোপঝাড় বা বসতবাড়ির আশপাশে এদের ঢিবির দেখা মেলে। এদের আক্রমণে ঘরবাড়ি আসবাবপত্র বিনষ্ট হয়। অন্যদিকে ঘুণপোকার আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু কাঠের আসবাব কিংবা কাঠ দিয়ে তৈরি ঘর। একবার যদি কাঠের আসবাবে ঘুণপোকা বাসা বাঁধে, তাহলে আর রক্ষে নেই। ভেতর থেকে কুরে কুরে খেয়ে ফোকলা করে দেয় সে আসবাব বা কাঠের অবকাঠামোকে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, বেশির ভাগ সময়ই বাইরে থেকে বোঝার উপায় থাকে না ঘুণপোকা কী সর্বনাশ করে দিয়েছে। নাড়া দিলেই ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে তা। আজকাল অবশ্য উইপোকা দমনের নানা ধরনের কীটনাশক বের হয়েছে। ওই সব প্রতিষেধক ব্যবহার করে মানুষ এই ক্ষুদ্র প্রাণীটির ধ্বংসাত্মক আক্রমণ থেকে সম্পদকে অক্ষত রাখার চেষ্টা করে।
আমরা যদি একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে আমাদের সমাজ এবং রাজনীতিতেও উইপোকা-ঘুণপোকার উপস্থিতি দেখতে পাব। শুধু দেখা নয়, অনুভব করতে পারব এদের ক্ষতিকারক তৎপরতাও। তবে এসব উইপোকা ও ঘুণপোকা ক্ষুদ্র কোনো প্রাণী নয়। এরা খালি চোখেই দৃশ্যমান এবং বাস করে আমাদের মাঝেই। এরা আকৃতিতে অবশ্যই মানুষের মতো, প্রকৃতিতে এরা উইপোকা ও ঘুণপোকাসদৃশ। এদের তৎপরতায় সমাজ ও রাজনীতিতে সৃষ্টি হয়েছে অবক্ষয়। এরা সমাজ এবং রাজনীতির ভেতরে অবস্থান করে তীক্ষ দাঁত দিয়ে প্রতিনিয়ত ফোকলা করে দিচ্ছে সভ্যতার অন্যতম এ দুটি অনুষঙ্গকে। উইপোকা সাধারণত কোথাও থেকে উড়ে এসে বসতভিটার নিচে অবস্থান নিয়ে তার ক্ষতিকর তৎপরতা শুরু করে। আর ঘুণপোকা একটি ছোট্ট ছিদ্র করে কাঠের ভেতরে প্রবেশ করে ভেতর থেকে কাঠকে অন্তঃসারশূন্য করে দেয়। তেমনি সমাজের উইপোকারাও সমাজ ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে থেকেই তাদের সর্বনাশা তৎপরতা চালায়।
সমাজে এ শ্রেণির মানুষ চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ, দুষ্কৃতকারী, কালোবাজারি, ঘুষখোর, লম্পট, লুটেরা হিসেবে। ভদ্রতার মুখোশে তাদের আসল চেহারাটা যদিও লুকানো থাকে, তবে কখনো কখনো তা খসে পড়ে। দেখা যায়, এত দিন যিনি একজন সম্মানীয় ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন, মুখোশের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে তার কদাকার মুখ। তখন তাকে চিনতে কারো কষ্ট হয় না। কেননা, একই সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে তার কৃতকর্মের ইতিহাস। দেখা যায়, নিজেদের স্বার্থে তারা করতে পারে না এমন কোনো কাজ নেই। সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতির বিভিন্ন স্তরে এদের অবস্থান লক্ষ করা যায়। এরা হতে পারে প্রশাসনের বড় কোনো কর্তা, রাজনৈতিক নেতা কিংবা নানা স্তরের জনপ্রতিনিধিও। এদের কারণে সমাজ ও রাষ্ট্রে সৃষ্টি হয়েছে ভয়ংকর ধরনের অবক্ষয়ের ধারা। এরা সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থান করে উইপোকার মতো ভেতর থেকে ভঙ্গুর করে দিচ্ছে সমাজকে, রাষ্ট্রকে।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে এসব উইপোকার জায়গা করে নেওয়া। রাজনীতির ঘরে অবস্থান নেওয়া উইপোকা-ঘুণপোকাদের পরিচয় নতুন করে দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় এসব ক্ষতিকর পোকার সন্ধান আমরা পেয়েছি। দেখা গেছে, এরা রাজনীতির অভ্যন্তরে অবস্থান করে নিজেদের স্বার্থে রাজনীতিকেই খেয়ে ফেলতে উদ্যত হয়েছে! আর এরা রাজনীতির ঘরে জায়গা করে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে রাজনীতির মানুষদের কারণেই। তারাই এই পোকাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন, দিচ্ছেন। ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীস্বার্থে এসব পোকাকে লালন-পালন ও বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিয়ে তারা যে রাজনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন, তা ভেবে দেখার ফুরসত তাদের হয়নি। কারণ, তারা রাজনীতির ছদ্মাবরণে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলে মগ্ন। তবে, ‘চোরের দশদিন গেরস্তের একদিন’ প্রবাদটিকে সত্য প্রমাণ করে এখন যখন থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে, তখনই সামাল সামাল রব উঠেছে তাদের আস্তানাগুলোতে।
