• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘এখন নামাজের বিরতি’ লেখা রেখে দোকান ফেলে চলে যান শরিফুল


আজাদ ফারুক সেপ্টেম্বর ৮, ২০২২, ০৩:৩৯ পিএম

 ঢাকা : মসজিদে মোয়াজ্জিনের কণ্ঠে আজানের সু-মধুর ধ্বনি কানে বাজতেই দুনিয়ার সব কাজ, ব্যবসা-বানিজ্য রেখে আল্লাহর ডাকে সারা দিতে চলে যান সালাত আদায় করতে। আল্লাহর উপর ভরসা করে নামাজের বিরতি লেখা একটি সাইনবোর্ড দিয়ে ব্যবসা-বানিজ্য রেখেই চলে যান মসজিদে। এতে তার ব্যবসার ক্ষতি, মালামাল চুরি হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও তা নিয়ে তার কোন চিন্তার ভাজ নেই। উল্টো তার ব্যবসা আরও বেশি ভালো হয় বলে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ী ইউনিয়নের মোহাম্মদ শরিফুল ইসলাম।

জানা যায়, গত ২ বছর ১ মাস আগে ঢাকায় আসেন শরিফুল। অন্যের চাকরি করলে সঠিকভাবে আল্লাহর ইবাদত করতে পারবেন না। এমন চিন্তা থেকে নিজে ভ্যানে করে শাক-সবজি বিক্রি শুরু করেন রাজধানীর গ্রিন রোড এলাকায়। যা দিয়ে চলে যাচ্ছে তার সংসার। এখনও বিয়ে না করলেও বাবা-মা ও একভাই দুই বোন নিয়ে অনেক ভালো চলছে তাদের পরিবার। বাবা গ্রামের বাড়িতে দিয়েছেন হাঁসের খামার। এরপর টমটম ভাড়ায় চালান। তবে উপার্জনের মুল দায়িত্বটা তিনি পালন করেন। বড় বোন বিয়ে দিয়েছেন। ছোট বোনকে পড়ালেখা করাচ্ছেন দাওরায় হাদিস আর ভাইকে হেফজ খানায়।

মোহাম্মদ শরিফুল ইসলাম, ছবি : সোনালীনিউজ। 

এ বিষয়ে মোহাম্মদ শরিফুল ইসলাম সোনালীনিউজকে বলেন, ২ বছর বেশি হয়েছে ঢাকায় এসেছি। ২০ মাস ধরে সবজি ব্যবসার সাথে জড়িত। পরিবারে ৭ সদস্যের সংসার। ব্যবসা করে আগের চেয়ে অনেক ভালো চলেছে। এখনও বিয়ে করেননি। ছোট বোনটাকে দাওরায় হাদিসে পড়ালেখা করাচ্ছি। পরিক্ষা শেষ হলে ওকে বিয়ে দিবো। ছোট ভাই পড়ালেখা করেন হেফজ খানায়। বড় বোনকে বিয়ে দিয়েছি। 

নিজের ইচ্ছার কথা জানিয়ে শরিফুল আরও বলেন, নতুন করে একটি ঘর নির্মাণ করে বিয়ে করার ইচ্ছা আছে। ইসলামী বিষয়ে তেমন পড়া শোনা করি নাই। সাধারণ শিক্ষায় কলেজ পর্যন্ত পড়েছি। বাবা আর আমি মিলে সংসারের হার ধরেছি। বাবা বাড়িতে একটি ছোট হাঁসের খামার দিয়েছেন, পাশাপাশি টমটম ভাড়াচালান। কয়েকটা গরু আছে। সেই উপার্যনের চলছে সংসার। 

বেঁচা কেনা ভালো হয় জানিয়ে তিনি সোনালীনিউজকে আরও বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। প্রতিদিনই হাজারের ওপরে ইনকাম হয়। আল্লাহ যা দেন এটাই শুকরিয়া। নিজের দায়িত্বে ব্যবসা করলে কারও কোন অজুহাত আসে না। আপনি যদি মালিকের অধীনে কাজ করেন আপনার ওপর অনেক টর্চার হয়। অনেক বাজে কথা শুনতে হয়। এজন্য আমি চিন্তা করলাম নিজে ব্যবসা দিবো কারও কথা শুনবো না। নামাজের সময় পাওয়া যায় না। কোন নেক-আমল করা যায় না। জরুরী প্রয়োজন হলে বাড়িতে যাওয়া যায় না। যেকারণে নিজেই ব্যবসা দিলাম যাতে কোন সমস্যা হলে সমাধান করতে পারি।

