• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫, ৩ পৌষ ১৪৩২
SonaliNews

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত নিউজ পোর্টাল

কোরবানীর ফজিলত ও বিধি-বিধান


মুফতি হেলাল উদ্দীন হাবিবী জুলাই ৯, ২০২১, ১১:৩৬ পিএম
কোরবানীর ফজিলত ও বিধি-বিধান

ঢাকা : কোরবানির সূচনা হয় মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-এর যুগ থেকে। দুনিয়ার প্রথম মানব  হজরত আদম (আ.) এর সন্তান হাবিল-কাবিলের মধ্যে বিবাহ নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে হজরত আদম (আ.) তাদের দ্বন্দ্ব নিরসনের মানসে উভয়কে ইখলাসের সাথে কোরবানি করার নির্দেশ প্রদান করেন। অতঃপর মহান রাব্বুল আলামিন তাকওয়ার ভিত্তিতে হাবিলের কোরবানি কবুল করলেন এবং কাবিলের কোরবানি প্রত্যাখ্যান করলেন। আর এভাবেই মানব ইতিহাসে কোরবানির প্রচলন শুরু হয়। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘হে আমার হাবিব! আপনি তাদেরকে আদম-এর পুত্রদ্বয়ের ঘটনা যথর্থারূপে পাঠ করে শুনিয়ে দিন; যখন তারা উভয়েই কোরবানি দিয়েছিল। অতঃপর তাদের একজনের কোরবানি কবুল করা হয়েছিল এবং অপরজনের কোরবানি গৃহীত হয়নি। সে বলল, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করবো। তখন অপরজন বলল, আল্লাহতায়ালা মুত্তাকিদের আমল কবুল করে থাকেন।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত-২৭)

পরবর্তীতে মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) খোদাপ্রেমের নিদর্শন ও পরীক্ষাস্বরূপ মিনার প্রান্তরে তাঁর কলিজার টুকরা সন্তান ইসমাঈল (আ.)-এর গলায় ছুরি চালিয়ে ত্যাগ ও ভালোবাসার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। বিশ্বময় রচিত হলো কোরবানির নতুন ইতিহাস। এ ব্যাপারে দয়াময় আল্লাহ মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো, তখন পিতা ইবরাহিম (আ.) তাকে বললেন, হে আমার প্রিয় সন্তান! আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, তোমাকে জবাই করছি; এবিষয়ে তোমার অভিমত কী? ছেলে উত্তরে বলল, হে আমার পিতা! আপনাকে যা নির্দেশ করা হয়েছে আপনি তা বাস্তবায়ন করুন। ইনশাআল্লাহ্! আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং জবাই করার জন্য তাকে শায়িত করল, তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইবরাহিম! তুমি স্বপ্নে যা দেখেছ তা সত্যে পরিণত করেছ। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে জবাই করার জন্য এক মহান জন্তু দান করলাম।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত-১০২)

প্রিয় পাঠক! কোরবানি অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত, ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নাত ও মহান স্রষ্টার নৈকট্য অর্জনের এক বিশেষ মাধ্যম। কোরবানির মূল উদ্দেশ্য শুধুমাত্র পশু জবাই নয়; বরং জীবনের সর্বক্ষেত্রে খোদাভীতি ও প্রীতি অর্জনই এর মূল লক্ষ্য। কোরবানির বিনিময়ে মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে মুমিনের জন্য রয়েছে অসংখ্য পুরস্কার ও অফুরন্ত প্রতিদান। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহতায়ালার কাছে কোরবানির পশুর গোশ্ত ও রক্ত পৌঁছায় না; বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া তথা খোদাভীতি।’ (সুরা হজ, আয়াত-৩৭) মহান আল্লাহতায়ালা কোরআনের অন্যত্র ইরশাদ করেন, আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন। (সুরা কাওসার)

হজরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এই কোরবানি কী? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটা তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) এর সুন্নাত। অতঃপর আবার জিজ্ঞাসা করা হলো, এই কোরবানির মধ্যে আমাদের জন্য কী প্রতিদান রয়েছে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, প্রতিটি পশমের বিনিময়ে নেকি রয়েছে।’ (ইবনে মাযাহ, হাদিস নং- ৩১২৭) আম্মাজান হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ঈদুল আজহার দিন মানুষের সমস্ত নেক আমলের মধ্যে আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় ও পছন্দনীয় আমল হলো কোরবানি। কিয়ামতের দিন কোরবানির পশু তার শিং, পশম ও ক্ষুরসহ সম্পূর্ণ সুস্থ-সবল অবস্থায় হাজির হবে। নিশ্চয় কোরবানির রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে তা কবুল হয়ে যায়। অতএব, তোমরা কোরবানির মাধ্যমে নিজেদের পবিত্রতা অর্জন কর এবং খুশি মনে আনন্দচিত্তে কোরবানি কর।’ (তিরমিযি, হাদিস নং-১৪৯৩) প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো ইরশাদ করেন, ‘তোমরা মোটা-তাজা পশু কোরবানি কর, কারণ তা পুলসিরাতে তোমাদের সাওয়ারি হবে।’ (কানযুল উম্মাল)

আর যারা সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও কোরবানি করে না, তাদের ব্যাপারে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কঠোর বাণী উচ্চারণ  করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমার ঈদগাহে না আসে।’ (ইবনে মাযাহ, হাদিস নংং-৩১২৩) তাই ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে এবং ইবরাহিমি চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে মহান স্রষ্টার নৈকট্য ও সান্নিধ্যলাভের আশায় কোরবানি করা প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুমিন মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব। সঠিক পদ্ধতিতে কোরবানি করার সুবিধার্থে এ সংক্রান্ত কিছু জরুরি মাসায়েল আপনাদের সমীপে উপস্থাপন করা হলো।

 যে ব্যক্তি ১০ জিলহজ ফজর হতে ১২ জিলহজ সন্ধ্যা পর্যন্ত জীবিকা নির্বাহের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ ব্যতীত সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা অথবা এর সমপরিমাণ মূল্যের মালিক হয়, তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব।

 ১০ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ সন্ধ্যা পর্যন্ত কোরবানী করার নির্ধারিত সময়। তবে প্রথম দিন কোরবানী করা সর্বাপেক্ষা উত্তম, এরপর যথাক্রমে দ্বিতীয় দিন ও তৃতীয় দিন।

 নাবালেগ, পাগল ও মুসাফিরের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়; যদিও সে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়।

 উট, মহিষ, গরু, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা ইত্যাদি গৃহপালিত পশুর দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ। এতদ্ব্যতীত হরিণ বা অন্যান্য হালাল বন্য পশুর দ্বারা কোরবানি জায়েজ নয়।

 উট, মহিষ ও গরু এই তিন প্রকার প্রাণীর ক্ষেত্রে এক থেকে সর্বোচ্চ সাতজন পর্যন্ত শরীক হয়ে কোরবানি করা জায়েজ। তবে ছাগল, ভেড়া, দুম্বা এই তিন প্রকার প্রাণীর ক্ষেত্রে একের অধিক শরীক হয়ে কোরবানি করা জায়েজ নয়।

 ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা-এর বয়স কমপক্ষে এক বৎসর, গরু ও মহিষের বয়স কমপক্ষে দুই বৎসর এবং উটের বয়স কমপক্ষে পাঁচ বৎসর হতে হবে।

 একাধিক শরীক মিলে যদি একটি পশু কোরবানি করে, তবে এর গোশ্ত অনুমান করে বণ্টন করা জায়েজ নয়; বরং পাল্লা দ্বারা মেপে সমানভাবে বণ্টন করতে হবে। অন্যথায় কমবেশি হয়ে গেলে গুনাহ্গার হবে।