এসব উইপোকা সম্বন্ধে মাস পাঁচেক আগে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বছরের ২ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘উন্নয়নের ফসল যেন উইপোকায় খেয়ে না ফেলে, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ উক্তির মর্মার্থ অনুধাবনে কষ্ট হবার কথা নয়। একই সঙ্গে এর গুরুত্ব ও সময়োপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলারও অবকাশ নেই। কেননা, সময়টা এখন উইপোকা-ঘুণপোকাদের মচ্ছবের। তারা বিভিন্ন স্তরে আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি ও উন্নয়ন অবকাঠামোকে ভেতর থেকে খেয়ে ফেলছে। সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতির যেসব তথ্য আমাদের সামনে এসেছে, তাতে নানা স্তরে এসব পোকার উপদ্রবের বিষয়টি স্পষ্ট। এদের কারণে মজুত কয়লা বাতাসে মিশে যায়, পাথর দেবে যায় মাটির নিচে। এদের কলমের স্পর্শে একটি বালিশের দাম হয় সাত হাজার টাকা, হাসপাতালের একটি বিশেষ ধরনের পর্দার দাম হয় সাড়ে সাঁইত্রিশ লাখ টাকা, ডেন্টাল চেয়ারের দাম ওঠে বারো লাখ টাকায়। এসব উইপোকা রাষ্ট্রকে ফোকলা করে দিয়ে নিজেদের সম্পদের ঢিবি পর্বতস করে তুলছে অনায়াসেই। যখন খবর বেরোয়, একজন ঠিকাদার গণপূর্ত বিভাগের দুজন প্রকৌশলীকে ঘুষ দিয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না এদের দাঁত কত তীক্ষ এবং উদর কত স্ফীত। যখন খবর পাওয়া যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর শত কোটি টাকার সম্পদের, তখন বিস্ময়ে নির্বাক হলেও বুঝে নিতে হয়, এরা কতটা শক্তিধর উইপোকা। যখন নিম্ন পর্যায়ের দুজন রাজনৈতিক কর্মীর বাড়ি থেকে সাড়ে ছাব্বিশ কোটি টাকা এবং পাঁচ কোটি টাকার এফডিআর উদ্ধার হয়, তখন এই পোকাদের স্বরূপ নিয়ে আর সংশয় থাকে না।
সাম্প্রতিক যে ঘটনাটি এখনো আলোচনার শীর্ষে অবস্থান করছে, তার কেন্দ্রীয় চরিত্র যুব মহিলা লীগের জেলা পর্যায়ের নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া। তার কর্মকাণ্ডের যেসব ফিরিস্তি ধারাবাহিকভাবে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে, তা রীতিমতো পিলে চমকানো ব্যাপার! এ বিষয়ে গত সপ্তাহের কলামে কিছুটা আলোকপাত করেছিলাম। তাই তা নিয়ে অধিক বলা নিষ্প্রয়োজন মনে করছি। তবে, গত এক সপ্তাহে তার অপকর্মের আরো যেসব কাহিনি বেরিয়ে এসেছে, তাতে বিষয়টি এখনো প্রাসঙ্গিক মনে করছি। ভাবলে অবাক হতে হয়, কীভাবে এমন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের একটি মেয়ে রাজনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে জায়গা করে নিতে পারল! কারা দিল তাকে এ সুযোগ? প্রকাশিত খবর থেকে এটা স্পষ্ট যে, রাজনীতির ওপর মহলের কারো না কারো আশীর্বাদ পেয়েই সে ওপরে ওঠার সিঁড়ির সন্ধান পেয়েছিল। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের হাতে রয়েছে পাপিয়াকে আশ্রয়-প্রশ্রয়দান এবং ব্যবহারকারী ব্যক্তিদের তালিকা। এদিকে দুদকও তৎপর হয়ে উঠেছে পাপিয়া কেলেঙ্কারির তদন্তে। গত মঙ্গলবারের পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, দুদক ওয়েস্টিন হোটেলের কাছে পাপিয়ার পরিশোধ করা বিল-ভাউচারের কপি এবং তার স্যুটে যেসব ‘মেহমানরা’ আসতেন তাদের তালিকা চেয়ে পাঠিয়েছে। তদন্ত যদি সঠিকভাবে এগিয়ে যেতে পারে, তাহলে অনেক রাঘববোয়াল এবার আটকা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। তবে, পাপিয়া কেলেঙ্কারির শেষ পরিণতি কী হয়, তা দেখার জন্য আমাদের আরো কিছুদিন হয়তো অপেক্ষা করতে হবে।
