• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার যানজট বৃদ্ধির শঙ্কা


বিশেষ প্রতিনিধি জুন ১৭, ২০২২, ০৪:২২ পিএম
ঢাকার যানজট বৃদ্ধির শঙ্কা

ঢাকা : বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চেহারা। 

সংশ্লিষ্ট ২১ জেলায় খুলবে বিনিয়োগের নতুন দুয়ার। শিল্প বিনিয়োগের ছোঁয়ায় কাজের জন্য দক্ষিণের জেলাগুলো থেকে ঢাকা ছুটে আসা মানুষের স্রোত কমে যাবে। কিন্তু পদ্মার এমন সম্ভাবনার হাতছানির মধ্যেও যানজটের নতুন এক ভয় জাগছে রাজধানীর মানুষের মনে।

যোগাযোগ ও নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পদ্মা সেতুর প্রভাবে ঢাকা হবে বাড়তি যানবাহনের চাপ। এতে ঢাকার কয়েকটি এলাকার যানজট আরো তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে রাজধানীর আশপাশের রিং রোড দিয়ে ট্রাফিক ডাইভারশন করে যানজটের সম্ভাব্য এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের পরিসংখ্যান বলছে, পদ্মা সেতু চালুর পর পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটের ৪০ শতাংশ যানবাহন এটি ব্যবহার করবে। একই সঙ্গে দেশের অন্যান্য জেলার সঙ্গেও সরাসরি যোগাযোগ বেড়ে যাবে দক্ষিণের জেলাগুলোর। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু হয়ে দিনে ২৫ হাজারের বেশি যানবাহন চলবে। প্রতি বছরই গাড়ি চলাচলের এই সংখ্যা বাড়তে থাকবে। 

রাজধানীর দুটি সড়ক ব্যবহার করে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে এসব যানবাহন চলাচল করবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে। এই অতিরিক্ত গাড়ি চাপ সামাল দিতে রাজধানীর রাস্তাগুলো এখনো প্রস্তুত নয়। ফলে ঢাকা ও আশপাশে যানজটের কারণে উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাধা সৃষ্টি হতে পারে।

দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর ২৫ জুন খুলছে পদ্মা সেতু। এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নের দুয়ার খুলে দেবেন। রাজধানী থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৪ ঘণ্টায় পৌঁছানো যাবে দক্ষিণের ২১ জেলায়। বেনাপোল স্থলবন্দর, ভোমরা স্থলবন্দর, মংলাবন্দর, পায়রাবন্দর পৌঁছানো যাবে সহজেই। সেতুর জাজিরা প্রান্ত থেকে বরিশাল যাওয়া যাবে সর্বোচ্চ ২ ঘণ্টায়, খুলনা ৩ ঘণ্টায় আর ফরিদপুর যেতে সময় লাগবে ৪৫ থেকে ৫০ মিনিট। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্ত থেকে মাত্র ১০ থেকে ১২ মিনিটেই পৌঁছে যাবে মাওয়া প্রান্তে। এরপর ৪০ মিনিটের মধ্যে গুলিস্তান কিংবা যাত্রাবাড়ী পৌঁছে যাওয়া যাবে। তেমনি খুলনা, যশোর থেকেই চার, সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যেই রাজধানীতে পৌঁছানো যাবে। দক্ষিণাঞ্চলের এমন অনেক পরিবহন মালিক রয়েছেন, যারা শুধু মাওয়া ও দৌলতদিয়ার ফেরির কারণে বিলাসবহুল গাড়ি নামাতে পারে নাই। সেতু চালু হলে সড়ক পথের যোগাযোগে ফেরি ভোগান্তি থাকবে না। তাই এখন নতুন ও বিলাসবহুল গাড়ি নামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও রাজধানী ঢাকার মধ্যে যাতায়াতের সময় কমিয়ে দেবে বটে। কিন্তু এই সেতু চালু হলে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হতে পারে। তারা বলেন, রাজধানীর অতিরিক্ত যানবাহন চলাচলের জন্য সেতু নির্মাণের সময় রাজধানীর চারপাশে রিং রোডের উন্নয়ন করা উচিত ছিল।
 
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর যানবাহন সেতু হয়ে এখন ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করবে এবং মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে যাত্রাবাড়ী থেকে ঢাকায় প্রবেশ করবে। 

