• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার আইন


ইরানী বিশ্বাস নভেম্বর ৩০, ২০২০, ১০:৫০ এএম
সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার আইন

ঢাকা : নারীর অধিকার নিয়ে পারিবারিকভাবে বা আদালতে আইনি লড়াই যুগ যুগ ধরে বহমান। নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৮মার্চ বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব নারী দিবস। শুধু তাই নয়, নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয় সিডও সনদ। এটিকে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদও বলা হয়। প্রায় ৩ বছর পর ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে এই সনদ কার্যকর শুরু হয়। সিডও সনদে তিনটি মৌলিক নীতি রয়েছে—১.সমতার নীতি, ২. বৈষম্যহীনতার নীতি এবং ৩. শরিক রাষ্ট্রগুলোর দায়বদ্ধতার নীতি। ৩নং নীতির ওপর ভিত্তি করে রচিত সনদে রয়েছে ৩০টি ধারা। ১ থেকে ১৬ পর্যন্ত ধারাগুলোতে ঘোষিত হয়েছে নারীর সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গৃহীত নীতিগুলো। ১৭ থেকে ২২ ধারায় বর্ণিত হয়েছে সিডও ও কর্মপন্থা এবং শরিক রাষ্ট্রগুলোর দায়বদ্ধতা পালনের পন্থাগুলো।

বিশ্বমানতার প্রতীক হিসেবে হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামই সর্বপ্রথম নারীজাতিকে সম্পদের ওপর অধিকারের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি ইসলামে নারীর প্রকৃত মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ইসলামের সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার পূর্বে পৃথিবীর কোনো জাতিই কোনো কিছুর ওপর নারীর নিজস্ব অধিকারকে স্বীকার করত না। ইসলাম নারীজাতির অর্থনৈতিক স্বাধীনতা স্বীকার করেছেন।  কোরআনে বলা হয়েছে, ‘পুরুষ যা অর্জন করবে তা তার প্রাপ্য এবং নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য।’ কোরআনে আরো বলা হয়েছে, ‘নারীদের ন্যায়সংগত অধিকার আছে, যেমন রয়েছে পুরুষদের।’ ইসলামে একাধারে কন্যা, স্ত্রী, ভগ্নী, মাতা হিসেবে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিশ্চিত করেছে।

ইসলামে কন্যা হিসেবে পিতার সম্পত্তিতে নারীর অধিকার রয়েছে এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমান। তবে একমাত্র কন্যা থাকলে সম্পত্তির অর্ধেক পাবে। স্ত্রী হিসেবে স্বামীর সম্পত্তিতে নারীর অধিকার রয়েছে। স্বামী মারা যাবার পর স্ত্রী নিঃসন্তান হলে স্বামীর সম্পত্তির অর্ধেক অংশীদার। সন্তান থাকলে এক চতুর্থাংশ পাবে স্ত্রী। মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে, একজন নারী সন্তান হিসেবে মা-বাবার কাছ থেকে, স্বামী মারা গেলে স্ত্রী হিসেবে স্বামীর কাছ থেকে, মা হিসেবে সন্তানের কাছ থেকে সম্পত্তির অংশ পায়। এই সব অংশ যোগ করলে এবং উল্লিখিত সবদিক বিবেচনা করলে নারীর অংশের সম্পত্তি, মা-বাবার কাছ থেকে পাওয়া পুরুষের অংশের সম্পত্তির চেয়ে কোনো অংশে কম হয় না; বরং বেশিই হয়। তবে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মুসলিম নারী আইন অনুযায়ী প্রাপ্য অধিকার পায় না। ফলে স্বামী মারা গেলে বা বিবাহ বিচ্ছেদ হলে তাদের অনেক কষ্ট ভোগ করতে হয়। এখনো গ্রামের অনেক নারী এমনকী শহরেও বাবার সম্পত্তি থেকে অনেক নারী বঞ্চিত হচ্ছে।

কোরআনে বলা হয়েছে, তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দেবে খুশি মনে। তারা যদি খুশি হয়ে তা হতে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ করো। স্ত্রীর মোহর তাকেই পরিশোধ করো, অন্যকে নয়।’ ইসলামে স্ত্রীর মোহরানার অধিকার অলংঘনীয়। কোনো ছলচাতুরীর মাধ্যমে স্ত্রীকে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। পূর্বের মতো স্ত্রীদের মোহরের ব্যাপারে বর্তমান সমাজেও অনেক ধরনের অবিচার করা হয়। তাদের প্রাপ্য বহুক্ষেত্রে মেয়ের অভিভাবকগণই আদায় করে এবং আত্মসাৎ করে।