প্রশ্ন হলো, রাজনীতির অভ্যন্তরে এসব ক্ষতিকর পোকা ঠাঁই করে নিতে পেরেছে কীভাবে। উত্তর একটাই, রাজনীতির মানুষদের একটি অংশের আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক মানসিকতার কারণেই এরা বেড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছে। আর সে বাড় এতটাই বেড়েছে যে, তা গোটা রাজনীতিকেই গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে। আগে রাজনীতিতে কদর ছিল সে ছেলেটির, যে লেখাপড়া জানে, রাজনীতি বোঝে, সমাজে ভালো ছেলে হিসেবে যার পরিচিতি রয়েছে। কিন্তু এখন চিত্র একেবারে বিপরীত। কর্মী বাছাইয়ে অগ্রাধিকার পায় তারা, যাদের দেখলে মানুষ ভয় পায়, দূরে সরে যায়। নীতি-আদশের পরিবর্তে শক্তি দিয়ে রাজনীতির মাঠ দখলের অশুভ প্রবণতা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে গ্রাস করায় এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। এর ফলে আমাদের রাজনীতির ময়দান অনেকটাই চলে গেছে নষ্টদের দখলে। আর ভালো মানুষেরা ‘এ কর্ম আমার নয়’ বলে সরে পড়ছে। অথচ, রাজনীতিতে তাদেরই থাকার কথা, যারা এর মূল চেতনাকে লালন করবে, নীতি-আদর্শের প্রতি থাকবে অবিচল। কিন্তু এর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্রই দৃশ্যমান আমাদের সামনে। আর তাই একজন সংসদ সদস্য পরিচিতি পান ‘ইয়াবা সম্রাট’ হিসেবে, কেউবা আসামি হন খুনের। আবার কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে পুত্রের পড়ার খরচের নামে শতাধিক কোটি টাকা বিদেশে পাচারের। আর এসব ঘটনা থেকে অনুধাবন করা যায়, উইপোকা বা ঘুণপোকা আমাদের রাজনীতির কাঠামোকে কী পরিমাণে গ্রাস করেছে। মূলত রাজনীতির ছদ্মাবরণে এর ভেতরে বিচরণরত এই পোকারাই কুরে কুরে খাচ্ছে তাকে। এসব পোকা ওপরওয়ালাদের স্লেহ-আশীর্বাদে কখনো কখনো এতটাই শক্তিধর হয়ে ওঠে যে, আইন ও প্রশাসন তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে সাহস পায় না। বরং উঠতে-বসতে তাদের সালাম ঠুকে।
কথা শুরু করেছিলাম উইপোকা-ঘুণপোকা নিয়ে। আমাদের রাজনীতি যে বর্তমানে উইপোকা আর ঘুণপোকার আক্রমণে পর্যুদস্ত তা অস্বীকার করা যাবে না। চিন্তার বিষয় হলো, এ আক্রমণে শেষ পর্যন্ত রাজনীতির কাঠোমো বিপর্যস্ত হয় কি না। কারণ, রাজনীতির অঙ্গনে এসব পোকার দৌরাত্ম্য এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছে যে, ভালো মানুষেরা এখন আর সেখানে স্বস্তিবোধ করেন না। খালেদ, সম্রাট, পাপিয়াদের অনুপ্রবেশ ও আধিপত্যের কারণে রাজনীতি এখন অনেকের কাছেই পরিত্যাজ্য বিবেচিত হতে শুরু করেছে। একই সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার, দু-একজন সম্রাট-পাপিয়া জালবন্দি হওয়া মানেই উইপোকাদের নির্বংশ হওয়া নয়। রাজনীতির মানুষেরা যদি সতর্ক না হন, তাহলে নতুন করে আরো উইপোকার জন্ম হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গনে উই বা ঘুণপোকার জন্ম ও বিস্তার প্রতিরোধ করা। আর এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকায় থাকতে হবে রাজনীতিকদেরই। পেশিশক্তির লালনপালন বা আশ্রয়-প্রশ্রয়ের পরিবর্তে আদর্শের বিস্তার ঘটিয়ে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধিতে মনোযোগী হতে হবে। অন্যথায় সামনের সময় হয়ে উঠতে পারে আরও ভয়ংকর।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।







