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান বলেন, অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে যাত্রাবাড়ী পয়েন্টে ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হতে পারে। 

রাজধানীর চানখারপুলের প্রধান প্রস্থান পয়েন্টে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে কেবল দুটি টোল বুথ রয়েছে। পদ্মা সেতু চালুর আগে এখানে আরো ছয়টি বুথ করা উচিত ছিল। কারণ বর্তমানে যে যানবাহন চলাচল করে তার টোল আদায় করতে গিয়ে নিয়মিত যানজট লেগে থাকে। পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলে এ অবস্থা আরো ভয়াবহ হবে। অনেক সময় পোস্তগোলা সেতু পর্যন্ত ফ্লাইওভারটি গাড়িতে প্যাকেট (বন্ধ) হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. শামসুল হক বলেন, পদ্মা সেতু ঢাকার যানজট পরিস্থিতির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে। 

কারণ, সংশ্লিষ্ট জেলা থেকে ঢাকায় আরো বেশি মানুষ আসা যাওয়া করবে। আরো বেশি ব্যক্তিগত ও পণ্যবাহী যানবাহন আসবে এবং এমনকি কিছু যানবাহন ঢাকা-আরিচা করিডোর ব্যবহার না করে পদ্মা সেতু ব্যবহার করে ঢাকা অতিক্রম করবে। এই সরাসরি যোগাযোগ রাজধানীর যানজটকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে।

তিনি আরো বলেন, ঢাকায় এমনিতেই প্রচণ্ড যানজট লেগে থাকে। তারপর পদ্মা সেতু থেকে নতুন যান চলাচলের শুরু হলে বুড়িগঙ্গা সেতু, বসিলা ও হানিফ ফ্লাইওভারসহ রাজধানীর ১০টি প্রবেশপথে তীব্র যানজট সৃষ্টি হবে। পরিস্থিতিতি সামাল দিতে রাজধানীর আশপাশের রিং রোড তৈরি করার ওপর জোর দেন তিনি।

শামসুল হক বলেন, এই রাস্তাগুলো আরো আগেই শেষ করা উচিত ছিল। ভূমি অধিগ্রহণের কারণে বর্তমানে এসব সড়ক নির্মাণ করা কঠিন। শুধু সেতু নয়, ঢাকায় যানবাহন চলাচলের জন্যও এসব সড়কের পরিধি বৃদ্ধি করা খুবই প্রয়োজন।

রাজধানীর বন্যাপ্রবাহ অঞ্চলগুলোর জন্য, ২০১৫ থেকে ২০৩৫ সালের জন্য সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা করা হয়ে ছিল, যা আগস্ট ২০১৬-এ অনুমোদিত হয়। এতে ৭৩ কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ রিং রোড ও ১০৮ কিলোমিটার মধ্য রিং রোড এবং ১২৯ কিলোমিটার আউটার রিং রোড নির্মাণের মাধ্যমে আন্তঃরাজধানী ট্রাফিকপ্রবাহকে আন্তঃজেলা ট্রাফিক থেকে আলাদা করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।

অভ্যন্তরীণ রিং রোডটি রাজধানীর আশপাশের যাত্রীদের জন্য একটি নতুন রুট তৈরি করবে। তেরমুখ-আব্দুল্লাহপুর-গাবতলী-রায়েরবাজার-বাবু বাজার-সদরঘাট-ফতুল্লা-চাষাড়া-সাইনবোর্ড-শিমরাইল-ডেমরা-ইস্টার্ন বাইপাস এবং এর প্রসারিত পথের পাশ দিয়ে যাবে। পূর্বে বালু নদী এবং দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদী। আউটপুরা-ঢাকা বাইপাস-ভুলতা-কাঁচপুর-ঝিলমিল-পশ্চিম বাইপাস বরাবর মাঝারি রিং রোড তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। 

আউটার রিং রোডটি রাজধানীর বাইরের পরিধি বরাবর চালানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে যা হেমায়েতপুর-কালাকান্দি-মদনপুর-ডাঙ্গা-বাইপাইল-গাজীপুর সংযোগকারী একটি নতুন ট্রাফিক রুট তৈরি করবে।
 