ছবি : সোনালীনিউজ। 

নামাজের বিরতি সাইনবোর্ডটা লেখার রহস্য কি জানতে চাইলে শরিফুল ইসলাম সোনালীনিউজকে বলেন, নামাজের সময় যখন আমি মসজিদে চলে যাই তখন অনেকে খোঁজাখুজি করে। যখন আমি চিন্তা করলাম যেহেতু নামাজে যাই। অনেকে কষ্ট পায় বলে যে, ছেলেটা দোকান রেখে কোথায় গেছে। তখন আমার দারণা এসেছে। এমন একটা সাইনবোর্ড দিয়ে গেলে কেউ আর খুজবে না। বা কেউ কষ্ট পাবেনা। এটা দিলে আমার উপকার হবে। সেই চিন্তা থেকে এটা দিয়েছি। 

‘আর নামাজের বিরতি লেখাটা দেখলে হাজার খারাপ থাকলেও অনেকের মধ্যে একটা ভয় সৃষ্টি হয়। সেতো আল্লাহর কাজ করতে গেছে। এই চিন্তা করে কিছু বলে না। ক্রেতারা অনেকে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। আর যার জরুরি দরকার হয় সে সবজি নিয়ে চলে যায়। পরে টাকা দিয়ে দেয়। আবার অপেক্ষা না করে অনেকে চলে যায়। যেহেতো এখানে লেখা আছে নামাজের বিরতি। তখন যাদের তাড়া আছে তারা চলে যায়। যাদের বিশেষ প্রয়োজন তারা দাঁড়িয়ে থাকে আমি নামাজ পড়ে আসার পর বিক্রি করি।’

মোহাম্মদ শরিফুল ইসলাম, ছবি : সোনালীনিউজ। 

নামাজ পড়তে যাওয়ার পর ক্রেতারা এসে না পেলে অনেকে রাগ করেন বলে অভিযোগ করেছেন শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, নামাজ পড়তে যাওয়ার পর ক্রেতারা এসে না পেলে অনেকে রাগ হয়। বলে তুমি এতক্ষণ দেরি কর কেন? নামাজ পড়তে এতো সময় লাগে নাকি? নানান কথা। তখন আমি বলি আল্লাহ কাজ করতে গেলে একটু সময় দরকার। সারাদিন সময় দেই দুনিয়ার ক্ষেত্রে। এখন আল্লাহর রাস্তায় যদি একটু সময় না দেয় তাইলে কেমন হয় না? 

‘যেহেতো আমি নামাজ পড়ি। এখন যদি নামাজ পরিপূণ্যভাবে না পড়ি, তাইলেতো এই নামাজের কোন মূল্য নাই। যেকারণে নামাজে আমার একটু দেরি হয়।’

রাস্তার ওপর ব্যবসা করলেও নামাজের সময় হলে নামাজের বিরতি লেখা একটি সাইনবোর্ড দিয়ে খোলা রাস্তায় ব্যবসা ফেলে চলে যান মসজিদে। নামাজের বিরতি দিয়ে খোলা রাস্তায় ব্যবসা ফেলে চলে গেলে ভ্যান চুরির আশঙ্কা আছে কিনা জানতে চাইলে সোনালীনিউজকে এই শাক বিক্রেতা বলেন, মাঝে মধ্যে ভয়তো হয়, মেইন রাস্তায় ভ্যান রাখি, কেউ যদি নিয়ে যায় সেই শঙ্কায় একটু চিন্তিত হই। 