২০১৯ সালের ২৮ এপ্রিল ‘জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি বিচারপতি ও বিচারকগণের উদ্দেশে বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে আমাদের সামনে বিচারপতি বা অন্য সবাই রয়েছেন, তাঁদের আমি অনুরোধ করব, হ্যাঁ আমাদের ইসলাম ধর্ম বা মুসলিম আইন (শরিয়া) মানতে হবে, এটা ঠিক। কিন্তু কেবল শরিয়া আইনের দোহাই দিয়ে মা-মেয়েকে বঞ্চিত করে বাবার সম্পদ যে তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়, তার কোনো সুরাহা করা যায় কিনা, আপনারা দয়া করে একটু দেখবেন। এটা করা দরকার।’

প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর সমাজের বিশিষ্টজনেরা মতামত প্রদান করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. যুবাইর মুহম্মদ এহসানুল হক বলেছেন, সংসদ চাইলে আইন পরিবর্তন করতে পারে। তবে কোরআনের বিধান মতে ইসলামের উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তন আনা যাবে না।

হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানকে মূল্যায়ন করে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিরও আজকে পরিবর্তন প্রয়োজন।’ হিন্দু নারী উত্তরাধিকার আইন পৃথিবীর সব থেকে কঠিন এবং কঠোর আইন। হিন্দু মেয়েরা পিতার স্থাবর কোনো সম্পত্তির অধিকারী নয়। প্রাচীনকাল থেকে হিন্দু আইন মোতাবেক মেয়েদের সম্পদ দুই প্রকার— উত্তরাধিকার ও স্ত্রীধন।

উত্তরাধিকার বলতে বোঝানো হয়েছে স্বামীর সম্পত্তির ওপর স্ত্রীর কতটুকু অধিকার থাকবে না থাকবে তার মাপকাঠিতে। স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় স্বামীর সম্পদের ওপর স্ত্রীর কোনো রকম অধিকার নেই। কেবল ভোগ করতে পারবেন। তবে ১৯৩৭ সালের অবিভক্ত ভারতীয় হিন্দু আইন অনুযায়ী স্বামী মারা যাবার পর হিন্দু বিধবা নারী তার স্বামীর সম্পত্তিতে সন্তানদের পাশাপাশি ভাগ পাবেন এবং তা ভোগ করতে পারবেন। কিন্তু বিক্রয় বা হস্তান্তর করতে পারবেন না। একে সহজ ভাষায় জীবনস্বত্ব বলে। এমনকী তীর্থে যাবার বা চিকিৎসার প্রয়োজনেও স্বামীর সম্পত্তি বিক্রয় করতে পারবেন না। বিধবার মৃত্যু হলে তার প্রাপ্ত সম্পত্তি পরবর্তী পুরুষ উত্তরাধিকারীদের হাতে ফিরে যাবে।

হিন্দু নারীদের কেবল স্ত্রীধনের ওপর অধিকার আছে। এখন জানা প্রয়োজন স্ত্রীধন আসলে কী? বিবাহ এবং বিবাহ-সংক্রান্ত ব্যাপারে একটি মেয়ে বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজন বা বিবাহে উপস্থিত যে কারো কাছ থেকে উপহার, উপঢৌকন পেয়ে থাকেন সেগুলো। স্বামীর কাছ থেকে প্রাপ্য যে কোনো উপহার-সামগ্রী। বাবা-মা এবং ভাই-বোন যেসব উপহার দেন, বিশেষ করে অর্থকড়ি, সোনা এবং মূল্যবান অলংকার-সামগ্রী। হিন্দু মেয়েদের বিয়ের অর্থ হলো কন্যা সম্প্রদান। পুরো কন্যা সম্প্রদানের অনুষ্ঠানকেই বিয়ে বলা হয়। কন্যা সম্প্রদানের সময় মেয়েটিকে গোত্র ত্যাগ করে স্বামীর গোত্রভুক্ত করে দেওয়া হয়। এই নিয়মের নাম কনকাঞ্জলি। মুলতঃ সমাজ এবং আত্মীয়-স্বজনের সামনে কনকাঞ্জলি নেওয়ার পর মেয়েটি শ্বশুরবাড়ির অংশ হয়ে যায়। এরই সঙ্গে মেয়েটি তার পিতার সব সম্পত্তির ওপর থেকে অধিকার হারায়। তবে অবিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে নিয়ম ভিন্ন। কোনো হিন্দু মেয়ের বিবাহ হওয়ার আগে যদি তার পিতা মারা যায়, তাহলে অন্যান্য ভাইদের সাথে মায়ের সমানহারে বাবার সম্পত্তির মালিকানা পায়। কিন্তু হিন্দুসমাজে অবিবাহিত মেয়ে সংসারে রাখা নিষেধ। তবে বিবাহের আগ পর্যন্ত শুধু বাবার সম্পত্তি ভোগ করতে পারবে। কখনো বিক্রি করার অধিকার পায় না।