  যদি একাধিক ব্যক্তি শরীক হয়ে একটি পশু কোরবানি করতে চায়, তবে যাচাই-বাছাই করে শরীক নির্ধারণ করতে হবে, কেননা তাদের মধ্যে কোনো এক শরীকের কোরবানির টাকা যদি হারাম হয় বা কোনো শরীকের উদ্দেশ্য যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্য কিছু হয়ে থাকে, তাহলে সকলের কোরবানি বাতিল হয়ে যাবে।

 যে পশুর দুইটি চোখ-ই পূর্ণ অকেজো অথবা একটি কান বা লেজের এক তৃতীয়াংশ কেটে গেছে এমন পশু দ্বারা কোরবানি জায়েজ হবে না।

 যে পশুর একটি দাঁতও নেই, তার দ্বারা কোরবানি জায়েজ নয়।

 যে পশুর শিং উঠেনি বা উঠেছিল কিন্তু ভেঙে গেছে, তার দ্বারা কোরবানি হবে। কিন্তু যদি মূল হতে ভেঙে যায় তাহলে কোরবানি হবে না।

 কোরবানির পশুর চামড়া বা তার মূল্য এতিম, গরিব, মিসকিন ও অসহায়দের দান করতে হবে। মসজিদে দান করা যাবে না। তবে মাদরাসার লিল্লাহ ফান্ডে দান করলে অধিক সওয়াব পাওয়া যাবে, কেননা এর দ্বারা মাদরাসার এতিম, গরিব ও মেধাবী ছাত্ররা  কোরআন-হাদিস শিক্ষা করে বিশ্বময় ইসলামের খিদমতে নিজেকে উৎসর্গ করে থাকে।

 মৃত ব্যক্তির নামে কোরবানি করা জায়েজ এবং তার গোশ্ত নিজে খাওয়া বা বণ্টন করে দেওয়া জায়েজ। তবে মান্নত বা ওসিয়তের কোরবানির সমস্ত গোশ্তই দান করে দেওয়া ওয়াজিব।

 যে পশু দ্বারা কোরবানি জায়েজ নাই তার দ্বারা আকীকাও জায়েজ নাই।

 কুরবানির পশুর অংশে আকীকা করাও জায়েজ। কেননা উভয়টির উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন।

 গোশ্ত বণ্টনের মুস্তাহাব তরিকা হলো, একভাগ নিজেদের জন্য রাখা, আরেকভাগ আত্মীয়-স্বজনকে দেওয়া, আরেকভাগ গরিব মিসকিনদের দেওয়া। তবে এক্ষেত্রে কমবেশি করলেও জায়েজ আছে।

 কোরবানির পশুর গোশ্ত, চর্বি, হাড্ডি, মগজ,  ইত্যাদি বিক্রি করা মাকরূহ তাহরিমী। এতদসত্ত্বেও যদি কেউ বিক্রি করে, তাহলে তার সমুদয় মূল্য সদকা করে দিতে হবে।

 কোরবানির পশুর গোশ্ত, হাড্ডি, বা অন্য কোনো অংশ কসাইকে পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া জায়েজ নয়।

 কোরবানির পশু জবেহ করার পর প্রাণ সম্পূর্ণরূপে বের হওয়া পর্যন্ত তার শরীরের কোনো অংশে ছুরি লাগানো জায়েজ নেই। কেননা এতে জবাইকৃত পশুটি অধিক কষ্ট পায়।

(সূত্র : ফাতাওয়ায়ে শামী, ফাতাওয়ায়ে আলমগিরী, ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া ও হিদায়া)

লেখক : খতিব, মাসজিদুল কোরআন জামে মসজিদ, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা
প্রিন্সিপাল, মারকাজুল উলূম আজিজিয়া মাদরাসা, কাজলা যাত্রাবাড়ী, ঢাকা [email protected]

 

Wordbridge School
Link copied!