ক্রেতা,  ছবি : সোনালীনিউজ। 

‘এটা নিয়ে কোন চিন্তা করি না। যেহেতো আমি আল্লাহর কাজ করি। তিনি অবশ্যই এটা দেখতেছেন। আবার অনেকের মনের মধ্যে ভয় আসে যে, ছেলেটা নামাজে গেছে। এখন আমি না বলে সবজিটা নিয়ে যাবো, আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন না। এই ভয়ে অনেকে নিতে চায় না। অনেক দোকারার কোথাও গেলে অনেক সময় চুরি হয়। তবে আমার এখান থেকে কোন চুরি হয় নাই। ইনশাআল্লাহ আশা করি আর হবেও না। তারপরও যতটুকু চেস্টা সেভ রাখবো। আল্লাহ বলছে, নিজের মালকে যদি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখে তাহলে আল্লাহ হেফাজত রাখবে। আমি যদি খোলা মেলা রাখি সেটাতো আর কেউ দেখবে না। তবে হেফজতের মালিক আল্লাহ হাতে। আমার চেস্টা আমি করবো।’

তবে পরিচিত যে দোকানদারেরা আছেন তাদের বলি নামাজে যাচ্ছি একটি দেখে রাইখেন। অনেকে চিনে যে মোল্লা নামাজে গেছে একটু দেখে রাখি যোগ করেন মোহাম্মদ শরিফুল ইসলাম। 

‘নামাজ পড়ার কারণে অনেকে খুব ভালোও বাসে। তাওয়াক্কাল করি আল্লাহর ওপর। আল্লাহর ওপর ভরসা করে নামাজে যাই। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা। আল্লাহ বলছে আমার যে জিম্মাদার হবে আমি তার জিম্মাদার হয়ে যাব। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কাল করে নামাজে যাই আল্লাহই আমাকে সাহায্য করেন। নামাজের সময় যে পরিমাণ বিক্রি হয় তার চেয়ে দ্বিগুণ বিক্রি হয় নামাজের পরে, আল্লাহ সেই প্রতিফল দিয়ে দেন। নামাজ পড়ে আমি সেই প্রমাণ পাইছি।’

মোহাম্মদ শরিফুল ইসলামের দোকান, ছবি : সোনালীনিউজ। 

না বলে শাক নিয়ে গেলেও তিন পর এসে টাকা দিয়ে গেছেন এমন একটি ঘটনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, একদিন একলোক দুই আটি শাক নিয়ে গেছে। তিন পরে এসে বললো মোল্লাহ তুমি নামাজে গেছ। আমি তোমারে এসে পাইনাই। দুই আটি শাক নিয়ে গেছিলাম। এই ধর তোমার টাকা। এরপর আমি তাকে বলি সমস্যা নাই আপনি যখন ইচ্ছা নিয়ে যাইয়েন। পরে টাকা দিয়ে গেলেই হবে। এভাবে অনেকে শাক নিয়ে পড়ে টাকা দিয়ে যায়। যারা চেনা-পরিচিত তারা এভাবে নিয়ে গিয়ে পরে টাকা দিয়ে যায়। 

কারও যদি প্রয়োজন হয় ভ্যানসহ সব নিয়ে যায় তারপরও তার কোন আপত্তি নাই জানিয়ে সবজি ব্যবসায়ী সোনালীনিউজকে আরও বলেন, আমার যদি ভ্যানসহ সব নিয়ে যায় তারপরও আমার কোন আপত্তি নাই। কারণ কারও নিশ্চয়ই প্রয়োজন আছে, তাই সে নিছে। 

‘আলহামদুলিল্লাহ আমার মনে কোন দু:খ নাই। বরং আল্লাহ আমাকে আরও ভালো রাখবেন। যদি কেউ নিয়া খায় এটার প্রতিদান আল্লাহই দিবেন। আমি পুরোটা আল্লাহ উপর ছেড়ে দিয়েছি। আমি মনে করি একজনের প্রয়োজন হয়েছে তাই নিছে। টাকা থাকলেতো আমাকে বলেই নিতো। ৫-১০ টাকা কোন বিষয় না। কিন্তু হতে পারে কারও আয় উন্নতি কম। তাই সে নিয়ে গেছে। আমি ভাবিনা কেউ এটা চুরি করে নিয়ে গেছে।’

সোনালীনিউজ/এমএএইচ

Wordbridge School
Link copied!