বেদে এবং মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে, যারা মৃত ব্যক্তির পিণ্ডদান করবে তারা সবাই মৃতের সব সম্পদের অধিকারী হবে। সাধারণ নিয়মে ছেলেরাই পিতার পিণ্ডদান করে থাকে। তাই ছেলেরাই পিতার সম্পত্তির প্রথম উত্তরাধিকারী হয়ে থাকে। ছেলে না থাকলে ছেলের ছেলে বা ছেলের নাতি সেই উত্তরাধিকারী হবে। তাও যদি না থাকে তবে মেয়ের ছেলে পিণ্ডদান করে। সরাসরি মেয়ে নয়। মেয়ের ছেলে হবে এই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। তাও যদি না থাকে তবে ভাইয়ের ছেলেরা মৃত ব্যক্তির পিণ্ডদান করে, ওই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে।

১৯৫৬ সালের ভারতীয় হিন্দু ব্যক্তিগত আইন (হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন) নারীকে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি প্রাপ্তির অধিকার প্রদান করে। পুত্র সন্তানরা পূর্বপুরুষের সম্পত্তি একটি অংশের প্রাপক ছিলেন, কিন্তু কন্যা সন্তানরা কেবল তাদের পিতার প্রাপ্ত অংশের ওপর একটি অংশ পেতেন। একজন পিতা যদি তার পূর্বপুরুষের সম্পত্তির দাবি ত্যাগ করতেন, তাহলে তার কন্যা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন। তবে তার পূত্র তার নিজের অংশের ওপর অধিকার বজায় রাখতে পারতেন। এমনকী বৈবাহিক জীবনে নিপীড়নের সম্মুখীন মহিলাদেরও তাদের পূর্বপুরুষের বাড়িতে বসবাসের কোনো অধিকার ছিল না। বেশিরভাগ ভারতীয় পরিবারের মহিলাদের নামে কোনো সম্পত্তির মালিকানা নেই। তাদের পৈতৃক সম্পত্তির অংশ পায় না। তাদের সুরক্ষার্থে থাকা আইনগুলোর যথাযথ প্রয়োগের অভাবে নারীরা এখনো বহুক্ষেত্রে জমি ও সম্পত্তির প্রকৃত অধিকার পায় না। ভারতে সম্পত্তির ওপর নারীর অধিকার ধর্ম ও গোত্রের ওপর নির্ভরশীল। বহু আইনি ও প্রথাগত জটিলতার জালে আবদ্ধ।  ২০০৫ সালে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংশোধনের ফলে নারীকে এখন পুরুষের সমান ও বৈধ অধিকার প্রদান করা হয়েছে।

বাংলাদেশের হিন্দু আইনের কোনো রকম পরিবর্তন বা সংশোধন করা হয়নি। এখনো ১৯৩৭ সালের আইন বলবৎ রয়েছে। গত ২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের হাইকোর্টে একটি রায় প্রদান করা হয়েছে। অনেকেই না জেনে এ বিষয়ে অনেক মন্তব্য করেছেন। ১৯৯৬ সালে খুলনায় গৌরিদাসী নামের এক বিধবা নারী স্বামীর কৃষিজমি অধিকারের দাবি করেছিলেন। এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন তার দেবর জ্যোতিন্দ্রনাথ মন্ডল। বিধবারা স্বামীর কৃষি জমির ভাগ পাবে না-এই মর্মে বিধবার দেবর খুলনা আদালতে মামলা করেছিলেন। প্রথমে মুন্সেফ কোর্টে যে রায় হয়েছিল সেটি ছিল বিধবার দেবরের পক্ষে। নিম্ন আদালতের এই রায়টি ১৯৩৭ সালের আইন অনুযায়ী সঠিক ছিল না বলে মনে হয়েছিল। জেলা জজ ও পরবর্তী হাইকোর্টে রায়ে বলা হয় বিধবারা স্বামীর কৃষি-অকৃষি সব সম্পত্তিরই ভাগ পাবে। তবে জীবনস্বত্বে। বিধবারা জীবদ্দশায় সব সম্পত্তি ভোগ করতে পারবে তবে কোনো সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর করতে পারবে না।

এই রায় যদিও কোনো যুগান্তকারী ঘটনা নয়। তবুও বলতে হয়, এত বছরেও হিন্দুসমাজ তাদের উত্তরাধিকারী আইনটি নিয়ে কখনো প্রশ্ন তোলেনি। কোনো হিন্দু নেতা বা নেত্রীরা পরিবর্তনের জন্য চিন্তাও করেননি। সেখানে দেশের আদালত একটু হলেও পরিবর্তন করতে পেরেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হিন্দু আইন সংসদ কর্তৃক সংশোধন বা পরিবর্তন করতে পারেন না, এর জন্য অবশ্যই হিন্দু ধর্মীয় কর্তা ব্যক্তিদের ইচ্ছা বা মতামত দরকার। আশাকরি খুব শিগগিরই হিন্দুসমাজ এ বিষয়ে বিশেষ বিবেচনা করবেন। হিন্দু বিধবা নারীদের একটু হলেও আশার আলো দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য মাননীয় আদালত এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।

লেখক : পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম নিবন্ধ

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!