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় বোর্ডের তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক এসএম সালেহউদ্দিন বলেন, কর্তৃপক্ষ যখন পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরু করেছিল তখন তাদের উচিত ছিল রাজধানীর দিকে যানবাহন চলাচলের সুবিধার্থে অন্যান্য অবকাঠামোগুলো তৈরি করা। এখন ঢাকাকে দুই দিক থেকে সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে-যানজট বৃদ্ধি এবং প্রতিদিন ব্রিজ পার হয়ে বিপুল মানুষের উপস্থিতি।

তিনি বলেন, সেতুটি ২১টি জেলা থেকে ঢাকায় যাতায়াতের সময় উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনবে বলে অনেক লোক ঢাকায় প্রবেশের চেষ্টা করবে। একই সাথে রাজধানীতে মানুষ ও যানবাহনের উপস্থিতি বাড়াবে। ঢাকা থেকে আসা যানবাহনের চাপ এড়াতে অবিলম্বে অভ্যন্তরীণ ও আউটার রিং রোড নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছেন বাস রুট যৌক্তিককরণ কমিটির অন্যতম এ পরামর্শক সালেহউদ্দিন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আক্তার মাহমুদ বলেন, সেতুটি উদ্বোধন হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোতে যানবাহনের সংখ্যা বাড়বে। যার চাপে রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হবে, বর্তমান ট্রাফিক ব্যবস্থায় যা মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সভাপতি আক্তার বলেন, যানবাহন বাইপাস করার জন্য সরকারের উচিত অবিলম্বে অভ্যন্তরীণ এবং বিশেষ করে মধ্যম রিং রোড নির্মাণ করা। পদ্মা সেতুর পর ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের চার লেনের মানোন্নয়নের কাজ শেষ হলে রাজধানীতে যানবাহনের চাপ আরো বাড়বে। এতে যানজট যে তীব্র হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন অথরিটির নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আক্তার বলেন, তারা সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় রিং রোড নির্মাণের প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা বা সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। 

তিনি জানান, সড়ক ও জনপথ বিভাগ অভ্যন্তরীণ রিং রোড নিয়ে কাজ করছে কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো অর্থায়নের উৎস নিশ্চিত করা হয়নি। আমরা পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর পরিবহনব্যবস্থা, ট্রাফিক ডাইভারশন এবং প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনার জন্য ১৯ জুন সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে যাচ্ছি।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. সবুজ উদ্দিন খান জানান, তারা ২০১৭ সালে অভ্যন্তরীণ রিং রোড নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করেছেন। তারপর থেকে সওজ দাতাসংস্থার কাছ থেকে তহবিল খুঁজতে শুরু করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো দাতাসংস্থা এই প্রকল্পে অর্থায়ন করতে রাজি হয়নি।

সওজের অতিরিক্ত সচিব ইউসুব আলী মোল্লা জানান, গত ৯ জুন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের এক সভায় যানজট এড়াতে ঢাকার আশপাশের সংযোগ সড়কগুলো মেরামত করতে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত ট্রাফিক কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান জানান, পদ্মা সেতু দিয়ে আসা যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে তাদের কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। তারা চট্টগ্রামগামী যানবাহনগুলোকে পোস্তগোলা ব্রিজ দিয়ে এবং তারপর পাগলা হয়ে নারায়ণগঞ্জের দিকে সংযোগ সড়কে নিয়ে যাবে।

তিনি জানান, পিক আওয়ারে তারা মতিঝিল/রমনাগামী যানবাহনগুলোকে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে দয়াগঞ্জ রাস্তা দিয়ে ঘুরিয়ে দেবে। ফ্লাইওভারটি নিমতলী, গাবতলী, মতিঝিল ও বিশ্বরোডের মতো বিভিন্ন দিকে যানবাহন নিয়ে যাবে। পণ্যবোঝাই যানবাহনগুলো শহরের মধ্যদিয়ে অফ-পিক সময়ে চলাচল করবে এবং তারা এই সময়ে কিছু আন্তঃজেলা বাসকে শহর অতিক্রম করার অনুমতি দেবে। তবে অতিরিক্ত যানজট নিয়ন্ত্রণে যাত্রাবাড়ী পয়েন্টে জনবল বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!